রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কি আটকে গেল?
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার একটি টিভি চ্যানেল সি প্লাস-এ দেখলাম, পাঁচ হাজার টাকা যৌতুকের জন্য রোহিঙ্গা স্বামী কিশোরী বউয়ের দুই পা কেটে ফেলেছে। একটা পা হাঁটুর নিচ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, আরেকটি পা ঝুলে আছে। ডাক্তার বলছেন, সেটিও কেটে ফেলতে হবে। এই হলো বর্তমানের রোহিঙ্গাদের অবস্থা। রোহিঙ্গাদের নিয়ে দেশে-বিদেশে লেখালেখিসহ নানা সেমিনার হচ্ছে। কিন্তু এদের ফেরত পাঠানো যাচ্ছে না।
আরও শুনেছি, যারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে গৃহকর্মীর কাজ করছে, তাদের সঙ্গেও নানা রকম দেশীয় অস্ত্র যেমন দা, ছুরি জাতীয় ধারালো অস্ত্র ছাড়াও ছোটখাটো অস্ত্র আছে। নিজেদের জীবন রক্ষা করার তারা এসব অস্ত্র বানিয়েছে। এখনো তারা এসব লুকিয়ে বহন করছে। চট্টগ্রামে যেহেতু আমার জীবনের অনেকটা সময় কেটেছে, তাই শুরু থেকেই রোহিঙ্গা ইস্যু আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। কুতুপালং-এর এত সুন্দর পাহাড় ধ্বংস হয়ে যাক আমি চাইনি। পরিচিত অনেকেরই জমি উঠান এখন এদের তাঁবুর দখলে। যার জন্য স্থানীয়েরা কোনো রকম সরকারি-বেসরকারি কোনো সাহায্য সহযোগিতা পান না। শুধু আশ্বাস মিলে ওরা ফিরে যাবে। রোহিঙ্গাদের পদচারণায় পুরো কক্সবাজার মানুষে গিজ গিজ করছে।
জন্মের পর থেকেই রোহিঙ্গারা নানা প্রতিকূল পরিবেশে বেড়ে ওঠা মানুষ, এরা এমন হবে সেটাই স্বাভাবিক। তবে আমাদের মানবিকতার বেদনা এখন সমাজের মূলস্রোতে মিলে গিয়ে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। দু-চারটি দুর্ঘটনাকে আমরা এখন বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে আখ্যায়িত করি। এতে করে কি সামাজিক দায়ভার এড়ানো সম্ভব হবে? এদের জন্য খাদ্য, চিকিৎসাসেবা দিতে বিশ্ব সংস্থা আগিয়ে এসেছে, কিন্তু এদের সামাজিক দেখভালের দায়ভার কার? এরা ফিরে যাবে না এবং নির্দিষ্ট শিবিরেও থাকবে না। তারা দেখতে আমাদের মতো এবং কথা বলে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায়। তাই খুব সহজেই মিশে গিয়ে চট্টগ্রামসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। রোহিঙ্গা সম্পর্কে এখন সবারই কম বেশি জানেন, তারপরও চলেন এদের সম্পর্কে একটু জেনে নিই।
রোহিঙ্গা হলো পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি রাষ্ট্রবিহীন ইন্দো-আরিয়ান জনগোষ্ঠী। ২০১৬-১৭ সালের মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের আগে আনুমানিক ১০ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমারে বসবাস করত। অধিকাংশ রোহিঙ্গা ইসলাম ধর্মের অনুসারী, কিছুসংখ্যক হিন্দু ধর্মের অনুসারীও রয়েছে। ২০১৩ সালে জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের বিশ্বের অন্যতম নিগৃহীত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী হিসেবে উল্লেখ করেছে। ১৯৮২ সালের বর্মিজ নাগরিকত্ব আইন অনুসারে তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্যমতে, ১৯৮২ সালের আইনে রোহিঙ্গাদের জাতীয়তা অর্জনের সম্ভাবনা কার্যকরভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। অস্টম শতাব্দী পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ইতিহাসের সন্ধান পাওয়া সত্ত্বেও মিয়ানমারের আইন এই সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে তাদের জাতীয় নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করছে। এ ছাড়া তাদের আন্দোলনের স্বাধীনতা, রাষ্ট্রীয় শিক্ষা ও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
রোহিঙ্গারা বলছে, তারা পশ্চিম মিয়ানমারে অনেক আগে থেকে বসবাস করে আসছে। তাদের বংশধরেরা প্রাক-ঔপনিবেশিক ও ঔপনিবেশিক আমল থেকে আরাকানের বাসিন্দা ছিল। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে নির্যাতন শুরুর আগ পর্যন্ত রোহিঙ্গারা আইনপ্রণেতা ও সংসদ সদস্য হিসেবে মিয়ানমারের সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। আগে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করলেও হঠাৎই মিয়ানমারের সরকারি মনোভাব বদলে যায় এবং রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারের অফিশিয়াল মন্তব্য হলো, তারা তাদের জাতীয় জনগোষ্ঠী নয় বরং তারা বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী। মিয়ানমারের সরকার তখন থেকে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার বন্ধ করে তাদের বাঙালি বলে সম্বোধন করে।
বাংলাদেশ বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে মানবিক কারণে। রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানের ক্ষেত্রে যে মূল চেতনাটি গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া সব রোহিঙ্গার রাখাইনে নিরাপদ প্রত্যাবাসন ও বসবাস নিশ্চিত করা। মিয়ানমার বলছে, তারা শুধু তাদেরই ফেরত নেবে যাদের কাছে আইডি কার্ড আছে এবং যারা স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে চাইবে। রোহিঙ্গারা তো শুধু জানটা হাতে নিয়ে আমাদের দেশে আসছে। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের কখনো আইডি কার্ড বা সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা দেয়নি।
রোহিঙ্গারা যে ধরনের বর্বরতার শিকার হয়ে বাংলাদেশে এসেছে, তাদের স্বেচ্ছায় দেশে ফেরা নিশ্চিত করা, তাদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনা সহজ কাজ নয়। স্থানীয়দের মতে জানা যায়, রোহিঙ্গা কোনো অবস্থাতেই ফিরে যেতে রাজি নয়।
রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরে যাওয়া শুরু হয়েও হলো না। প্রাথমিক উদ্যোগ পুরোপুরি ব্যর্থ বলা যায়। কিন্তু অনেক রোহিঙ্গাই মনে করেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে দেবে না৷ তাই দেশে ফেরার প্রশ্নে তারা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন৷ এক পক্ষ যেতে আগ্রহী হলেও অন্য পক্ষ যেতে চাইছে না৷ ফেরত যাওয়ার প্রশ্নে মিয়ানমার থেকে আসা উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দারা জানতে চায়, ফিরে গেলে ওদের কেন ওখানে নিয়ে ক্যাম্পে রাখা হবে? যে সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের হত্যা করেছে, তাদের কাছেই তারা আবার ফিরে যাবে না।
বর্তমানে রোহিঙ্গারা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে সাধারণ স্থানীয় মানুষের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। চট্টগ্রামসহ অনেক জায়গায় রোহিঙ্গা গৃহকর্মীর দেখা মেলে। শিল্প কারখানায় কম বেতনভুক্তির তালিকা খুঁজলে দেখা যাবে, এসব কর্মী রোহিঙ্গা। দেশের সুযোগ সন্ধানী ব্যবসায়ীরা সরকারি ঘোষণার বাড়তি বেতন দিতে হবে বলে দেশের মানুষকে বঞ্চিত করে কম বেতনে এদের কাজে নিচ্ছেন।
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিবন্ধিত ক্যাম্প কুতুপালং ও নয়াপড়। সরকারি হিসাব মতে, এই দুটি ক্যাম্পে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বসবাস করছে। এ ছাড়া লেদা ও কুতুপালং এলাকায় আরও কয়েকটি অনিবন্ধিত ক্যাম্প আছে বলে জানা যায়। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ এলাকাতেই মূলত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসী’ কার্যকলাপের অভিযোগ করছে মিয়ানমার। অন্যদিকে রাখাইন রাজ্যে ‘আকামুল মুজাহিদীন’ নামে নতুন একটি জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতার খবরও পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া সেখানে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন, আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স, আরাকান রিপাবলিকান আর্মিসহ নানা সশস্ত্র সংগঠনের নাম শোনা যায়। রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক হয়ে আমাদের মতো দেশ সারা দুনিয়ায় সাড়া ফেলে দিয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে মানবতার বড় উদাহরণ ।
শুরুতে মানবিক সংকট মনে হলেও বর্তমানে এটা বড় ভূ-রাজনৈতিক সংকটে রূপ নিচ্ছে। আশ্রয় দেওয়ার কারণে বাংলাদেশকে যেন উল্টো ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে বলে অনেকেই মনে করছেন। মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় যেভাবে কাঁটাতারের বেড়া, পরিখা ইত্যাদি নির্মাণ করছে তাতে মনে হচ্ছে তারা শরণার্থীদের দেশে ফেরত যাওয়ার সব পথ বন্ধ করে দিতে চাইছে।
কক্সবাজারের স্থানীয়রা মনে করছেন তাদের জীবনের ওপরে জেঁকে বসেছে রোহিঙ্গারা। তাদের স্থানীয় সমাজের কাঠামোটাই বদলে দিচ্ছে তারা। উখিয়া ও টেকনাফে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর তুলনায় রোহিঙ্গাদের সংখ্যা এখন দ্বিগুণ প্রায়। কক্সবাজার, চট্টগ্রামসহ দেশের মোটামুটি সব জায়গায় এরা মাদকসহ নানা অপরাধে এরা জড়িয়ে পড়ছে। খুন, মাদক, ধর্ষণ, অস্ত্র প্রদর্শনসহ রোহিঙ্গাদের নানা অপরাধে শঙ্কিত স্থানীয়রাও। এরা এখন দেশের গোদের ওপর বিষফোড়া হয়ে উঠেছে।
এই ৮-৯ লাখ মানুষের চাপের প্রভাব স্থানীয়ভাবে এখনই দেখা যাচ্ছে। কক্সবাজার এলাকায় নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। তাদের থাকার জন্য বন ও পাহাড় কাটা হচ্ছে। স্থানীয় অধিবাসীদের চেয়ে এখন রোহিঙ্গা বেশি। আমরা বিষয়টি মানবিকভাবেই দেখছি৷ কিন্তু দীর্ঘ অবস্থানের কারণে এসব বিষয়ই সংকটের সৃষ্টি করতে পারে ।
দেশে ১৫ বছরের বেশি বয়সী কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ৯১ লাখ। এর মধ্যে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৮০ হাজার। আর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এই সংখ্যা ছিল ২৬ লাখ। এ ক্ষেত্রে এক বছরে বেকার বেড়েছে ৮০ হাজার। উচ্চ শিক্ষিতের মধ্যে বেকারত্বের হার বেশি। এই যদি হয় আমার নিজের দেশের মানুষের অবস্থা, তাহলে আমরা যে মানবিক দায়ভার নিলাম তার কি হবে? পৃথিবীর খাতায় আমরা বাহবা পাব। নিজের শিক্ষিত ছেলের পকেটে হতাশা। আমেরিকার সীমান্তে আমার ছেলেদের লাশ পাওয়া যায়।
উন্নত দেশে পাড়ি জমানোর আশায় নানান দেশের কারাগারে আটকে আছে আমাদেরই সন্তানেরা। তাহলে যারা খাবার-দাবার নিয়ে আসছেন তাদের কি অনুরোধ করা যেতে পারে যে, আমরা তো নিজেদের না দিয়ে আর ভাগ করে খেতে পারছি না। কারও কোনো অনুরোধই যেহেতু মিয়ানমার শুনছে না। আমরা এখন মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে গেছি। তাই আমেরিকা ডিবি থেকে আমাদের নাম আগেই বাদ দিয়ে দিয়েছে ।
সত্যি আর ‘ভিক্ষা চাই না, কুত্তা সামলান’ অবস্থায় পড়েছে দেশ। রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমাদের বিশ্ব দরবারে জোরালোভাবে কথা বলতে হবে। চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের উচিত মিয়ানমারের লিখিত চুক্তির মাধ্যমে অতিসত্বর রোহিঙ্গা হস্তান্তর শুরু করা। দেশের ভেতরে এরা যেন এক জায়গায় থাকে, সে জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া।