লাল রঙের হালখাতা বর্ষবরণের স্বপ্ন

পুরান ঢাকার দোকানগুলোতে চলছে হালখাতার আয়োজন।
পুরান ঢাকার দোকানগুলোতে চলছে হালখাতার আয়োজন।

সম্রাট আকবর বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ফসল ফলার সময় বিবেচনা করে। ছয় ঋতুর বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষের তাৎপর্য তাই এই বর্ষপঞ্জির সঙ্গে ওতপ্রোত। এখনো গ্রামীণ জীবনযাত্রা থেকে এর প্রভাব পুরোপুরি নিঃশেষিত হয়ে যায়নি। যদিও এর সঙ্গে সম্রাটের কোষাগারে কর সংগ্রহের অভিপ্রায়ই ছিল প্রধান; কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলার জনজীবনে তা এমনভাবে প্রোথিত হয়ে গিয়েছে যে গত শতাব্দীর পঞ্চাশ বা ষাটের দশকেও আমাদের যাদের জন্ম, তারাও সেই অভিঘাতের প্রত্যক্ষতাকে স্মরণ করতে পারি। আমার বয়স যখন কৈশোর অতিক্রম করেনি, তখনো গ্রামে গেলে পয়লা বৈশাখে বান্নির মেলায় যাওয়া হতো। আমার অন্তরে সেই স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বলে। পয়লা বৈশাখের বান্নির মেলায় এখনকার মতো বিদেশি জিনিসপত্র বেশি ছিল না, এগুলোর অভাবেও দেশীয় সামগ্রীর বৈচিত্র্য যে যথেষ্ট অভিঘাত সৃষ্টিকারী ছিল তা মনে পড়ছে।
মনে পড়ছে পয়লা বৈশাখে মামার সঙ্গে কোনো কোনো দোকানে গেলে সাদরে মিষ্টি খেতে দিয়েছে। সেই মিষ্টির মিষ্টি স্মৃতি কি ভোলা যায়! ব্যবসায়ীদের বকেয়া আদায়ের সঙ্গে যে এর সম্পর্ক ছিল, তা বুঝেছি কিছুটা বড় হয়ে। যাঁরা বকেয়া টাকা নিয়ে দোকানে যেতেন, তাঁরা ছিলেন দোকানদারের কাঙ্ক্ষিত অতিথি! তাঁদের আপ্যায়ন করানো হতো মিষ্টি দিয়ে। আগের হিসাব থেকে পাওনা টাকা বুঝে নিয়ে নতুন খাতায় শুরু হতো নতুন হিসাব। পরে বুঝেছি, এই লাল খাতায় লেখার সঙ্গেই সম্পর্ক হালখাতা অনুষ্ঠানের। পুরোনো বছরের হিসাব পরিশোধ করে নতুন বছরের খাতায় হালনাগাদ করা হতো বলেই এর নাম হালখাতা।
বাংলাদেশে এখনো হালখাতা উৎসব কোথাও কোথাও চোখে পড়ে। তবে বিশ্বায়নের নাগরিকতায় সেই হালখাতার আর তাৎপর্য নেই। নগরজীবনে কমে গেলেও আজও হালখাতা বেঁচে আছে বাংলা বছরের একটি ঐতিহ্য হিসেবে চিহ্নিত হয়ে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে হাজার মাইল দূরের আমেরিকায় বসবাসরত বাঙালিদের সঙ্গে সেই হালখাতার তো কোনো সম্পর্ক নেই! এমনকি এখানে বাংলাদেশের ষড়্ঋতুকে অনুভবও করা যায় না একেবারেই। অথচ বাংলা বর্ষপরিক্রমার প্রথম মাস বৈশাখের প্রথম দিনে আমেরিকান বাংলাদেশিদের অন্তরে আনন্দ-উৎসারণের কমতি নেই। চারদিকে বহু উৎসব আয়োজনের আবাহন শুনে তো তেমনটিই মনে হচ্ছে! বাংলাদেশের বাইরে বসবাসরত বাংলাদেশিদের চেতনার গভীরদেশে এ তো ইতিহাসের স্মৃতির অনুরণন ছাড়া আর কিছু নয়!
মনে পড়ে, গ্রামীণ জীবনে একসময় পয়লা বৈশাখ আসার মাস দুয়েক আগে থেকেই চলত মেলার আয়োজন। সেকালে তো আর আগ্রামবিস্তারিত ব্যাংকিং ব্যবস্থা ছিল না, গ্রামের বধূমাতাগণ ঘরে ঘরে বাঁশে ছিদ্র করে পয়সা জমা রাখতেন। বৈশাখের বান্নির দিন বাঁশের গাঁট কেটে যত্ন করে জমানো সেই পয়সা বের করে তুলে দিতেন সন্তানদের হাতে। দুরন্ত শিশু-কিশোরেরা গুরুজনদের সঙ্গে বা বন্ধুরা একত্রে হাত ধরাধরি করে যেত কোনো বটতলায়, কিংবা নদীর পাড়ে জমে ওঠা বান্নির মেলায়। দিনমান ঘোরাঘুরি করে মেলা থেকে কিনে আনত বাঁশি, ভেঁপু বা ডুগডুগি। মেয়েরা আনত মাটির নানা তৈজসপত্র, অ্যালুমিনিয়ামের ছোট ছোট হাঁড়ি-পাতিল, ঢাকনা, কাঠের বা মাটির হাতি-ঘোড়া বা আরও কত কিছু!
খাওয়ার জিনিস বলতে ছিল মুড়ি-মুড়কি, বাতাসা, মুরালি, চিনির খেলনা হাতি-ঘোড়া আরও কত কী! বান্নির মেলা থেকে কিনে আনা বাঁশির শব্দ মাসখানেক সময়জুড়ে মাতিয়ে রাখত বাড়িঘর। সেই বান্নির মেলা এখন অতীত হলে কী হবে, তা রূপান্তরিত হয়ে নতুন অনুষঙ্গে ভিন্ন কায়া অর্জন করেছে। এখন এত যোগ হয়েছে আধুনিকতা। বটতলা থেকে তা স্থান পেয়েছে শহরের কোনো অভিজাত মিলনায়তনে বা প্যান্ডেলের ঘেরাটোপে। আলোচনা সভা আর গান-বাজনায় এসে ধরা দিচ্ছে ঐতিহ্য হয়ে। আর মিলনায়তনের পাশে যদি এক চিলতে সবুজ খালি জায়গা পাওয়া যায়, সেখানেই বসে মেলা। সেই মেলায় মাটির তৈজসপত্রের স্থান করে নিয়েছে বৈদ্যুতিক সামগ্রী এবং ব্যাটারিচালিত বিচিত্র খেলনা।
বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপনে এখন নাগরিক জীবনে যোগ হয়েছে প্রিয়জনকে উপহার দেওয়ার অনুষঙ্গ। এখন এর উপহারসামগ্রীতেও এসেছে বৈচিত্র্য ও প্রাচুর্যের ছোঁয়া। এখানে যেন ছোঁয়া পাওয়া যায় একসময়ের ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক জীবনস্মৃতির! যেমন একসময় গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে দেখা যেত ভোরে অন্ধকার থাকতে থাকতেই চুলা জ্বালানো হতো। সেই যে চুলা জ্বলা শুরু, তা শেষ হতো গভীর রাতে। যৌথ পরিবারের অগণিত সদস্যের কে যে কখন আসত, তার খোঁজ রাখারও কেউ ছিল না। বউ-ঝিদের দেখা যেত কেউ ঢেঁকিতে ধান ভানছে, কেউবা ধান এনে রাখছে গোলাঘর থেকে। কেউ মনোনিবেশ করেছে রান্নাবাড়ায়।
গ্রামজীবনের কথা তো অনেক হলো। এই যে একসময়ের কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশে এখন ব্যাপক নগরায়ণ ঘটছে, এটা বাস্তবতা। এরই প্রতিক্রিয়ায় রূপান্তর ঘটছে বাংলার জনজীবনে। এমনকি এটাও বাস্তব যে কৃষিনির্ভর গ্রামের জীবনও ক্রমশ নাগরিকতায় রূপ নিতে চলেছে। এটাও গভীর বাস্তবতা যে বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে উন্নয়নের দিকে। এখনকার গ্রাম আর আমাদের স্মৃতির আদিম গ্রামের মতো নেই! এখনকার নাগরিক মধ্যবিত্ত জনজীবনের বিস্তার ঘটেছে বিরাটরূপে! তাই নাগরিক জীবনের কথা বলাতে রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ল। কারণ মধ্যবিত্ত নগরজীবনে রবীন্দ্রনাথ ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন। তাঁর কথা মনে পড়ার সূত্রও আসলে এই বৈশাখ। কারণ বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাসেই যে তাঁর জন্ম! এখনকার উন্নয়নমুখী বাঙালির মধ্যবিত্ত নগরজীবনে বৈশাখের সঙ্গে তাঁর নামটাও বোধ হয় এ কারণেও ওতপ্রোত হয়ে গেছে। তিনি জন্মেছিলেন এই মাসের ২৫ তারিখের রৌদ্রদগ্ধ দিনে। ফলে রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধাবশত তাঁর জন্মবর্ষের বৈশাখ মাস থেকেই বর্ষ গণনা করে একজন এর নাম দিয়েছেন রবীন্দ্রাব্দ। সে হিসেবে এখন পর্যন্ত ১৫৬টি রবীন্দ্রাব্দ পার হয়ে গেল। সেই সব কথায় গিয়ে লাভ নেই বলে তা বরং কুলুঙ্গিতে তোলা থাক! আমরা বরং বৈশাখের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক নিয়ে দু-চারটি কথার খই ভাজি!
যদি বলা হয় যে বাংলাদেশ থেকে বহু দূরের অনাবাসী জীবনে বাংলাবোধকে অনেকটাই প্রেরণা জুগিয়ে চলে ইতিহাসের পাতায় পাতায় জমে ওঠা বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম দিনটির উৎসবমুখরতা, তাহলেও বোধ হয় ভুল বলা হবে না। কারণ বাংলাদেশের মানুষ উপলব্ধি করে যে তার যাত্রাপথে আজ অনেক প্রতিবন্ধক। বাঙালির অন্তরে আজ যেন নির্মল শুভ্রতার প্রত্যাশা জেগে থাকতে পারছে না তার শক্তিমান
সামর্থ্য নিয়ে। মনে হয় বাংলাদেশ যেন কেবল চলছে সেই রকমের উন্নতির পথ ধরে, যেখানে উন্নতির আকাঙ্ক্ষা মনুষ্যত্বকে কেবল দহন করেই এগিয়ে চলছে; তারা অনুভব করতে পারছে না যে উন্নতি যদি কেবল মানুষের অনুকূল প্রকৃতিকে ধ্বংসের উৎস হয়, তাহলে তা তো মানুষকে নিয়ে যাবে ধ্বংসেরই দ্বারপ্রান্তে!
মানুষের হতাশাকে বৈশাখী ঝড়-ঝঞ্ঝা যেন উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে, এই স্বপ্নপ্রতীক জাগরূক ছিল রবীন্দ্রনাথের চেতনায়। যেন রবীন্দ্রনাথের চেতনায় বাহিত হয়েই এই সুদূর আমেরিকার এপ্রিলের ঘোর শীতের মধ্যেও ঐতিহ্যের ‘বাংলাবোধের’ প্রেরণায় একজন বাংলাদেশি শিল্পী গেয়ে উঠতে পারেন ঘোর গ্রীষ্মের রবীন্দ্রসংগীত ‘তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে…’। আমরা যদি বৈশাখকেন্দ্রিক রবীন্দ্রনাথের গান শুনি তাহলে আমাদের অন্তরে ‘বেড়া-ভাঙার মাতম নামে উদ্দাম উল্লাসে’; সেই উল্লাস নিয়েই তিনি দেখতে পান যে ‘বৈশাখী ঝড় আসে’। কেবল ‘উদ্দাম’, ‘উল্লাস’, ‘মাতম’ নিয়েই নয়, বৈশাখ তিনি দেখতে পান যুগপৎ ‘মোহন’ ও ‘ভীষণ বেশে’ও। সুতরাং বৈশাখী ঝড় তাঁর কাছে আশ্বাস হয়েও আসতে পারে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর দিব্য চোখে দেখতে পেয়েছিলেন যে যুগ যুগান্তর ধরে বাংলাদেশে মধ্যদিনের তপ্ত নিদাঘে পাখির কণ্ঠেও গান স্তব্ধ হয়ে যায়। আবার রৌদ্রদগ্ধ সেই নিস্তব্ধতার মধ্যেই দেখতে পেয়েছেন রাখাল বাঁশি বাজায় একাকী। অনুভব করেছেন মধুরের স্বপ্নাবেশে ধ্যানমগ্ন চোখে প্রান্তর প্রান্তের কোণে বসে ‘রুদ্র’ শোনে রাখালের বাঁশির সুর। একসময় ধ্যান ভাঙলে দেখেন তৃষাতপ্ত বিরহের নিরুদ্ধ নিশ্বাসে সহসা উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে আকাশ। রুদ্ধ সেই বিরহ দীর্ঘশ্বাসই যেন দূরের আকাশ-প্রান্তে গম্ভীর ডমরু ধ্বনিতে বিদ্যুৎ-ছন্দে আসন্ন বৈশাখী ঝড়ে রূপান্তরিত হয়। বৈশাখী ঝড়ের আগমনে জীবনের গতিশীলতা মূর্ত হয়ে ওঠে। বৈশাখকে তিনি তাই দেখেছেন অতলের বাণী খুঁজে পাওয়া ‘মৌনী তাপস’ রূপে। তাঁর বুকে দেখতে পেয়েছেন রুদ্রতপের সিদ্ধি। সেই বৈশাখ তাঁর কাছে ধরা দিয়েছে বড় নিষ্ঠুর হয়ে, মৃত্যুক্ষুধার মতো রক্তনয়ন মেলে তাকে তাকাতে দেখেছেন। কিন্তু এটুকুই তো সব নয়, দেখতে পেয়েছেন হঠাৎ সেই তারই কণ্ঠে বেজে ওঠে আশার ভাষা। বৈশাখের ধ্বংসলীলা তাই কেবল অনুভব করেননি তিনি। অনুভব করতে পেরেছেন, শুষ্কতাপের দৈত্যপুরে দ্বার ভাঙার তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বৈশাখ আসে রাজপুত্রের মতো।
বহুদূর ভূখণ্ডে বাস করেও বাংলাদেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতেই রবীন্দ্রনাথের সেই সব বৈশাখকেন্দ্রিক কবিতাগুলোর মর্মবাণী অনুভব করার মধ্য দিয়ে আমাদের সুদূরবাসী অন্তরে জেগে ওঠে সুতীব্র আশাবাদ। আমরা যেন এগিয়ে যেতে পারি রবীন্দ্রনাথের সেই বৈশাখী স্বপ্নের অনুপথে। সেই প্রেরণা তাই জাগরূক থাকুক আমাদের অন্তরে। নতুন বছরের লাল রঙের হালখাতায় লেখা হোক সেই স্বপ্নের কথা!