রূপকথার মতো ভালোবাসা

ওদের যখন বিয়ে হয়, ছেলেটির বয়স বোধ হয় ২৩-২৪। আর মেয়েটি? বড়জোর ১৯, মেরে কেটে ২০। মায়ের ছোট ছেলে বিদেশে গেছে, কি-না-কি হয়, সেই চিন্তায় মা জোর করে তাকে বিয়ে করালেন। ছেলে–মেয়ে না দেখেই বিয়ে, টেলিফোনে। শাশুড়ির হাত ধরে অজানা দেশে একটা অজানা মানুষের সঙ্গে সংসার করতে চলে এল বাচ্চা মেয়েটি। জীবনের জটিলতা সে কিছুই জানে না। তাই বুঝি এত সাহস। অবাক কাণ্ড, পুতুলের মতো মেয়েটির সঙ্গে কিশোর চেহারার ছেলেটির খুব ভাব হয়ে গেল। ওদেরকে দেখলে কেন যেন স্কুল পালানো কিশোর-কিশোরী মনে হতো।
সুখের সময় নাকি তাড়াতাড়ি কেটে যায়। দেখতে দেখতে একটি দুটি করে কেটে গেছে ২৪ বছর। পাগল ছেলেটার মন খুব নরম। মেয়েটাকে চোখের আড়াল করতে পারে না। হয়তো রাত দশটা, বাচ্চার দুধ ফুরিয়ে গেছে। পুরো পরিবার নিয়ে চলল দুধ কিনতে। মেয়েটা কপট বিরক্তি দেখায়। বড় ছেলে তো এখন বেশ বড়, পড়ালেখা ফেলে মা-বাবার সঙ্গে সব জায়গায় যেতে বিরক্ত হয়। মেয়ে দুটো ছোট, আর ছোট ছেলেটা তো একদমই ছোট। কোনো মানে আছে, সবাইকে এত টানাহেঁচড়া করার?
সেই ছেলেটা আজও মেয়েটার হাত ধরে শুয়ে আছে, হাসপাতালের বিছানায়। মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটার হাত ধরে একটু ঝুঁকে, যদি ও কোনো শব্দ করে। যদিও জানে সেই আশা আর নেই। দুই মাস আগে যখন স্টেজ ফোর ক্যানসার ধরা পড়েছিল, মেয়েটার পৃথিবী থেমে গিয়েছিল। কিছুদিনের মধ্যেই ও জেনে গিয়েছিল, আশা খুব কম, এমনকি সময়ও। সেই থেকে পাথর হয়ে গেছে মেয়েটা, আর কাঁদে না সে। কেন যেন অবুঝ ছেলেটা জেদ ধরেছিল। আমি লড়াই করব, আমার শেষ বিন্দু শক্তি দিয়ে লড়াই করব। তার চোখে ছিল যোদ্ধার আগুন। সেই আগুনের পেছনে ছিল আকুতি শুধু তুমি আমার পাশে থেকো, তাহলেই পারব। শুধু সেই মেয়েটি দেখেছিল সেই আকুতি। যখনই চিকিৎসা চলেছে, দুই মাস ছেলেটি মেয়েটির হাত ছাড়েনি। হাতে হাতে প্রবাহিত হতো ভালোবাসা, বেঁচে থাকার সঞ্জীবনী।
দুই দিন ওর কথা বন্ধ। এই দুই দিন শুধু হাতের তালুতে বন্দী হাতের চাপেই বুঝিয়েছে, বেঁচে আছি এখনো, লড়াই থামেনি। বুঝিয়েছে অনেক কষ্ট, সহ্য করা যায় না আর। পাথর মেয়েটির বুক দুমড়ে যায়, কিন্তু চোখ শুকনা। সে যে সহযোদ্ধা। কিন্তু...যোদ্ধার হাতের চাপে জোর কমে আসছে ক্রমশ। চোখের মণি দুটোতে এখন আর ভাষা নেই। অনেক কষ্ট করে ধরে রেখেছে প্রাণ বায়ুটুকু। মেয়েটি আর পারছে না ছেলেটির এই কষ্ট দেখতে। আস্তে করে ওর কানের কাছে মুখ নেয়, যেন শুধু ওই শুনতে পায়, তুমি এবার নিশ্চিন্তে যেতে পার। আমাদের জন্য ভেব না, আমরা ভালো থাকব। ব্যাস, এইটুকুর জন্যই অপেক্ষা করেছিল ছেলেটি। চলে গেল সে, ২৪ বছরের রূপকথার মতো ভালোবাসাকে পেছনে ফেলে।
৭ আগস্ট ২০১৬