রোমাঞ্চকর এক ভ্রমণ অভিজ্ঞতা

ত্রেন্তো শহর
ত্রেন্তো শহর

আমি তখন পিএইচডি করছি ইংল্যান্ডে। ২০১১ সালের কথা। আমার ছেলের বয়স দুই। এক বিজ্ঞান সম্মেলনে একটা পেপার পড়ার জন্য আমি যাচ্ছি ইতালির ত্রেন্তো (Trento) শহরে। যতবারই একা একা ইউরোপের নন ইংলিশ স্পিকিং দেশে যেতে হয় কেমন একটা অজানা ভয় কাজ করে মনে। যদি হারিয়ে যাই। যদি না বুঝি কোথায় যাচ্ছি। কারণ পথ নির্দেশনা সব থাকে অচেনা ভাষায়।
সেবার যাওয়ার সময় কপাল গুনে আগের পরিচিত এক দল সুইডিশ গবেষকদের পেয়ে যাই ইতালির বিমানবন্দরে। তারাও একই সম্মেলনে যাচ্ছেন। দলের সঙ্গে আমি চোখ বন্ধ করে নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে যাই। একা একা পথের হিজিবিজি লেখা বুঝে যাওয়ার টেনশন ছিল না।
অপরূপ ত্রেন্তোর মনোরম পাহাড় দেখে, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে হেঁটে, নীরস কিছু কটকটে গবেষণার বিষয়ে আলাপ করে নির্বিঘ্নে কটা দিন পার হয়ে যায়। ফেরার আগের দিন ভাবছি ভেনিস দেখে গেলে মন্দ হয় না। মাত্র তো কয়টা ঘণ্টার ব্যাপার। ফোন করে বাচ্চার বাবাকে বললাম কি করব, যাব কি না। সে বলল, অবশ্যই যাও। রাতেই পরিকল্পনা ঠিক করে রিসেপশনে ভোর ৫টায় আমার জন্য ট্যাক্সি ডাকার কথা বলে ঘুমাতে গেলাম। ভোরে দুরুদুরু বুকে রওনা দিলাম অচেনা গন্তব্যে একা।

ভেনিস
ভেনিস


ভেরোনা স্টেশন থেকে ঠিকমতোই ধরতে পারলাম ভেনিসের দোতলা ট্রেনটি। পথে কিছু পর্যটক পেলাম যারা ইংরেজি জানে এবং তারাও একই জায়গায় যাবেন। মনের আনন্দে তাদের সঙ্গে চলে গেলাম ভেনিসে। স্টোরে লাগেজ রেখে পানি বাসে (water bus) উঠলাম। কিন্তু একি, মনে হচ্ছে বন্যা কবলিত ঢাকা শহর। কিছু দূর পর পানির রং গাঢ় নীলচে সবুজ আর দুর্গন্ধময় হয়ে গেল! পানি বাসের সবাই নাক চেপে বসলাম। বারবার মনে হচ্ছিল কেন আসলাম ঘোড়ার ডিমের পানি দেখতে। আমার বাচ্চাটার কথাও মনে পড়ছে। কত দিন দেখি না, কী যে করছে। আজকেই ফিরছি, কখন যে ফিরব। মারকোপলোতে মানুষের ঢল নেমেছে। কিন্তু আমার কিছুই আর দেখতে ইচ্ছা করছে না। ১০ মিনিট কাটিয়ে ফিরতি পানি বাস ধরলাম। পথে দেখি সারি সারি পানি ট্যাক্সিতে কিছু মানুষ অহমিকার ভঙ্গিতে যাচ্ছেন। তাদের তাকানোর ভঙ্গিমায় মনে হচ্ছে, তারা না জানি কোনো রাজকন্যা বা রাজপুত্র। বাসে বসা গরিব প্রজাদের দিকে অবহেলার দৃষ্টি ছুড়ে দিতে দিতে যাচ্ছেন। চারপাশের মানুষ ​ও হই-হল্লা কিছুই আমাকে স্পর্শ করছে না আর। ছেলের হাসি মুখটা দেখার জন্য মন ছটফট করছে। পরিকল্পনা করা সময়ের এক ঘণ্টা আগেই রওনা দিলাম। আহ কী যে আনন্দ লাগছে, একটু পরই ফিরব নিজের বাসায়।

ভেনিস
ভেনিস

ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছি কখন দেখব ভেরোনা স্টেশন। একসময় দেখলাম সেই কাঙ্ক্ষিত ভেরোনা লেখা স্টেশনের নাম। ট্রেন থেকে দ্রুত নেমে লাগেজ স্টোর থেকে লাগেজ নিলাম। আর সঙ্গে সঙ্গেই ট্রেন ছেড়ে দিল। ট্রেন যাওয়ার পর স্টেশনটা কেমন যেন লাগছে। গেলাম এত বড় স্টেশন থেকে আর এটা এত ছোট! আর কেউ নামল না। ভয়ে মানুষের ঘাম ঝরে আর শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায় কথাগুলি এত দিন শুধু বইতে পড়েছি। সেদিন এই প্রথম সেটা বাস্তবে অনুভব করলাম। দরদর করে ঘামছি আর চোখের পানি কষ্ট করে আটকাচ্ছি।
এমন সময় সেখানে একজন ২০-২২ বছরের মেয়েকে দেখে বললাম, আমি ভেরোনা বিমানবন্দরে যাব। গোটা এলাকায় আর কোনো মানুষ নাই। ওই মেয়েটা আর আমি ছাড়া। মেয়েটা কী বলল কিছু বুঝলাম না। শুধু একটা শব্দ বুঝলাম ফ্রেঞ্চ? আমি দুই দিকে মাথা নাড়লাম। মানে আমি ফ্রেঞ্চ বুঝি না। ইঙ্গিতে হাত দিয়ে প্লেনের মতো ভঙ্গি করে বোঝালাম যে আমাকে ফ্লাই করতে হবে। দুই ঘণ্টা পর আমার ফ্লাইট। মেয়েটা হাত দিয়ে ইশারা করল তাকে অনুসরণ করার জন্য। আমি টেনশনে ঘামতে ঘামতে তার পিছু রওনা দিলাম।

ত্রেন্তো শহর
ত্রেন্তো শহর


নির্জন অলিগলি দিয়ে আমরা দুজন হেঁটে যাচ্ছি তো যাচ্ছি। পথ আর ফুরায় না। হঠাৎ​ অজানা একটা ভয় আমাকে পেয়ে বসল। মেয়েটা আসলে আমাকে কোথায় নিচ্ছে! কোথাও কেউ নেই কেন! একটু পর মেয়েটা ফোন করে কাউকে ডাকল। দূরে একটা ছেলেকে আসতে দেখতে পেলাম। ইতালিতে আসার আগে সবার বলা অনেক সাবধান বাণী মনে পড়তে লাগল। আমি মোটামুটি নিশ্চিত হলাম এবার আমাকে হাইজ্যাক করা হবে। হায়রে, আমি কেমন করে বাসায় ফিরব, কোনো দিন কি ফিরতে পারব।
মেয়েটা ছেলেটার সঙ্গে কথা বলার জন্য একটু দ্রুত এগিয়ে যায় আর আমি একটু পিছিয়ে পড়েছি। ভালো করে চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম একটু দূরে কিছু মানুষ দেখা যাচ্ছে। আমি মেয়েটাকে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে দ্রুত মানুষগুলোর দিকে খটখটিয়ে রওনা দিলাম। মেয়েটা হয়তো ভালোই ছিল। ভাষা না জানার দুর্বলতা আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। দূরের মানুষগুলি বাসের জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের একজন ভারতীয় নারী ছিলেন। তাকে আমার দুঃখের কথা খুলে বললে জানালেন ভেরোনা নামের দুটি স্টেশন আছে। একটা Verona Something অপরটা only Verona. আমি শুধু প্রথম শব্দটা পড়ে ভুল জায়গায় নেমে পড়েছি। ভাগ্যক্রমে ওখান থেকে ভেরোনার বাস পাওয়া যাবে।

ত্রেন্তো শহর
ত্রেন্তো শহর

শেষ পর্যন্ত বাসে উঠলাম। কিন্তু টেনশনে মুখ শুকিয়ে আছে। চোখের পানি কষ্ট করে আটকে আছি। আমার পাশে দাঁড়ানো ছেলেটা কী এক গল্প জুড়ে দিল। আমি কিছুই বুঝছি না। মনে হলো সে বাস চালকের সঙ্গে আমাকে নিয়ে রসিকতা করছে। তাদের ভঙ্গি দেখে তাই মনে হলো। আমি শুধু জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছি কখন ভেরোনা পৌঁছাব। প্লেন মনে হয় মিসই হবে। আমার পকেটে আছে আর ৪০ ইউরো। কীভাবে ফিরব মিস হলে! ভেরোনা পৌঁছানোর পরও টেনশন যায় না। তখনো বিমানবন্দর অনেক দূর। এই সময় হঠাৎ আমার সম্মেলনের কয়েকজনকে দেখে আমি দৌড়ে গিয়ে তাদের মধ্যের এক মেয়েকে জড়িয়ে ধরলাম। মেয়েটা অবাক! ওই মেয়ে তো আর জানে না কীসের মধ্যে দিয়ে এতক্ষণ আমি গেছি। শেষ পর্যন্ত আমি তাদের সঙ্গে ট্যাক্সিতে করে বিমানবন্দরে পৌঁছে সর্বশেষ যাত্রী হিসেবে বিমানে উঠেছি। ওই দিনের কথা মনে হলে আজও আমার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়।
*লেখিকা ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজের রিসার্চ ফেলো।