লেখকের জন্ম

হুমায়ূন আহমেদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মরণে একুশে পদকে ভূষিত শ্রদ্ধাভাজন এক লেখকের কথা বলছি। লেখককে প্রথম দেখেছি কোনো এক বসন্তের দিনে। খুব ব্যস্ত এক মুহূর্তে আর এই তো সেই দিন যখন তিনি নীরবে চলে গেলেন।

ইয়েল ইউনিভার্সিটির (Yale University) একটি কনফারেন্স শেষ করে ফিরছি নিউইয়র্ক শহরের দিকে। শহরটিকে আগে দেখেনি। তাই ঠিক করেছিলাম, দুই দিন সেখানে ঘুরে বেড়াব। পথে খবর শুনলাম, কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ আর নেই। সময়টা জুলাই ১৯, ২০১২। কেমন যেন একধরনের শূন্যতা অনুভব করলাম। মনে পড়ে যায় লেখককে প্রথম দেখার স্মৃতি।

কার্জন হলে মাইক্রোবায়োলজির প্রথম বর্ষের নবীনবরণ অনুষ্ঠান চলছে। কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে। হঠাৎ একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা এসে থামল। এক ভদ্রলোক খুব তাড়াতাড়ি নেমে কেমিস্ট্রির পুরোনো বিল্ডিংয়ে ঢুকে আবার সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে গেলেন। কোনো দিকে তাকালেন না! আমার এক সহপাঠী বলল, ‘ওনাকে চিনতে পারছিস? উনিই লেখক হুমায়ূন আহমেদ। যদি কথা বলার ইচ্ছা হয়, তাহলে বইমেলায় গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থাক।’

ইচ্ছা হতো কোনো এক দিন যদি অধ্যাপক হুমায়ূন আহমেদের কেমিস্ট্রি ক্লাসে বসতে পারতাম! আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে সম্ভবত তিনি আর ক্লাস নিতেন না। তাই ক্লাসে বা বইমেলার লাইনে কোথাও আমাকে যেতে হয়নি। ২০ জুলাই, ২০১২, নিউইয়র্কের এক ভাইয়ের সাহায্যে শহরের যে মসজিদে লেখকের জানাজা সম্পন্ন হয়, অনেক কষ্টে খুঁজে বের করে সেখানেই হাজির হই। সেদিন ছিল শুক্রবার, জুমার দিন।

জুমার নামাজের পর লেখককে একঝলক দেখার সুযোগ হয়। সেই মুহূর্তে ঘুমন্ত হুমায়ূন আহমেদকে দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, লেখকের কি কখনো মৃত্যু হয়?
পাঠক হিসেবে আমার হুমায়ূন আহমেদের লেখার সঙ্গে পরিচয় স্কুল প্রতিযোগিতায় পুরস্কার হিসেবে ‘দারুচিনি দ্বীপ’ বইটি পেয়ে। খুশির উচ্ছ্বাসে এক বসাতেই বইটি পড়ে শেষ করি। আমার বীণায় সেদিন কোনো সুর বেজে উঠেছিল আমি নিজেই জানি না। দারুচিনি দ্বীপের স্বপ্নে বিভোর হয়ে আরও বই খুঁজতে থাকি। লেখকের বই মানেই একটু ভিন্ন অনুভূতি! যেন আমার জীবনের অনেক কথা আর আবেগের ছোঁয়ায় এক অপূর্ব দৃশ্যপট। যেদিন অ্যারিজোনায় যশোহা বৃক্ষকে দেখে পুলকিত হলাম, মনে পড়ে বহু আগেই যশোহার জন্ম আমার হৃদয়ভূমিতে, যার বীজ বপন করেছেন লেখক হুমায়ূন আহমেদ, ‘যশোহা বৃক্ষর দেশে’ লেখায়। আমেরিকায় পড়ালেখা করতে এসে জীবনের যে বাস্তবতার মুখোমুখি হই, আমায় মনে করে দেয়, অনেক আগেই এই অধ্যায়ের দৃশ্যপট আমার দেখা হুমায়ূন আহমেদের ‘হোটেল গ্রেভার ইন’ পড়ে। হুমায়ূন আহমেদের নর্থ ডেকোটায় পিএইচডি করার সমকালীন অবস্থার সঙ্গে আমার সময়ের পরিস্থিতির কোনোও পার্থক্য নেই। পয়সা বাঁচিয়ে এক ডলারের জিনিস কেনা থেকে শুরু করে পরীক্ষার ভয়াভহ অভিজ্ঞতা, সবকিছুর সঙ্গে লেখকের মতো একদিন আমিও এসবের সঙ্গে পরিচিত হই।

হুমায়ূন আহমেদ

আমার দুই দিনের নিউইয়র্ক সফরের সঙ্গে লেখক হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতি অক্ষয় হয়ে থাকবে। যেদিন নিউইয়র্ক থেকে (২১ জুলাই, ২০১২) চলে আসি, মনে হলো কে যেন পিছু পিছু বলছে, ‘সব সময় জানার চেষ্টা করো। বুদ্ধি, যুক্তি ও মানবিক চেতনা দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করো। নিজেকে ভালোবাসো, জাগো আর জাগাও। প্রাণকে বাঁচিয়ে রাখো।’

দেশের বাইরে অবস্থান করায় একুশে ফেব্রুয়ারি, বইমেলা আর নতুন প্রকাশিত বই ছুঁয়ে দেখার অভাব মনকে সব সময় ব্যথিত করে। অপেক্ষায় থাকি কখন নতুন বই হাতে আসবে। সময় আর দূরত্ব প্রতিবন্ধক হলেও প্রতিবছর যেভাবেই হোক হুমায়ূন আহমেদের লেখা নতুন বই সংগ্রহ করার সব রকম প্রচেষ্টা ছিল। সময় করে কাজের ফাঁকে সেই সব বই কিছু কিছু পড়া হয়েছে। একটি বই পড়ে আনন্দ পাওয়া আমাদের কর্মব্যস্ত জীবনের জন্য অবশ্যই অনেক বড় কিছু পাওয়া। কিন্তু প্রশ্ন করি নিজেকেই! নেপথ্যে যিনি আছেন, তাঁর মূল্যবোধ, দর্শন বা জীবনবোধকে অনুধাবন করার জন্য মেধা বা মনন শক্তি—এর কোনোটি কি যথার্থ ব্যবহার করেছি?

লেখক হুমায়ূন আহমেদকে শেষবারের মতো দেখার পরেই যেন প্রথমবারের মতো লেখকের জন্ম উপলব্ধি করতে পারলাম। লেখকের নতুন বইয়ের অপেক্ষায় নিশ্চুপ। তাই আবারও পড়া শুরু করি হুমায়ূন আহমেদের পূর্ব প্রকাশিত বইগুলো। নতুন করে পুরোনো বইগুলো আবারও পড়া নিছক আনন্দ লাভের জন্য নয়, লেখককের জীবনদর্শন জানার প্রত্যাশায়, যেখানে তাঁর লেখনীতে বিজ্ঞান আর সৃষ্টির রহস্যের মিলন ঘটে।

এ এক অন্য রকম উপলব্ধি! যাকে খুঁজে দেখার চেষ্টা করিনি আগে, এখন তিনি নতুন করে আমার ভেতর জন্ম লাভ করছেন তাঁর ধর্ম, দর্শন, বৈজ্ঞানিক চিন্তায়, আর জীবনবোধের বিস্তৃত দিগন্তে। লেখকের শেষ সময়ের লেখা, ‘আমি’—এসব কিছুর সমন্বয়ে প্রতিভাত এক শিল্প, যা পড়লে স্বভাবতই শিল্পীকে খোঁজার তাড়না জন্মায়। সহজ করে জীবন ও জ্ঞানের যেকোনো বিষয়কে প্রকাশ করা এত সহজ কাজ নয়। অনাড়ম্বরভাবে যিনি এই কাজটি করতে পারেন, তিনি জীবন ও লব্ধ জ্ঞান প্রকাশের এক অসাধারণ ক্ষমতা রাখেন। অনবদ্য সৃজনশীলতার মাধ্যমে এভাবেই একজন লেখকের জন্ম হয়।

হুমায়ূন আহমেদের শেষ সময়ে তাঁর নিউইয়র্কে অবস্থানকালে একটি সাক্ষাৎকার শুনেছিলাম। তিনি মানুষের মাহাত্ম্য সম্বন্ধে মহান সৃষ্টিকর্তার বাণী উল্লেখ করে সেই কথাটাই স্মরণ করে বলেন, ‘মানুষকে সৃষ্টিকর্তা অনেক রকম ক্ষমতা দিয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ করে সৃষ্টি করেছেন। আমরা মানুষ যেন সেসব ক্ষমতার সুব্যবহার করি।’
যুগে যুগে জ্ঞানী লেখকদের জন্ম হোক সৃষ্টিকর্তার দেওয়া সেসব ক্ষমতার যথার্থ পরিচর্যার মাধ্যমে। নতুনভাবে সমৃদ্ধ হোক বাংলা ভাষায় রচিত ধর্ম, বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শনের নানাবিধ চিন্তাধারা। মাতৃভাষা দিবসের সপ্তাহে শাশ্বত শ্রদ্ধা সব সপ্রতিভ লেখকের প্রতি।

*ফারহানা রুনা, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।