লকডাউন শখের দশ-কাহন
সন্তু আমার ছোটবেলাকার বন্ধু, এখন নামকরা উকিল। আজ পর্যন্ত কখনো রান্নাঘর মাড়িয়েছে, এমনটা শুনিনি। মহা পেটুক। এটা বানাও, ওটা বানাও, ফরমাশ করেই খালাস। তাই ফোন করাতে যখন বলল, অমলেট বানাচ্ছি রে, পরে ফোন করছি, তখন বিস্ময়ে আকাশ ভেঙে পড়ল। রান্নার লোক ভেগেছে নাকি? গিন্নির অসুখ? না রে, ও সবকিছু নয়। এই লকডাউনে বাড়িতে থেকে থেকে নতুন একটা হবি হয়েছে, অমলেট বানানো। ইউটিউব থেকে এখনো পর্যন্ত সাত রকমের অমলেট বানাতে শিখেছি। আজ স্প্যানিশ অমলেট করছি।
লকডাউনে ঘরবন্দী অবস্থায় সারা বিশ্বে বহু মানুষ তাদের পুরোনো ধুলো চাপা পড়া হবি বা শখ, আবার নতুন করে ঝেড়েমুছে চর্চা করছেন। আবার অনেকে এ সুযোগে নতুন কোনো শখে মেতে উঠেছেন। মনোবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞদের মতে, এ আপৎকালীন অবস্থায় বাড়িতে বসে নিজের মনের মতো কোনো হবিতে কিছুটা সময় কাটানো মানসিক দিক থেকে খুবই কাম্য।
আসুন, দেখে নিই এ রকমই দশটা হবি, যেগুলো সহজেই অথবা একটু চেষ্টা করলেই বাড়িতে বসেই শুরু করে দেওয়া যায়। এর মধ্যে কিছু স্বাভাবিক। কিছু আবার বেশ অনন্য।
১. নতুন ভাষা শেখা
লকডাউনে পৃথিবীজুড়ে নতুন ভাষা শেখার বেশ একটা আগ্রহ দেখা গিয়েছে। স্প্যানিশ, ফারসি, ফ্রেঞ্চ, জাপানি...এক একটা ভাষা এক একটা নতুন সভ্যতার, নতুন সংস্কৃতির দিগন্ত উন্মোচন করে। ইন্টারনেট ও ই-শিক্ষার দৌলতে খুব সহজেই নিজের পছন্দমতো কোনো নতুন ভাষা শেখা শুরু করে দেওয়া যায়। ভাষা শেখার মধ্যে যেমন একটা উত্তেজনা আছে, তেমনি আবার তাতে মনের ব্যাপ্তিও ঘটে।
তাহলে, গুটেন টাগ। শুরু করে দেওয়া যাক।
২. নতুন বাজনা শেখা
নতুন কোনো বাদ্যযন্ত্র শেখার এ এক অনুপম সুযোগ। গিটার সহজেই উপলব্ধ ও বহু অনলাইন ক্লাসও আছে। তাই বোধ হয় এই লকডাউনে গিটার শেখার উৎসাহ সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে। তবে অন্য বাদ্যযন্ত্রও পিছিয়ে নেই। বাঁশি, ম্যান্ডোলিন, মাউথ অর্গ্যান, কাহোন আরও কত কী বাদ্যযন্ত্র, যা সহজেই কিনতে পাওয়া যায়। কিংবা হয়তো দেখবেন বাড়ির কোনো কোনায় পড়ে আছে। অনেকে এই সুযোগে বড় কি–বোর্ডও কিনে অনলাইনে শিখতে শুরু করে দিয়েছেন।
৩. ইনডোর গার্ডেনিং
ইনডোর গার্ডেনিং, অর্থাৎ ঘরের ভেতরে বাগান করার নতুন উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে। কোন গাছটা ঘরের মধ্যে রাখা যায়, মানায়ও বেশি, কোনটা আবার বারান্দায় ভালো। কীভাবে টবে মাটি বা জমি তৈরি করতে হয়। এ এক অন্য জগৎ। আর গাছগাছালির এই জগতে দিনের কিছুটা সময় কাটাতে পারলে তার মানসিক তৃপ্তিই আলাদা। হোক না তা ঘরের মধ্যে।
৪. মিউজিক ভিডিও
গান কে না ভালোবাসে? আর একটু–আধটু গান কে না গাইতে পারে? তবে যাঁরা সত্যিই গান গাইতে পারেন, তাঁদের তো পোয়াবারো। এখন বাড়িতে বসে নিজের গানের ভিডিও তৈরি করার অনেক সুবিধা হয়ে গেছে। ক্যারিওকি মিউজিকসহ বেশ কিছু মোবাইল-অ্যাপ এখন সহজেই পাওয়া যায়, যাতে নিজের পছন্দমতো গান গেয়ে অডিও বা ভিডিও রেকর্ডিং করা যায়। ইন্টারনেটে কিছু ভিডিও এডিটর আবার ফ্রিতে উপলব্ধ। ল্যাপটপে বা কম্পিউটারে ডাউনলোড করলেই হলো।
ব্যস, আর দেরি কিসের? বানিয়ে ফেলুন নিজের গানের মিউজিক ভিডিও।
৫. টাইম-ল্যাপ্স ফটোগ্রাফি
এ এক বিচিত্র হবি, যা লকডাউনের দৌলতে পুনর্জন্ম পেয়েছে। সাধারণ জীবনের ব্যস্ততার মধ্যে আমরা আমাদের খুব কাছের সৌন্দর্য কে, প্রকৃতির বৈভব কে, একরকম উপেক্ষাই করে থাকি। রবীন্দ্রনাথের লেখনীতে, ‘...দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া ...।’
জানলার সামনে পেঁপেগাছটায় একটা ছোট্ট কুঁড়ি-বীজ কীভাবে রোজ একটু একটু করে বাড়তে বাড়তে একটা পূর্ণ ফলের আকার নিচ্ছে—এখন ঘরবন্দী অবস্থায় এ রকম অনেক কিছু আমাদের চোখে ধরা পড়তে পারে, শুধু একটু মনের নজর দরকার। বাড়ির মধ্যে, বারান্দায় বা সামনের গাছটায়, একটা ফুল বা পাতা রোজ কীভাবে একটু একটু করে বেড়ে ১৫ দিনে বা এক মাসে পূর্ণ রূপে প্রকাশ পেল, মানিপ্ল্যান্টের শিকড়টা রোজ একটু একটু করে কীভাবে কাঠিটাকে আঁকড়ে ধরছে। রোজের সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র রূপান্তরকে ফটোগ্রাফিতে লিপিবদ্ধ করাই টাইম-ল্যাপ্স ফটোগ্রাফি। ভেবে দেখুন, যেকোনো সাধারণ মোবাইল ফোনের ক্যামেরা দিয়ে যে কেউ এটাকে নিজের হবি করতে পারেন।
৬. নতুন বিষয় শেখা
আমাদের অনেকের এই আক্ষেপ থেকে যায় যে যদিও ভালো ছবি আঁকতে পারি না, কিন্তু কোনো শিল্পকর্মের মর্ম যদি একটু গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারতাম। কিংবা বিভিন্ন স্থাপত্য ও তার বিশেষত্বগুলো যদি বুঝতে পারতাম—কোনটা বারোখ, কোনটা রেনেসাঁস? লকডাউনে বাড়িতে একটু বাড়তি সময় পাওয়ার সুযোগ নিয়ে অনেকে এই মুশকিলের আসান করছেন। এখন এই ধরনের বহু চিত্তাকর্ষক বিষয় যেমন আর্ট হিস্ট্রি বা আর্কিটেকচার নিয়ে অনেক সংক্ষিপ্ত এপ্রিসিয়েশন কোর্স ইন্টারনেটের মাধ্যমে করা যায়। পৃথিবীব্যাপী অনেক নামী ইউনিভার্সিটি এ প্রকারের অনলাইন কোর্স চালু করেছে। তার মধ্যে বেশ কিছু আবার ফ্রিতে। আপনার যে বিষয়ে আগ্রহ, ইন্টারনেটে খুঁজে দেখুন, কোনো না কোনো কোর্স পেয়ে যাবেন।
৭. অনলাইন নাটক
আপনি কি শেক্সপিয়ার প্রেমী? বাড়িতে থেকেই রোমিও বা জুলিয়েটের অভিনয় করতে চান? তার আর সমস্যা নেই। অনলাইন নাটকের গোষ্ঠী পেয়ে যাবেন। তাদের অনেকেই প্রতি উইকেন্ডে জুম-এর মাধ্যমে অনলাইন নাটক মঞ্চস্থ করেন। সেখানে রোমিও হয়তো ব্রিসবেনে আর জুলিয়েট বরিশালে। তাতে ক্ষতি কি? আর পছন্দমতো নাট্যগোষ্ঠী খুঁজে পাচ্ছেন না? তাহলে নিজেই একটা অনলাইন গোষ্ঠী শুরু করে দিন না। দেখবেন অনেক নাটকপ্রেমী সেখানে যোগ দিচ্ছেন।
৮. রকমারি হস্তশিল্প
যাঁরা শিল্পী তাঁরা তো পেইন্টিং, ভাস্কর্য এসব দৈনন্দিন জীবনেই করে থাকেন। কিন্তু কর্মজীবনে যাঁরা শিল্পী নন, এমন অনেকেই এই লকডাউনের সময় কোনো বিশেষ শিল্পকর্মকে হবি করে ফেলেছেন। জুয়েলারি ডিজাইন এ রকমই এক আকৃষ্ট শখ, যা এ লকডাউনে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। অনেকে আবার ক্যান্ডেল অর্থাৎ মোমবাতি, ডিজাইনের দিকে ঝুঁকেছেন। ক্যালিগ্রাফি ও অরিগ্যামিও অনেকের মন কাড়ছে। লক্ষণীয়, এ সব কটি শখেই নিজের হাতে করে কিছু সৃষ্টি করার আনন্দ আছে।
এখনো, এ প্রযুক্তির যুগেও হাতের আঙুলগুলো শুধু মোবাইল-স্ক্রিন আর ল্যাপটপের কি–বোর্ডে সন্তুষ্ট নয়। তারা রঙের তুলি ধরতে চায়, চায় কুমোরের মাটির ধূসর স্পর্শ।
৯. অনলাইন হবি ক্লাব
ভৌগোলিক কুইজ থেকে শুরু করে রুমির কবিতা, এমন কোনো বিষয় নেই যার অনলাইন হবি ক্লাব নেই। ইজিপ্টোলজি? পরিবেশদূষণ? মেরিন বায়োলজি? সাইক্লিং? পৃথিবীর কোনো না কোনো প্রান্তে পাওয়া যাবে একাধিক অনলাইন ক্লাব। কেউ প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় জমায়েত হয়, কেউ বা মাসে একবার। কোথাও গভীর আলোচনা হয়, আবার কোনো ক্লাব চলে হালকা মেজাজে। তা সে যেভাবেই চলুক, যেখানে শখের মিল আছে সেই রকম ১০ জনের সঙ্গে সেই প্রসঙ্গে আলোচনা করে কিছুটা সময় কাটাতে বেশ ভালো লাগে। আর সেই বিষয়ে নতুন তথ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি জানাটা তো উপরি পাওনা।
১০. রোজনামচার ডায়েরি
নিজের সঙ্গে সময় কাটানোর এমন সুযোগ আগে কখনো এসেছে কি না, জানি না। এলেও টানা এত দিন ধরে নয়। তাই অনেকেই এর সদ্ব্যবহার করে রোজ ডায়েরি লিখতে শুরু করেছেন। এ লেখা, এই মন-মন্থন একান্তই নিজের। এ যেন নিজেকে নতুন করে জানা। হোক না শুধু রোজের কিছু সামান্য কথা লেখা। কিংবা নতুন আলেখে, নতুন সংজ্ঞায় চারদিকের সমাজের সঙ্গে, তার ছোট-বড় ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নিজের অবস্থান বিবেচনা করা।
একান্তে বসে রোজের এই ডায়েরি লেখা জীবনের এক সমান্তরাল যাত্রার মতো। যাঁরা ডায়েরি লেখেন তাঁরা জানেন, লিখতে গিয়ে কখন কোন বাঁকে কী চমক আসে তা কেউ বলতে পারে না।
এ তো গেল ১০ রকমের শখের কথা। এ প্রকার শখ আরও অনেক আছে, যা লকডাউনের সময় বাড়িতে থেকেই করা যায়। আপনার যে রকম শখ পছন্দ, বেছে নিন। জীবনের এই এক নতুন পাতায়, সময়টা ভালোই কাটবে।
*লেখক: আশীষ দত্ত, সফটওয়্যার উদ্যোক্তা ও ফ্রিল্যান্স লেখক, ভারতের বেঙ্গালুরু