লাভা

থানা শহরে ঢুকেই যেদিন আকাশের দিকে স্টেনগান উঁচিয়ে তারা তাদের আগমনী ঘোষণা করেছিল, সেদিনও আবদুল মালেক অনেকের মতো শিষ আসা সবুজ ধানখেতের ভেতর উপুড় হয়ে শুয়েছিল। যেদিন তারা তার গ্রামে আসবে বলে রটনা হলো, সেদিন আবারও সে সবার সঙ্গে সেই ধানখেতেই উপুড় হয়ে শুয়ে থাকল। সে এতটাই নার্ভাস হয়ে পড়েছিল যে মুখস্থ চার কলেমার দুটো কিছুতেই তার স্মরণ হচ্ছিল না। তার মনে থেকে থেকেই প্রশ্ন জাগছিল কবরে তো মুনকার-নকির ‘মার রব্বুকা?’ জিজ্ঞেস করবে; কিন্তু এই মিলিটারিরা কী জিজ্ঞেস করবে? তার চিন্তাকে এলোমেলো করে দিয়ে তখন ধানখেতের ওপর দিয়ে ঈষৎ ঠান্ডা হাওয়া বয়, কিন্তু এই শীতল হাওয়ার মধ্যেও সে কুলকুল করে ঘামে।
এ সময় সে, ‘আফনারা বাইর অইয়া আউক্কা, মিলেটারিরা খুব ভালা মানুষ’—শোনে। প্রথমে ভাবে, সে ভুল শুনছে, কিন্তু আবারও, ‘ঈদগার মাটো মিডিং ডাকা অইছে, উনারা বখতিতা করতেছইন, ভালা ভালা কতা কইতেছইন, বাইর অইয়া আউক্কা, কোনো ডর নাই’ শোনে। সে এতক্ষণে কিছুটা সুস্থির হয়ে লক্ষ করে তার জামায় ঘাসের টুকরো, ধানগাছের ছেঁড়া পাতা ও ভিজে মাটির রস লেগে আছে। দূর্বা-ঘাসের ডগা তার নাকের ভেতরে ঢুকে খোঁচা দিলেও সে এতক্ষণ টের পায়নি। এখন হঠাৎ তার নাকে সুড়সুড়ি লাগে এবং খুব স্বস্তির সঙ্গে পরপর তিনবার হাঁচি দেয়। সে উঠে দাঁড়ায় এবং জামায় লেগে থাকা ঘাসের টুকরো ইত্যাদি চাপড় দিয়ে ফেলে দেয়।
শরতের ঈষৎ শীতল হাওয়ায় তার প্রাণটা জুড়িয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও সে এসব গ্রাহ্য করে না। আবারও প্রাণপণে কলেমাগুলো স্মরণ করার প্রয়াস চালায়, কিন্তু শেষের দুটো কিছুতেই স্মরণ করতে পারে না। তার মনটা খারাপ হয়ে গেলেও অপার কৌতূহল রোধ করতে পারে না। পাকিস্তানি মিলিটারি না জানি কী রকম—এই কৌতূহল তাকে এগোতে সাহায্য করে। তবু সে জিজ্ঞেস করে, ‘যাওয়াটা কি ঠিক অইব?’
—কোনো চিন্তা নাই। চেয়ারম্যান সাবে কইছইন হকলরে যাইবার লাগিয়া।
এতক্ষণ সে ভালো করে আন্দাজ করতে পারেনি, এবার স্পষ্ট দেখতে পায়; আরে এ যে ইউনিয়ন পরিষদের চৌকিদার রজব আলী। তার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল, রজব আলীকে দেখে তার ভরসা হয়। তবু সে বলে, ‘যাইমু?’
—কিতা কইয়ার আফনারে। চেয়ারম্যান সাবর হুকুম, চলউক্কা। না গেলে কিন্তুক ডর আছে।
অগত্যা সে ভয়ে ভয়ে ঈদগাহ মাঠে এসে দেখতে পায় বেশ ভালোই জমায়েত হয়েছে। দুটি চেয়ার ও একটি বেঞ্চ আনা হয়েছে। একটি চেয়ারে দশাসই একজন মিলিটারি বসে আছে। বেঞ্চে পাশাপাশি বসে আছে চেয়ারম্যান কুতুব আলী ও মুসলিম লীগের স্থানীয় নেতা নেসার উদ্দিন। দুজনের মাথায় পায়জামা-পাঞ্জাবি, মাথায় ঝকঝকে জিন্নাহ টুপি। মাঝখানের চেয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে উপস্থিত জনতার উদ্দেশে বক্তৃতা করছে একজন সুদর্শন চেহারার সেনা অফিসার। সে স্কুলে কিছুদিন উর্দু পড়েছিল, তাতেই অনেকটা বুঝতে পারে। লোকটিকে সে বলতে শোনে, ‘ইয়ে হামারা ওয়াতান হ্যায়। মাশরেকি নেহি, মাগরেবি নেহি, পাঞ্জাবি, বাঙাল, বালুচ, পাঠান কুচ নেহি, হাম সব পাকিস্তানি হ্যায়, মুসলমান হ্যায়। ইয়ে মুলককে লিয়ে লড়না হামারা ফরজ থা, ফরজ হ্যায়। কুচ গাদ্দার ইয়ে মুলক সে সাথ গাদ্দারি কিয়া, বিট্রে কিয়া। লেকিন ইয়ে হোনে নেহি দোয়ঙ্গা হাম, মোকাবেলা করনে কে লিয়ে হাম সব জান বাজি কিয়া। আপ সব হামারা সাত হ্যায়?’
সবাই হাত তুলে সম্মতি জানায়।
সে দেখে উপস্থিত জনতার চোখ থেকে প্রাথমিক ভয় কেটে যাচ্ছে। তারা হয়তোবা খানিকটা স্বস্তি বোধ করে। না, মিলিটারিরা অন্তত যা-ই হোক দেখামাত্রই গুলি করে মেরে ফেলবে না। সে দেখে চেয়ারম্যান কুতুব আলী তটক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছেন। তিনি অনেকটা শাসানির সুরে বললেন, ‘আফনারা হুঁশিয়ার অই যাইন, পাকিস্তানের জইন্য দরদ পয়দা করইন, ইন্ডিয়ার দালালদের লগে যাইন্না যেন, না অইলে কাউরেউ রেহাই দেয়া অইতনায়।’
স্বস্তি ও গোপন ভয়ের ছায়া নিয়ে তারা সবাই নিজ নিজ ঘরে ফেরে। মালেক দেখে তাদের উঠোনের কোণে একঝাঁক রঙ্গন ফুটে আছে। চড়ুইয়ের বাসা থেকে কিচকিচ শব্দে উড়ে যাচ্ছে চড়ুইগুলো। গোয়ালঘরে গরুগুলোর স্বাভাবিক নড়াচড়া, লেজের আন্দোলন চোখে পড়ে। চোনা গোবরের ঝাঁজালো গন্ধ ও মোরগের কক কক তার মনে সবকিছু স্বাভাবিকের অনুভূতি জাগায়। সে খুব সহজ ভঙ্গিতে রাহিমাকে এক কাপ চা দিতে বলে।
রাতে অনেক দিন পর তার খুব ভালো ঘুম হয়। টিনের চালে মৃদু শব্দে ওস ঝরে। হাস্নুহেনা ও ছাতিম ফুলের সুবাসে ম-ম করতে থাকে বাতাস। সুপোরিগাছগুলোয় বাদুড়ের ডানা ঝাপটানি ও তাদের ওড়ার শব্দ অনেকটা দূরাগত ধ্বনির মতো তার কানে ঢুকলেও তার গাঢ় ঘুমের খুব একটা বিঘ্ন ঘটে না।
ফজরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে তার ঘুম ভেঙে গেলে সে ভোর ভোর ওজুর জন্য পুকুরঘাটে যায়। সে দেখে পানি স্থির হয়ে আছে। পরিষ্কার পানির নিচে ঘাটের তাকে নির্বিকার শুয়ে আছে কয়েকটি চিংড়ি ও বালিয়া মাছ। সে কৌতূহল নিয়ে মাছগুলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। এ পুকুরে কিছু চাষ করা মাছও আছে। বেশির ভাগই রুই। কিছু মৃগেল ও কাতলাও আছে। এগুলো মাঝেমধ্যেই আলোড়ন তুলে ঘাই মারে। মাছগুলোর এই আলোড়ন সে খুব উপভোগ করে। এ সময় মাঝপুকুরে একটি প্রচণ্ড আলোড়ন উঠলে সে স্বভাবতই তাকায়। তখনই সে দেখে পুকুরের ওপারে, যেখান থেকে বিভিন্ন গাছপালা ও বাঁশবাগানের শুরু, সেখানে এগুলোর মাথার ওপর পাক দিয়ে ধোঁয়া উঠছে। ধোঁয়ার সঙ্গে আগুনের শিখাও ঝিলিক দিয়ে ওঠে। সে খানিকক্ষণ কিছুই বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে এই দৃশ্য দেখতে থাকে। হঠাৎ চকিতে তার মনে হয়, এ কাজ কি মিলিটারির। সে শুনেছে মিলিটারিরা প্রায়শই ঘরবাড়িতে আগুন দিচ্ছে। কিন্তু মিলিটারি অফিসার গতকাল যেভাবে বলল তাতে তো...। সে মেলাতে পারে না। খুব দ্রুত সে অজু সারে। ঘরে এসে ফজরের নামাজ আদায় করেই গোপাটের মেঠো রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। সে দেখে আগুন এখন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। একধরনের শাঁ শাঁ ও পট পট আওয়াজ শোনা যায়। তার মনে প্রশ্ন জাগে, কার বাড়ি?
সে ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগোয়, তখনি দেখতে পায় প্রায় ছুটতে ছুটতে তাদের প্রতিবেশী মমিন আসছে। মমিন তার কাছাকাছি এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ‘সামনে যাইন্না যে মালেক ভাই, মিলিটারিরা সিরাজ ভাইয়ের বাড়িতে আগুন দিছে।’
—সিরাজ ভাইয়ের বাড়ি?
—জি অয়, উনার হুরুভাই মেরাজ বাড়িত থাকিয়া পালাইছে, মিলিটারিরা কইতেছে ইন্ডিয়ায় গেছে।
—এর লাগি বাড়ি জ্বালাইব! বাড়ি তো একলা মেরাজের নায়।
—মিলিটারিদের ই কতা বুঝাইব কে?
—আহা রে, ইতো সুন্দর বাড়ি!
—মালেক ভাই সামনো যাইন্না যে, বাড়িত যাউক্কাগি।
মালেক ধীরে ধীরে বাড়ির পথ ধরে। বাড়িতে এসে দেখে চৌকিদার রজব আলী বসে আছে। রজব আলীর পরনে নতুন নীল পোশাক। হাতের লাঠিটিও নতুন। চকচক করছে। মালেককে দেখে রজব বলে, ‘কই গেছিলেন, রজব ভাই?’
—গোপাটো। নামাজ পড়িয়া একটু আটলাম (হাঁটলাম)।
—ভালা করছইন, আফনারে চেয়ারম্যন সাবে তলব করছইন।
—চেয়ারম্যান সাবে! আমারে! কিতার লাগি?
—জানি না। আফনে গেলে বুঝতা পারবা। একটু জলদি জলদি যাইতে কইছে।
সে খুব বিস্মিত হয়। চেয়ারম্যান তাকে তলব করবে কেন? সে তো কোনো কিছুতেই নেই। মিলিটারিরা আসার আগে কিংবা পরে সে আওয়ামী লীগ, মুসলিম লীগ, ন্যাপ কিংবা জামায়াতে ইসলামী—কোনো দলের সঙ্গেই ভেড়েনি। তবে ভোট দিয়েছে। সত্তরের এই নির্বাচন একটা অন্য রকমের নির্বাচন, অনেকটা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ভোট দিয়েছে সে; কিন্তু কাকে ভোট দিয়েছে সে তো সে ছাড়া আর কেউ জানার কথা নয়। তবে!
তার খুব ধন্দ লাগে, ভয়ও হয়। সে বলে, ‘তুমি ঠিক হুনছ তো রজব আলী, আর কাউর কথা কয় নাই তো?’
—কিতা যে কইন মালেক ভাই, আমি আফনারে চিনিনানি? আফনারেউ যাইতে কইছে।
চেয়ারম্যান কুতুব আলীর ভাবভঙ্গি ঢাকাতে ক্র্যাক ডাউনের পর থেকেই বদলে গেছে। এত দিন যদিও খুব একটা বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি, তবে থানা শহরে মিলিটারিরা আসার পর থেকেই সে সারাক্ষণ পায়জামা-পাঞ্জাবি ও মাথায় জিন্নাহ টুপি দিয়ে ঘোরাফেরা করছে। কিছু কিছু উর্দু বলারও চেষ্টা করছে। তার চোখের চাউনি ও ব্যবহার বদলে গেছে। যাকে-তাকে ‘তুই’ বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছে। সে প্রকাশ্যেই এখন বলছে, ‘কিছু মালাউন ও ইন্ডিয়ার দালাল ছাড়া পাকিস্তান ভাঙার কথা কেউ কল্পনাও করে না। তবে এখন এদের বাপরা এসেছে, ইয়ানে পাকিস্তানি বীর সৈন্যরা এসেছে। পুটকি দিয়ে বাঁশ ঠিকই ঢুকিয়ে দেবে এরা।’ ভাবতে ভাবতে মালেকের অস্বস্তি বাড়তেই থাকে। তবু সে বলে, ‘চা-মুড়ি খাইলাই। তুমিও খাও রজব আলী, তারপর রওনা দেই, কিতা কও?’
রজব আলী খানিক ইতস্তত করে বলে, ‘বেশি দেরি করিও না মালেক ভাই। বুঝো তো সময় এখন ভালা নায়।’
মালেক ঘরের ভেতরে গেলে রাহিমা বলে, ‘না গেলে কিতা অইব? আমার ভালা লাগের না। চেয়ারম্যান মানুষটা তো ভালা নায়।’ চিন্তা যে মালেকের হচ্ছে না তা তো নয়; তবু সে বলে, ‘চিন্তার কোনো কারণ নাই। আমি তো কোনোতাত নায়। দেও, চা-টা দেও। রজব আলীরেও দেও।’
চা খেয়ে বেরোবার মুখে রাহিমা বলে, ‘জলদি জলদি আইও। আমার খুব ডর লাগের।’
এই না হলে মেয়েমানুষ! খামাকাই মন খারাপ করে দেয়। সে তো কেউকেটা কেউ নয়। কারও সাতেপাঁচেও নেই। বড়জোর সে একজন সম্পন্ন কৃষক। সে ভালো বীজ বোঝে। বন্যা, খরা, অনাবৃষ্টি, মাছ চাষ, গরুপালন বোঝে। অবশ্য সে আরও দশজনের মতো সবকিছু ভালো থাক এই সব কামনা করে। তাহলে তার কোনো ঝামেলা কিংবা বিপদ হবে কেন?
চেয়ারম্যানের বাড়িতে এসে তার বিশেষ কামরায় ঢুকেই সে আতরের গন্ধ পায়। সে দেখে চেয়ারম্যানের ঘরের মেঝেতে ঝকঝকে কার্পেট। কোনার দিকে একটি আরাম চেয়ার, সেটিতে বসে আছে চেয়ারম্যান কুতুব আলী। তার সামনের চেয়ারগুলোতে নেসারউদ্দিনসহ আরও পরিচিত-অপরিচিত কয়েকজন। তাকে দেখে ম-ম আতরের গন্ধের ভেতর চেয়ারম্যান উঠে দাঁড়ায়, ‘আরে আবদুল মালেক, তোমার জন্যই তো ইন্তেজার। আমরা সবাই বইয়া রইছি।’
আবদুল মালেকের তবু ধন্দ যায় না। সে কোনো মাথামুণ্ডু বুঝতে পারে না। তার শুধু মনে হয়, চেয়ারম্যান যদি হঠাৎ তাকে চার কলেমা জিজ্ঞেস করে বসে। তবে চেয়ারম্যান তাকে অন্য প্রস্তাব দেয়। সে বলে, ‘মালেক মিঞা হুনো, বয়েস তো কম অইল না, অনেক কিছু তো দেখা অইল। তবে দেশ বাঁচলে তুমি-আমি হকলউ বাঁচমু। দেশের খুব সংকট। আমরার প্রিয় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নানান ষড়যন্ত্র...।’ এ পর্যন্ত শোনার পর আবদুল মালেকের চোখের সামনে দাউ দাউ আগুনের শিখা জ্বলে ওঠে। সে দেখে ধোঁয়ার কুণ্ডলী ক্রমশ পাক খাচ্ছে। তার মনে হয় তার গলা শুকিয়ে আসছে। সে খুব ফ্যাসফেসে গলায় বলে, ‘পানি, পানি খাইমু।’ চেয়ারম্যান তখন বলছিল, ‘অতএব এই দেশটারে বাঁচাইতে অইলে আমরার হকলরে ঝাঁপাইয়া পড়তে অইব। সুতরাং আমরা একটা শান্তি কমিটি করতাম চাই। এর একজন মেম্বার অইবায় তুমি। তোমার মতো ভালা মানষর থাকা দরকার শান্তি কমিটিতে। আর যা-ই অউক চোর, ছেচ্চড়, বদমাশদের তো এই কমিটিতে নেওয়া যায় না, তুমি কিতা কও আবদুল মালেক?’
আবদুল মালেক তখন ঢকঢক করে পানি খায়। আতরের গন্ধ ও চারপাশের হিমশীতলতার মধ্যেও তার কপালে চিনচিনে ঘাম দেখা দেয়। তার মনে হয়, সে একটা হুজ্জতের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। এই সব ঝামেলার মধ্যে তাকে টানা কেন? চেয়ারম্যানই-বা সবাইকে রেখে তাকে নিয়ে টানাটানি করছে কেন? সে এসবের কী বোঝে? তার মনে হয়, সে এক মহা আতান্তরে পড়ে গেছে। চেয়ারম্যানের কণ্ঠ হঠাৎ যেন আছড়ে পড়ে, ‘কি মিঞা, কিতা ভাববায়? আজই কিছু কইবার কাম নাই। দুই-একদিন পরে কইলেও চলব।’
সে যেন দম ফেলে বাঁচে। ‘একটু ভাইবা লই, দুই-একদিন বাদেউ না অয় কইমু।’
—ঠিক আছে, তবে বেশি ভাবতে-টাবতে যাইও না।
—আমি তা অইলে এখন যাই?
—আইচ্ছা।
চেয়ারম্যানের ঘর থেকে বেরিয়েই সে ঈষৎ গরম হাওয়ার মুখোমুখি হয়। সে ত্রস্তভাবে হাঁটতে থাকে। তার কেবলই মনে হয়, সবকিছু আসলে স্বাভাবিক দেখালেও আসলে স্বাভাবিক নেই। কোথায় যেন কী একটা নেই হয়ে গেছে, সে ঠিকঠিক ঠাহর করতে পারছে না। সে ঠাহর করতে পারুক কি না-ই পারুক, এলাকার অধিকাংশ যুবক ছেলেই পাড়ি দিচ্ছে ইন্ডিয়ায়। যারা যেতে পারছে না, তারাও কেউ স্বস্তিতে নেই।
ঈদগাহ বাজারে এসে সে থমকে যায়। সে দেখে, পাকসেনাদের সাত-আটজনের একটা দল। তাদের সঙ্গে পিছমোড়া করে বাঁধা এলাকারই দুই যুবক আলতাফ ও সাজ্জাদ। ওরা নির্বিকার হেঁটে যাচ্ছে শত শত লোকের নীরব আর্তির মধ্য দিয়ে। ওরা যাওয়ার পরপরই সে শুনতে পায় অন্তত আটটি বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে ওরা। দুজন গৃহবধূকে ধর্ষণ করা হয়েছে এবং ধর্ষণে বাধা দেওয়ার কারণে হত্যা করা হয়েছে একজন স্বামীকে। তার মাথা ঝিমঝিম করে। ওয়াতান রক্ষা করতে এসে এরা ক্রমশ জড়িয়ে যাচ্ছে হত্যা, ধর্ষণ আর ধ্বংসযজ্ঞে। তার আবারও ধন্দ লাগে। পাঞ্জাবি, পাঠান, বালুচ কুচ নেহি হ্যায়, লেকিন বাঙাল কুচ হ্যায়। এক অজানা ক্রোধ তার সারা শরীর ছেয়ে ফেলে।
বাড়িতে এসেই সে তার কুঠারটি খুঁজে বের করে। খুঁজে-পেতে বের করে পাথরটিও। অতঃপর পাথরের ওপর ঘষতে থাকে কুঠারের মুখ। ঈষৎ মরচে পড়ে গিয়েছিল। ঘর্ষণে ঘর্ষণে মরচে সরে গিয়ে ক্রমশ ঝকঝকে হয়ে ওঠে ইস্পাত। সে বারবার মুখের কাছে এনে তাকিয়ে দেখে হাত বুলিয়ে পরখ করে ধার এবং আবারও ঘষতে থাকে কুঠারের মুখ।
রাহিমা কয়েকবার এসে ফিরে গেছে। সে কিছুই টের পায়নি। একমনে সে তার কাজে নিমগ্ন থেকেছে। সে ক্রমশ নিজের মধ্যে ডুবে যায়, তার মনে পড়ে, তার পূর্বপুরুষেরা, যারা একদা ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ বলে যাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিল, তারাই নির্বিচারে হত্যা, লুণ্ঠন চালিয়ে যাচ্ছে। ধর্মের কথা ভুলে গিয়ে ভাষার ব্যবধানকেই ওরা মুখ্য করে তুলেছে। ভীষণ এক ঘৃণায় ওরা পিষে মেরে ফেলতে চাইছে এ দেশের আপামর জনগণকে।
সে এদিনই শুনতে পায় গ্রামের স্কুলের অঙ্কের টিচার আমানত আলীকে মিলিটারিরা নগ্ন করে খতনা পরীক্ষা করেছে। তার বিশেষ অঙ্গে খোঁচা দিয়ে তার পৌরুষত্ব সম্পর্কেও নাকি সন্দেহ প্রকাশ করেছে। আমানত আলীর মতো ভদ্র-সজ্জন লোকের এই হেনস্তা মুখ বুজেই সহ্য করতে হচ্ছে, এভাবে আরও কত কি। অথচ শালার পাকিস্তানি রেডিওতে সারাক্ষণই প্রচার করছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। কিছু গাদ্দার পাকিস্তানের সঙ্গে গাদ্দারি করে বিদেশি প্ররোচনায় দেশে নাশকতামূলক কাজ করছিল। যাদের অধিকাংশকেই হত্যা এবং দমন করা হয়েছে। বাকি যা ছিটেফোঁটা আছে, তা-ও অচিরেই দমন করা হবে।
তার খুব বিবমিষা হয়। সে সশব্দে উচ্চারণ করে, ওয়াক থু!
‘তোমার চা’, রাহিমা চা নিয়ে এসে তার সামনে রাখতে রাখতে বলে, ‘সজলের কথা যদি চেয়ারম্যান জেনে যায়, তবে তুমি বইলো ও মামাবাড়ি বেড়াতে গেছে।’ রাহিমার কী যে বুদ্ধি, যেন চেয়ারম্যান কচি খোকা, যা বলবে সে তা-ই বিশ্বাস করবে। চেয়ারম্যান ঠিকই জানবে এবং চেয়ারম্যান জানলে অবশ্যই মিলিটারিরা জানবে।
‘যদি মামাবাড়িতে খোঁজ নেয়, তখন বলে দেওয়া যাবে ও ঢাকায় চলে গেছে, ভার্সিটি খুলে যাচ্ছে না!’ তার চাচাতো ভাই সজল পঁচিশে মার্চের দিনেই পালিয়ে এসেছিল বাড়িতে। এদ্দিন খুব চুপচাপই ছিল। কয়েক দিন আগে হঠাৎ উধাও হয়ে গিয়েছে। অবশ্য শুধু রাহিমাকেই বলেছে সে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে যাচ্ছে।
এ কদিন এ নিয়েও সে খুব শঙ্কিত ছিল, কিন্তু কেন জানি এখন আর তেমন ভয় করছে না। একদিন তো মরতেই হবে—এই বোধ তাকে ক্রমশ ভয়শূন্য করে তোলে। আর মৃত্যুভয়কে অতিক্রম করতে পারলে আর থাকল কী? হাজার হাজার কচি ছেলেই যখন মৃত্যুর পরোয়া না করে যুদ্ধের ভয়াবহতার দিকে পা বাড়াতে পেরেছে, তাহলে সে নয় কেন? বরং সে তো ঢের ভালো অবস্থাতেই আছে।
সে উদ্দেশ্যহীন বাড়ি থেকে বেরিয়ে দক্ষিণ দিকে হাঁটতে থাকে। তার মনে হয় নীলু আপার খোঁজ নেওয়া হয়নি অনেক দিন। নীলু আপার স্বামী নুরুল ইসলাম থানা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি। শালপ্রাংশু চেহারা, মননশীল মানুষ। তবে মিলিটারি আসার পর থেকেই তিনি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। সে ভাবল আরও আগেই যাওয়া উচিত ছিল।
নীলু আপার বাড়ির কাছে এসে দেখে খালের এপারে বহু লোক জড়ো হয়ে আছে। সে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কিতা অইছে ভাইসাব?’
—সাজিদ সাবর বাড়িত মিলিটারি ঢুকছে।
—মিলিটারি! উনারা কেউ বাড়িত আছইননি?
—কিচ্ছু তো বুঝতাম পারিয়ার না।
নীলু আপার জন্য সে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। তার একমাত্র বোন। সে সব ভয় ঝেড়ে ফেলে খাল পার হয়ে নীলু আপার বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে। কয়েকজন হা হা করে উঠলে সে ভ্রুক্ষেপও করে না। বাড়ির রাস্তায় এলে একজন কালো কুচকুচে অত্যন্ত রূঢ় চেহারার সেনা এসে তাকে বলে, ‘হল্ট! তুম কৌন?’
—মেরা নাম আবদুল মালেক, সাজিদ সাব কা বেরাদর।
—কিয়া চাহিয়ে?
—কুচ নেহি, উসকো সাত মোলাকাত কে লিয়ে।
—উয়ো তো নেহি, ভাগ গিয়া।
—ম্যয়...
—তুম ভি ভাগো...। ইয়ে সব জ্বালা দোওঙ্গা। ইয়ে গাদ্দার কা ঘর। জয় বাংলাওয়ালে। শালা শুয়র কে বাচ্চে...তুম সব...
চড়চড় চড়চড় শব্দে একটা বিজাতীয় রাগ তার সারা শরীর ব্যাপ্ত করে ফেলে। তার হাত নিশপিশ করতে থাকে। অনেক কষ্টে সে নিজেকে সংবরণ করে আস্তে আস্তে পিছু হটে আসে। খাল পার হতেই গানপাউডার ছড়ানো নীলু আপার পাকা বিশাল বাড়িটি দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ক্রমশ আগুনের লেলিহান শিখা অপ্রতিরোধ্য হলে আগুনের তাপ এসে তাদের লোম পুড়িয়ে দিয়ে যায়। তারা ধীরে ধীরে পিছু হটতে থাকে। সে জনান্তিকে বলে, ‘এই কুত্তার বাচ্চারা এ দেশরে তামা বানিয়ে দেবে।’ কিন্তু কেউ কোথাও টুঁ শব্দটিও করে না।
ক্লান্ত, বিধ্বস্ত সে যখন বাড়িতে ফেরে, তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। প্রকৃতিতে শরৎ-সৌন্দর্যের আভা। হালকা কুয়াশার ভেতর খানিক পরই বড়সড় একটি চাঁদ দেখা যায়। সারা বাড়ি, মাঠ, গোপাট আলোকিত করে জ্যোৎস্না বইতে থাকে। ধানখেতের ওপর নানা ধরনের পোকা উড়ছে। দঙ্গল বেঁধে উড়ছে অসংখ্য জোনাকি। এগুলো আলাদা আলাদা গ্রুপে ভাগ হয়ে উড়ছে। মনে হচ্ছে মানচিত্রের ওপর ছোপ ছোপ রংচঙে অসংখ্য প্রজাপতি যেন। তার মনে হয়, এত সুন্দর এই দেশ—এই হার্মাদেরা তছনছ করে দিচ্ছে। তবে আশার কথা, এ দেশের অসংখ্য ছেলে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, আজ হোক কাল হোক, এরা প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তুলবেই।
‘তুমি এত ভেঙে পড়ছ কেন?’ রাহিমা কখন যে কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে, টের পায়নি সে। ‘জানো, এরা সব বেইমান, এরা আসলে আমরার লগে মশকরা করছে, পাকিস্তানের দোহাই দিচ্ছে। পাকিস্তান এরা ঠিকই চায়, আমরারে বাদ দিয়া চায়।’
—হকলর যে দশা অইব, তোমারও তাই অইব।
—তুমি বুঝতায় নায় রাহিমা।
—এত বুঝবার কাম নাই। ঘরো আও। বারা ইম (হিম) ঝরের।
—জোনাকও ঝরের।
—এর মাঝেও শখিনি (শৌখিনতা)!
এত দুঃখের মধ্যেও হেসে ওঠে সে।
এ সময় উঠোনে পায়ের শব্দ শোনা যায়। তারা চকিতে তাকিয়ে দেখে চৌকিদার রজব আলী এগিয়ে আসছে। সে কাছে এসে বলে, ‘চেয়ারম্যান সাব আফনারে এখনই যাইতে কইছে। চেয়ারম্যানর ঘরো ক্যাপ্টেইন সাবও আছে।’
শুনে গম্ভীর হয়ে যায় আবদুল মালেক। বলে, ‘আমি তো রাইতের সময় কোনোখানো যাই না।’
—তা অইলে আফনারে ধরিয়া লইয়া যাইতে অইব।
এক লাফে উঠে দাঁড়ায় আবদুল মালেক। দৌড়ে ঘরের ভেতর ঢোকে কুঠারটি হাতে নিয়ে বের হয়ে আসে। কুঠারটি উল্টো করে ধরে বাঁট দিয়ে সজোরে আঘাত হানে রজব আলীর মাথায়। রজব আলী শব্দ করে মাটিতে পড়ে যায় আর রাহিমার হাত ধরে টানতে টানতে সে বিস্তৃত ধানখেতে নেমে যায়। সারপার বর্ডারের দিকে দৌড়াতে দৌড়াতে পেছন ফিরে একবার তাকায়। তাদের বাড়ি ঘিরে বলকে ওঠা আগুনের শিখা তার হাতে ধরা কুঠারের ঝকঝকে ইস্পাতে প্রতিফলিত হয়ে চকচক করতে থাকে।