লন্ডন–বাংলা প্রেসক্লাবের নির্বাচন: ব্রিটিশ-বাংলাদেশি গণমাধ্যমকর্মীদের মিলনোৎসব
দ্বিবার্ষিক সাধারণ সভা ও নির্বাচনকে ঘিরে লন্ডন–বাংলা প্রেসক্লাবের গত রোববারের (৩০ জানুয়ারি) অনুষ্ঠানটি কার্যত রূপ নেয় ব্রিটিশ-বাংলাদেশি গণমাধ্যমকর্মীদের মহামিলনমেলায়।
দিনের শুরুতে শীতের সকালটা ছিল দারুণ রৌদ্রোজ্জ্বল। বিলাতের বিভিন্ন শহরে কর্মরত বাংলা গণমাধ্যমকর্মীরা বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে সকাল থেকে অনুষ্ঠানে যোগদান করতে থাকেন। মিলনায়তনের ভেতরে ও বাইরে লক্ষ করা যায় সংবাদকর্মীদের উচ্ছ্বাস ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের এক অভূতপূর্ব প্রাণবন্ত দৃশ্য। দীর্ঘদিন পর সহকর্মীদের কাছে পেয়ে গভীর আন্তরিকতায় উষ্ণ আলিঙ্গনে একে অপরকে কাছে টেনে নেন অনেকেই। পরস্পর কুশল বিনিময় করেন। চা-কফি বানিয়ে এক সহকর্মী তুলে দেন আরেক সহকর্মীর হাতে। একদিকে শুভেচ্ছা বিনিময়, অন্যদিকে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে প্রার্থীদের শেষ মুহূর্তের প্রচারণা—এ যেন সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির এক অভূতপূর্ব মিলনোৎসব!
পূর্ব লন্ডনের ওয়েস্টহ্যাম এলাকায় অবস্থিত ইমপ্রেশন মিলনায়তনটি দুপুর ১২টা নাগাদ সদস্যদের পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে। সদস্যদের নিবন্ধনের প্রক্রিয়া শেষ হলে শুরু হয় দ্বিবার্ষিক সাধারণ সভা। ক্লাবের সভাপতি এমদাদুল হক চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সাধারণ সভা পরিচালনা করেন বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জুবায়ের। সভাপতির শুভেচ্ছা বক্তব্য, সাধারণ সম্পাদকের বার্ষিক প্রতিবেদন পেশ ও কোষাধ্যক্ষ আ স ম মাসুমের আর্থিক প্রতিবেদন উপস্থাপনের পর সংগঠনের সদস্য পদ প্রদানের প্রক্রিয়ায় আরও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ, সাংবাদিকদের জন্য প্রশিক্ষণের আয়োজন, সদস্যদের মৌলিক রচনা নিয়ে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে লন্ডন–বাংলা প্রেসক্লাব জার্নাল প্রকাশসহ বিভিন্ন কার্যকর কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে সংগঠনটিকে সুদৃঢ় বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে এবং এর গঠনতন্ত্রে সময়োপযোগী পরিবর্তন আনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে মুক্ত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনায় সুচিন্তিত মতামত উপস্থাপন করেন মুহিব চৌধুরী, উদয় শংকর দাস, ফরিদ এ রেজা, নবাব উদ্দিন, সৈয়দ নাহাস পাশা, ডা. জাকী রিজওয়ানা আনোয়ার, শামসুল আলম, সৈয়দ আনাস পাশা, সারওয়ার-ই আলম ও বুলবুল হাসান। এ পর্বে সদস্যদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ।
সাধারণ সভার পাশাপাশি নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী মিলনায়তনের ওপরের তলায় শুরু হয় ভোট। সংগঠনের ৩২০ সদস্যের অধিকাংশই সশরীরে উপস্থিত হয়ে ভোট দেন। ব্যক্তিগত অপারগতার কারণে যাঁরা সশরীরে উপস্থিত হতে পারেননি, তাঁরা ভোট দেন ইলেকট্রনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে। ভোটদানের পাশাপাশি চলতে থাকে মধ্যাহ্নভোজ। এ পর্বে সদস্যদের সুস্বাদু খাবার দিয়ে আপ্যায়িত করা হয়।
সাধারণ সভা ও মধ্যাহ্নভোজ শেষ হতে সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। ততক্ষণে ভোটদানের প্রক্রিয়া প্রায় শেষের পথে। মিলনায়তনের ভেতরে ও বাইরে প্রার্থীদের চোখে–মুখে লক্ষ করা যায় উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার ছাপ।
ধীরে ধীরে মিলনায়তনটি কানায় কানায় পূর্ণ হতে থাকে দ্বিতীয় পর্বের জন্য আমন্ত্রিত অতিথিদের পদচারণে। বর্ণিল আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে মঞ্চ। উপস্থিত সুধীমণ্ডলীকে সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে দ্বিতীয় পর্বের অনুষ্ঠানের সূচনা করেন ঊর্মি মাযহার।
সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত দিয়ে শুরু এই পর্বে সংগঠনটির জীবনসদস্যদের সম্মাননা জানানোর পাশাপাশি ছিল মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক আয়োজন। সংগীত পরিবেশন করে মুগ্ধতা ছড়ান ফাহমিদা নবী, ডা. অরূপ রতন চৌধুরী, ‘ক্লোজআপ’খ্যাত শিল্পী রানা প্রমুখ।
সাংস্কৃতিক আয়োজন শেষে সম্মাননা পর্বে ক্লাবের মুক্তিযোদ্ধা সদস্য, করপোরেট সদস্য ও নতুন জীবনসদস্যদের সম্মাননা দেওয়া হয়। মোহাম্মেদ জুবায়েরের পরিচালনায় এ পর্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন ব্রিটিশ এমপি আপসানা বেগম, ব্রিটেনে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দা মুনা তাসনিম, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর গণমাধ্যম শাখায় কর্মরত রনি মির্জা প্রমুখ। সম্মাননা লাভ করেন তিন বীর মুক্তিযোদ্ধা সদস্য—আবু মুসা হাসান, সুজা মাহমুদ ও শেখ মুজাম্মেল হক কামাল এবং মুক্তিযুদ্ধে মাঠপর্যায়ে দাতা সংস্থা অক্সফামের কর্মী হয়ে কাজ করার জন্য ক্লাবের সদস্য, বিবিসিখ্যাত সাংবাদিক উদয় শংকর দাস।
করপোরেট সদস্য হিসেবে সম্মাননা পান ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মুহিব চৌধুরী। এ ছাড়া করোনাকালে কমিউনিটিতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সম্মাননা লাভ করেন ক্লাবের সদস্য জাকী রেজওয়ানা আনোয়ার ও মাহি মাসুম।
জীবনসদস্য সম্মাননা স্মারক পর্বে শুরুতে ২০১২ সালের জন্য সম্মাননা স্মারক গ্রহণ করেন চ্যানেল এসএর প্রতিষ্ঠাতা মাহি ফেরদৌস জলিল। এরপর ২০১৭-১৮ সালের জন্য গ্রহণ করেন যথাক্রমে বজলুর রশীদ এমবিই, আবদুল বারী, করিম মিয়া শামিম, সানোয়ার চৌধুরী, মামুন চৌধুরী, মোস্তফা আহমদ, রবিন পাল ও জাহাঙ্গীর খান। ২০২০-২১ সালের জন্য এম এ মুনিম সালিক, মো. শহীদুর রহমান, শফিকুল ইসলাম, মো. আনিসুল হক, সামসুল ইসলাম সেলিম, মো. আলী মজনু, ফজলুর রহমান, মাসুকুর রহমান, মতিন মিয়া, তফাজ্জল মিয়া, কাউন্সিলর আয়শা চৌধুরী, দিলওয়ার হোসেন, ব্যারিস্টার লুতফুর রহমান, মঈন উদ্দিন আনসার, এম এ গানি, আতাউল্লাহ ফারুক ও সৈয়দ মাসুক আহমদ।
সাংস্কৃতিক আয়োজন শেষ হতে হতে রাত প্রায় দশটা। এ সময় পরিবেশন করা হয় রাতের খাবার। নিচতলায় যখন খাবার পরিবেশিত হচ্ছিল, ওপরের তলায় তখন নির্ধারিত হচ্ছিল প্রার্থীদের জয়–পরাজয়ের হিসাব। খাবার পরিবেশন শেষ হলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বজলুর রশীদের নেতৃত্বে মঞ্চে আসেন নির্বাচন কমিশনার আজিজ চৌধুরী ও আনোয়ার বাবুল মিয়া। মিলনায়তনজুড়ে তখন টান টান উত্তেজনা। সবার একই প্রশ্ন, কার কপালে জুটতে যাচ্ছে বহুল প্রতীক্ষার এ বিজয়তিলক। কাদের হাতে অর্পিত হতে যাচ্ছে আগামী দুই বছরের জন্য লন্ডন–বাংলা প্রেসক্লাবের নেতৃত্বের দায়ভার?
অবশেষে এল বহুল কাঙ্ক্ষিত সেই মুহূর্ত। পিনপতন নিস্তব্ধতায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ঘোষণা করেন দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত দ্বিবার্ষিক নির্বাচনের পূর্ণাঙ্গ ফলাফল। নির্বাচনের ফলাফলে লক্ষ করা যায় প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি পরিষদের কোনোটিই এককভাবে পূর্ণাঙ্গ পরিষদ নিয়ে বিজয়ী হতে পারেনি। কার্যনির্বাহী পরিষদের মোট ১৫টি পদে ২টি পরিষদের ৩০ জন সদস্য এবং ৩ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী মিলে মোট ৩৩ জন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তাঁদের মধ্যে এমাদ-তাইসির-মুরাদ পরিষদ থেকে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদসহ আটজন এবং সাত্তার-মোসলেহ-সালেহ পরিষদ থেকে কোষাধ্যক্ষ পদসহ সাতজন নির্বাচিত হন। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কেউই নির্বাচিত হননি।
আগামী দুই বছরের জন্য বিভিন্ন পদে নির্বাচিত ব্যক্তিরা হলেন সভাপতি মোহাম্মদ এমদাদুল হক চৌধুরী, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি তারেক চৌধুরী, সহসভাপতি রহমত আলী, সাধারণ সম্পাদক তাইসির মাহমুদ, সহসাধারণ সম্পাদক সাঈম চৌধুরী, কোষাধ্যক্ষ সালেহ আহমেদ, সহকারী কোষাধ্যক্ষ মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ুম, সাংগঠনিক ও প্রশিক্ষণ সম্পাদক মো. ইমরান আহমেদ, গণমাধ্যম ও তথ্যপ্রযুক্তি সম্পাদক মো. আবদুল হান্নান, অনুষ্ঠান সম্পাদক মো. রেজাউল করিম মৃধা, নির্বাহী সদস্য পাঁচজন—আহাদ চৌধুরী বাবু, নাজমুল হোসেন, আনোয়ার শাহজাহান, শাহনাজ সুলতানা ও মো. সারওয়ার হোসেন।
বিস্তারিত ফলাফলে জানা যায়, সভাপতি পদে এমাদ চৌধুরী পেয়েছেন সর্বমোট ১৮২ ভোট, মোহাম্মদ আব্দুস সাত্তার ১২৮ ভোট। জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি পদে তারেক চৌধুরী ১৯৮ ভোট, শেখ মোজাম্মেল হোসেন কামাল ১০৮ ভোট। সহসভাপতি পদে রহমত আলী ১৭১ ভোট, আনিসুর রহমান আনিস লাভ করেন ১২৮ ভোট। সাধারণ সম্পাদক পদে তাইসির মোহাম্মদ ১৭৬ ভোট, মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ ১৩১ ভোট। সহসাধারণ সম্পাদক পদে সাঈম চৌধুরী ১৫৫ ভোট, ইব্রাহিম খলিল ১৫৪ ভোট। কোষাধ্যক্ষ পদে সালেহ আহমেদ ১৭৮ ভোট, আবদুল কাদের চৌধুরী মুরাদ ১২০ ভোট। সহকারী কোষাধ্যক্ষ পদে মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ুম ১২৫ ভোট, আমিনুল আহসান তানিম ৯৬ ভোট, মরিয়ম পলি রহমান ৮৫ ভোট। সাংগঠনিক ও প্রশিক্ষণ সম্পাদক পদে মো. ইমরান আহমেদ ১৬১ ভোট, রুপি আমিন ১৪৪ ভোট। গণমাধ্যম ও তথ্যপ্রযুক্তি সম্পাদক পদে মো. আবদুল হান্নান ১৫৭ ভোট, আবদুল কাইয়ুম ১৪৯ ভোট। অনুষ্ঠান সম্পাদক পদে মো. রেজাউল করিম মৃধা ১৭৪ ভোট, জুয়েল দাস ১৩১ ভোট। এ ছাড়া নির্বাহী সদস্য পদে আহাদ চৌধুরী ২১৬ ভোট, জে ইউ এম নাজমুল হোসেন ১৭৩ ভোট, আনোয়ার শাহজাহান ১৫৪ ভোট, মো. সারওয়ার হোসেন ১৪৮ ভোট, শাহনাজ সুলতানা ১৪৭ ভোট, মো. আজিজুল হক কয়েস ১৩২ ভোট, শহীদুর রহমান সোহেল ১৩১ ভোট, জি আর সোহেল ৯৮ ভোট, সাবুল চৌধুরী ৮৯ ভোট, মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ ৭৮ ভোট, মোহাম্মদ কোলন্দর তালুকদার ৫২ ভোট ও রুমান বখত চৌধুরী ২৭ ভোট।
ফলাফল ঘোষণার পর মিলনায়তনে ছড়িয়ে পড়ে আনন্দধারা। নবনির্বাচিত কর্মকর্তারা তাঁদের শুভেচ্ছা বক্তব্যে সদস্যদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। নির্বাচিত ব্যক্তিরা সহকর্মীদের জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।
ততক্ষণে রাত সাড়ে ১১টা। ধীরে ধীরে শুরু হয় বিদায়ের পালা। অনন্য একটি দিনের স্মৃতিকে আলোকচিত্রে ধরে রাখার জন্য লক্ষ করা যায় আলোকচিত্রীদের ক্যামেরার আলোক ঝলকানি। ওয়েস্টহ্যামের সুনসান লোকালয়ে মধ্যরাতের আলো-আঁধারিতে রাতের কুয়াশাগুলো ততক্ষণে আরও ঘন হতে শুরু করে। সহকর্মী-সুহৃদদের হৃদয়ের উষ্ণতা আর সারা দিনের বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালার মনোরম আনন্দ নিয়ে কুয়াশা ভেদ করে বাড়ির পথে পা বাড়ান সংগঠনের সদস্য ও আমন্ত্রিত অতিথিরা। আর এভাবেই সমাপ্ত হয় ব্রিটিশ-বাংলাদেশি গণমাধ্যমকর্মীদের প্রতিনিধিত্বশীল ও সবচেয়ে মর্যাদাশীল সংগঠন লন্ডন–বাংলা প্রেসক্লাবের নির্বাহী পরিষদের নির্বাচন ও দ্বিবার্ষিক সাধারণ সভার বর্ণাঢ্য আয়োজন।