লন্ডনি পাত্র

পঞ্চমবারের মতো মিতুর বিয়ে ঠিক হতে হতে যখন ভেঙে গিয়েছিল শুধু নিতুর নানা বাড়ির লোক সিলেটের লোকাল না বলে, তাই এইবার নানা বাড়ির ঠিকানা পাল্টে দেওয়া হয়েছে বায়োডাটায়। মিতুর মার বহু দিনের ইচ্ছা মেয়েকে লন্ডনি পাত্রের কাছে বিয়ে দেবেন। কিন্তু সিলেটের লোকাল লন্ডনি পরিবার চায় খাঁটি সিলেটি মেয়ে। যার নানাবাড়ি, দাদাবাড়ি দুটোই সিলেটের হবে। শিক্ষাদীক্ষা কোনো ব্যাপার না। গায়ের রং ফরসা, আর মেট্রিক পাস হলেই হয়। লন্ডনে গিয়ে তো করবে ওই রান্নাবান্না আর বাচ্চা পালন, তাই সংসারের কাজ জানলেই হবে।

এবার আর রিস্ক নিলেন না মিতুর মা। কারণ তিনি কথা বললেই পাত্রপক্ষ বুঝে ফেলে তিনি সিলেটি না। মিতুর বড় চাচার কড়া আদেশ মেজো চাচিকে বের করা হবে মা বানিয়ে। বায়োডাটাতে নানা বাড়ির ঠিকানায় দেওয়া হয়েছে মেজো চাচির বাপের বাড়ির ঠিকানা। এ বছর মিতুর বয়স পঁচিশ হবে। তবে বায়োডাটাতে লেখা হয়েছে আঠারো। মিতুর পড়াশোনা ক্লাস এইট পর্যন্ত। বহু বছর পড়াশোনার ধারে কাছে না থাকলেও এবার প্রাইভেটে তাকে দিয়ে মেট্রিক দেওয়ানো হয়েছে। পাত্রপক্ষকে যাতে বলা যায়, এ বছরই মাত্র মেট্রিক দিল, তাতে বয়সের হিসাব বের হবে না সহজে।

ঘটক মহিলার সঙ্গে এসেছেন পাত্রের মা, মামা-মামি, বড় বোন ও দুলাভাই। মামি এসেই বাথরুমে যাবেন বলে পুরো ঘর হেঁটে বেড়াতে লাগলেন। কথা বলতে বলতে রান্না ঘরে ঢুকে গেলেন মিতুর চাচির সঙ্গে। এই চাচি এখন মিতুর মায়ের ভূমিকায় আছেন। মিতুর মা প্রথমে চেয়েছিলেন বাসায় থাকবেন, কিন্তু কারও সামনেই বের হবেন না। পরে চেয়েছিলেন পাশের বাসায় যাবেন, আর দূর থেকে দেখবেন পাত্রপক্ষের কারা কারা আসে। কিন্তু মিতুর বড় চাচার কড়া নিষেধ, পাশের বাসার লোকজন যদি জানে মিতুকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে, তো বিয়ে ওখানেই ভেঙে দেবে একটা না একটা বদনাম করে। হয় বলবে মা ননসিলেটি, নয় বলবে মিতুর বয়স আঠারো নয়, তা না হলে বলে দেবে মিতুর বাপ একটা ভাদাইম্যা, রোজগার কিছু করেন না, ভাইয়েরা সংসার চালায়। তাই মিতুকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে এটা কাউকে জানানো যাবে না। এমনকি আত্মীয়স্বজনকেও না। এর আগে দুইটা বিয়ের প্রস্তাব আত্মীয়রাই ভেঙেছে তাদের কাছে খোঁজখবর নিতে গেলে।

মিতুর মা বাসা থেকে বেরিয়ে গেছেন, কোথায় গেছেন কেউ জানে না। তিনি নিজেও জানেন না তিনি কোথায় যাবেন, যদিও তা নিয়ে ঘরের কারও মাথাব্যথা নেই। সবার টার্গেট একটাই, মিতুকে যেকোনো ভাবে লন্ডনি পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া। পাত্রের মামি হাঁটতে হাঁটতে মিতুদের বাড়ির পেছনে চলে গেছেন। সিলেটে প্রচলিত আছে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন লোকদের চেনা যায় বাড়ির পেছনের দিক দেখে। বাড়ির সামনে তো সবাই পরিষ্কার রাখে। মিতুর মায়ের ভূমিকায় মেজো চাচি বিরক্ত হচ্ছেন খুব মামির আচরণে। কিন্তু বলতে পারছেন না কিছু। কথা প্রসঙ্গে জানলেন, মামিরা সিলেট শহরে ভাড়া বাসায় থাকেন। যার নিজের বাড়ির উঠোন নেই, তিনি এসে দেখছেন অন্যের বাড়ির পেছনের খোঁজ। মনে মনে মেজো চাচি বললেন; যতই ময়লা খোঁজ, দেড় হাজার টাকার কামলা দিয়ে সারা বাড়ি পরিষ্কার করানো হয়েছে। অণুবীক্ষণযন্ত্র দিয়েও দেখলেও ময়লার দেখা পাবে না।

বিশাল খানাপিনার আয়োজন হয়েছে। এর আগে এক পাত্রপক্ষ বদনাম বের করেছিল নুডলসে মাংস নেই, এই বাড়ির লোকজন কৃপণ হবে। তাই এবার সব খাবার ‘হামাদান’ রেস্টুরেন্ট থেকে অর্ডার করা হয়েছে। মিতুর বড় চাচি পাত্রের মাকে জিজ্ঞেস করলেন, ছেলেকে নিয়ে আসতেন আপা, তাহলে মিতুকেও দেখা হতো ছেলের। ছেলের মায়ের এই কথা তেমন পছন্দ হলো না। মুখের ওপর উত্তর দিলেন—না আপা, ছেলের আবার পছন্দ কী! আমাদের পছন্দই ছেলের পছন্দ। বড় চাচি বললেন—না বলছিলাম আমরাও ছেলেকে দেখতাম, মিতুরও দেখা হয়ে যেত। পাত্রের মায়ের মনে হলো কিছুটা ইগোতে লাগল তাঁর ছেলেকেও দেখার কিছু আছে শুনে। হর হর করে শুনিয়ে দিলেন—দেখেন আপা, আমার ছেলে সৌন্দর্যের দিক থেকে কোনো অংশেই কম না, যার ফলে আমার ছেলেকে পটিয়ে বিদেশি একটা মেয়ে বিয়েও করেছিল। শুনেছেন নিশ্চয়ই, তার একটা বিয়ে হয়েছিল আগে। আমরা ওটাকে বিয়ে বলে মনেই করি না, ওই মেয়ে বাঙালি হলে কী হবে, বেশি ফার্স্ট ছিল। আমার ছেলেকে আমার কাছ থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিল, বেশি দিন যায়নি আমরাই ওকে ছাড়িয়ে নিয়েছি। অতি আধুনিক মেয়ে হলে শুধু স্বামী নিয়েই সুখী হতে চায়, ছেলের পরিবারের কথা মাথায় রাখে না। ছেলে বউ দরকার সংসারের জন্য, যে সুন্দর করে শুঁটকি ভর্তা করতে পারবে, বাসায় এক সঙ্গে ১৫ জন মেহমান আসলে রান্না করে খাওয়াবে হাসি মুখে, আমার মেয়েরা বাপের বাড়ি বেড়াতে আসলে তাদের আদর যত্ন করবে, শুধু ছেলেকে বুঝলেই হবে না; ছেলের পরিবারকেও বুঝবে এমন বউই আমরা খুঁজছি। দেশে এসেছি এক সপ্তাহ, এর মধ্যে চৌদ্দ জায়গায় মেয়ে দেখেছি। হয় মেয়ের দাদার বাড়ি নয়তো নানার বাড়ি সিলেটের বাইরে, না হলে মেয়ের গায়ের রং শ্যামলা। ঘটক আমাদের ফরসা বলে বলে বহু শ্যামলা মেয়ে দেখিয়ে ফেলে, তাই এখন আগে থেকেই ঘটককে বলে রাখা, মেকআপ ছাড়া মেয়ে দেখাতে হবে। আর কোনো কোনো মেয়ে সবদিকে হলেও দেখা যায় বয়সটা একটু বেশি। তাই বিএ/এমএ পাস মেয়েদের বাদ দিয়েছি। বেশি পড়াশোনা জানা মেয়েদের বিদেশে কন্ট্রোলে রাখা যায় না, কিছু হলেই পুলিশ ডাকে।

কথাবার্তায় মনে হলো মিতুকে পছন্দ হয়েছে পাত্রপক্ষের। মিতুর বড় চাচা আড়ালে নিয়ে গিয়ে চাচিকে এক ধমক দিয়ে বললেন—এত প্রশ্ন করো কেন? আমরা কী ছেলেকে না দেখে মেয়ে বিয়ে দেব। আগে ওরা মেয়ে পছন্দ করুক তারপর একদিন আমরা ওদের বাসায় গিয়ে পাত্রকে দেখে আসব। চাচি বললেন—কিন্তু যে বিয়ে করবে তার তো পাত্র দেখার অধিকার আছে। বড় চাচা এবার কঠিন ধমক দিলেন বড় চাচিকে—বেশি মাতব্বরি করবে না। এমনিতেই তিন জোড়াতালি দিয়ে মেয়েকে পার করার চেষ্টা করছি। ওর আবার পছন্দ কী? বিয়ে করবে, লন্ডনে যাবে, সংসার করবে। সেদিন আমাদের পাড়ার মফিজ মিয়া বলল—মিতুকে বিয়ে দেওয়া টাফ আছে, তাই সব জেনেশুনেই সে তার বউমরা ভাতিজার জন্য মিতুর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। ভাদাইম্যা বাপ আর ননসিলেটি মা শুনেই তো পাত্রপক্ষ আগেই পালায়। পেছন থেকে মেজো চাচি কথাগুলো শুনেই ভাশুরের মুখের ওপর বললেন—বড় ভাই কিছু মনে করবেন না, এতে মিতুর দোষ কোথায়?

বড় চাচা বললেন—মেজো বউ দোষ মিতুর নয়, দোষ আমাদের সমাজের, যারা একই দেশে বসবাস করে, এক অঞ্চলের লোক অন্য অঞ্চলকে ছোট করে দেখে, মা-বাবার ব্যর্থতাকে সন্তানের ব্যর্থতা হিসেবে দেখে। তুমি শুধু মিতুর দিক দেখছ, ওই ছেলেটির কথা একবার ভাবো, যে নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেও সংসার করতে পারেনি শুধু পরিবারের মেয়েটিকে পছন্দ হয়নি বলে। আমরা চাইলেও এসব নিয়ম থেকে হুট করে বের হতে পারি না। এ জন্য মেরুদণ্ড লাগে। এই ছেলের যদি মেরুদণ্ড থাকত, তবে নিজের বিয়ের পাত্রী দেখতে নিজেই আসত। পরিবারের পছন্দে ছেড়ে দিত না। আর ওই রকম মেরুদণ্ডহীন পাত্রেরই দরকার আমাদের, যে দ্বিতীয়বার বিয়ে ভাঙার সাহস করবে না সহজে; যদি পরে জানেও তুমি মিতুর মা না, চাচি। একবার কোনো রকম বিয়ে দিয়ে লন্ডন পাড়ি দিতে পারলেই হয়। মেজো চাচি ভাশুরকে বোঝাতে চেষ্টা করছেন; বিয়ে তো কোনো ছেলেখেলা নয়, সারা জীবনের ব্যাপার।

বড় চাচা কথা বাড়ালেন না। তিনি জানেন, মেয়েদের কথায় বেশি পাত্তা দিতে নেই। তারা বোঝে কম, বলে বেশি।

পাত্রের মামা আর দুলাভাই এখানে বসেই ঠিক করলেন, আগামী সপ্তাহেই আক্দ করানো হবে। পরে কাছের কিছু আত্মীয়স্বজন নিয়ে ছোট করে একটা অনুষ্ঠান করবেন মেয়ে বিদায়ের সময়ে। মিতুর চাচার কোনো আপত্তি নেই। তিনিও চান না লোক জানাজানি হোক খুব বেশি। বড় করে আয়োজন করে লোক খাওয়াতে গেলে, আসবে, খাবে আর সুযোগ বের করে বদনামও করবে। আর তা দূরের কেউ নয়; কাছের আত্মীয়রাই করবেন, তা বড় চাচা ভালো করেই জানেন। কিন্তু সমাজে থাকতে হলে ওই সব দু-মুখো আত্মীয়দের বাদ দিয়ে চলাও সম্ভব না। তাই তিনি ঠিক করেছেন, বিয়ের আসল কাজ শেষ হলেই ওই সব দু-মুখো আত্মীয়দের বাসায় মিষ্টি নিয়ে গিয়ে অনুনয় করে মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে বলে আসবেন, হুট করে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় কাউকে বলতে পারেননি। এতে কেউ রাগ নিয়ে বসে থাকলে তার সমস্যা, বড় চাচার তাতে কিছুই যায় আসে না। তিনি কারও কাছে ঠেকায় নেই। যেই নিম্ন মধ্যবিত্ত অভিভাবকের মাথার ওপর বিয়ে উপযুক্ত মেয়ে আছে, তিনি খুব ভালো করেই জানেন তাকে কী করতে হবে। মিতু এমনিতেই অসম্ভব সুন্দরী একটি মেয়ে। স্কুলে পড়ার সময় তাকে ছেলেরা বিরক্ত করায় ভয়ে মেয়েটি ঠিকঠাক মতো পড়াশোনা করতে পারেনি। মিতুকে পছন্দ করার মতো ছেলের অভাব ছিল না, কিন্তু যোগ্য পাত্রের দেখা মেলেনি। সিলেটি পরিবারের এত সুন্দর একটা মেয়েকে দেশে বিয়ে দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।

বড় চাচার দুই ছেলে, কোনো মেয়ে নেই। মিতুকে তিনি নিজের মেয়ের চেয়েও বেশি কিছু মনে করেন। মিতুর বাপ নিজের মেয়ে সম্পর্কে যা জানেন না; বড় চাচা তার চেয়েও বেশি জানেন। মিতুর বাবা বেশির ভাগ সময় বাড়িতে থাকেন না, কোথায় যান এত লম্বা সময়ের জন্য কেউ কখনো জানতেও চায় না। মিতুর মার ধারণা, মিতুর বাবার আরেক সংসার আছে, তবে তাতে তার খুব একটা যায় আসে না।

পাত্রপক্ষ যাওয়ার পর মিতুর মা ঘরে এসে ঢুকলেন। বড় চাচা জানিয়ে দিলেন, সপ্তাহখানেকের জন্য যেন তিনি তার বাপের বাড়ি চলে যান। মিতু হাউমাউ করে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে…