রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্বরাজনীতির নিরপেক্ষতা বিতর্কিত
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের যুদ্ধের অন্যতম দাবি হলো ইউক্রেনীয় নিরপেক্ষতা। ইতিমধ্যে সুইজারল্যান্ড তার নিজস্ব নিরপেক্ষতার ব্যাখ্যা পরিবর্তন করেছে। সুইডেন ও তাইওয়ানের মতো দেশগুলোও আবার তাদের ভিন্ন নীতি পর্যালোচনা করে বলছে, ‘আমরা অন্যের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপকে কঠিন নীতি দ্বারা পরীক্ষা করি।’ পুতিন ইউক্রেনে তাঁর হামলার কারণ হিসেবে ইউক্রেনের নিরপেক্ষ না থাকাকে দায়ী করেছেন। ইউক্রেন পশ্চিমা প্রতিরক্ষা জোট ন্যাটো বা ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের অধিকার পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধ করতে ইচ্ছুক নয়। হামলার মাত্রা নিরপেক্ষ সুইজারল্যান্ডকে নিরপেক্ষতার নিজস্ব ধারণা পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করেছে, যা ইউরোপে শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য সহায়ক একটি বিদেশি নীতি হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে বহাল আছে। অনুরূপ নীতির পথে হাঁটতে সুইডেনসহ নিরপেক্ষ দেশগুলোও অনেকটাই বাধ্য হচ্ছে।
নিরপেক্ষতা বিংশ শতাব্দীর অনেক রাষ্ট্রের জন্য একটি অনুপ্রেরণা ও আদর্শ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনেক দেশ তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে নিরপেক্ষতার উপাদানকে সমর্থন করে। কারণ, নিরপেক্ষতা সাধারণত শান্তি ও সমৃদ্ধির সঙ্গে জড়িত। সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, সুইডেন, ফিনল্যান্ড ও আইসল্যান্ড অন্যতম। কিন্তু ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর অনেক দেশ আন্তর্জাতিক ও দেশীয়ভাবে তাদের নিরপেক্ষতা ত্যাগ করেছে বলে মনে হচ্ছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা গ্রহণে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে যোগ দিয়ে সুইজারল্যান্ড ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে, যা এত সুদূরপ্রসারী ও কঠিন, তা অর্থনৈতিক যুদ্ধের সমতুল্য।
সুইডেন, যেটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সুইজারল্যান্ডের মতো বিতর্কিত নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছিল, ইউক্রেনের জন্য সরাসরি সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেই পথেই এগিয়ে গেছে।
ইইউ সদস্য সুইডেনে জাতীয় রক্ষণশীল দল সুইডিশ ডেমোক্রেটিক পূর্ববর্তী নীতি থেকে আমূল প্রস্থান ও ন্যাটো সামরিক জোটে যোগদানের দাবি জানিয়েছে। কোনো প্রশ্ন নেই, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন কাছাকাছি নর্ডিক দেশগুলোর (ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, নরওয়ে ও সুইডেন) নিরাপত্তার হিসাব বদলে দিয়েছে। বিপরীতে ডানপন্থী সুইস পিপলস পার্টি রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইইউ নিষেধাজ্ঞা গ্রহণের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেছে, এটিকে নিরপেক্ষতার বলিদান হিসেবে বর্ণনা করেছে দলটি। ডানপন্থী সুইস পিপলস পার্টি জাতিসংঘের সুইস সদস্য পদকে নিরপেক্ষতার সঙ্গে বেমানান বলে মনে করে এবং এখন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সুইজারল্যান্ডের অস্থায়ী আসন গ্রহণের বিরোধিতাকারী এই দলের মনোভাব মোটেও আশ্চর্যজনক নয়। নিরপেক্ষতাকে নিষেধাজ্ঞার প্রশ্ন দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা যায় না। এটি আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রেও নয় বা একটি নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের জন্য রাজনৈতিক শর্তও নয়। হেগ কনভেনশন স্পষ্টভাবে নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোকে অস্ত্র আমদানি ও রপ্তানি করার অনুমতি দেয়, তা নির্বিশেষে একটি দেশ যুদ্ধে থাকুক বা না থাকুক। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিশ্বের শক্তিধর মোড়লদের দ্বারা সম্মত হওয়া বহুপক্ষীয় চুক্তিগুলো আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে এখনো পালিত হয়, যদিও সেই চুক্তির সম্মান কে দেখাচ্ছে বা দেখাচ্ছে না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে, নিরপেক্ষতা গণতন্ত্রের সমসাময়িক। নিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র—উভয়ই প্রাচীন গ্রিসের শহর-রাজ্যে উদ্ভাবিত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়সহ ১৮১৫ সাল থেকে সুইজারল্যান্ড একটি নিরপেক্ষ দেশ। ১৮৩৪ সালে সুইডেন নিজেকে একটি নিরপেক্ষ রাষ্ট্র ঘোষণা করে।
আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে নিরপেক্ষতা মানে, একটি দেশ একটি নির্দিষ্ট সংঘাতে একটি যুদ্ধবাজ পক্ষের পক্ষ নেবে না এবং ভবিষ্যতের যুদ্ধ থেকে দূরে থাকবে। যে রাষ্ট্রগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে সামরিক জোট থেকে বেরিয়ে আসে, তাদের নিরপেক্ষ হিসেবে গণ্য করা হয়। সারা বিশ্বে প্রায় দুই ডজন দেশকে নিরপেক্ষ বিবেচনা করা হয়, প্রাথমিকভাবে ইউরোপ ও এশিয়ায়। তবে শুধু তা নয়, লাতিন আমেরিকায় কোস্টারিকা ১৯৮৩ সালে তার স্থায়ী, সক্রিয় ও নিরস্ত্র নিরপেক্ষতা ঘোষণা করেছে। আফ্রিকান দেশ ঘানা ও রুয়ান্ডা সম্প্রতি নিরপেক্ষ ব্যান্ডওয়াগনের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। নিরপেক্ষতা বেশ কয়েকটি দেশের জন্য একটি সাফল্যের গল্প। যদি আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ও ফিনল্যান্ডকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে গণনা করা হয়, সে ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের পর থেকে তাদের আর নিরপেক্ষ বলা যায় না। কিন্তু এমনও উদাহরণ রয়েছে, যেখানে নিরপেক্ষতা একটি রাষ্ট্রকে আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। যেমন বেলজিয়াম, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি আক্রমণ করেছিল, অথবা ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় কম্বোডিয়া, যা উত্তর কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র—উভয়ই আক্রমণ করেছিল।
নিরপেক্ষতা তখনই সফল হয়, যখন এটি হয় সব পক্ষের স্বার্থরক্ষা করে, অথবা অন্ততপক্ষে তাদের কারও জন্য অস্তিত্বের হুমকি হিসেবে উপস্থিত হয় না। বিংশ দশকের আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংঘর্ষের সহিংসতা নিরপেক্ষতার নতুন রূপের জন্ম দিয়েছে। তাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ অঞ্চলগুলোর জন্য উদ্ভাবনী সমাধান রয়েছে, যেমন সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের মধ্যে আল্যান্ডের বাল্টিক দ্বীপপুঞ্জ (১৯২০) বা ১৯২৫ সালের স্পিটসবার্গেন চুক্তি, যা আজ পর্যন্ত ভালবার্ডের আর্কটিক দ্বীপপুঞ্জের শান্তিকে সুরক্ষিত করে। ১৯৫৯ সালে, আন্টার্কটিক চুক্তি একটি সমগ্র মহাদেশকে ‘নিরপেক্ষ’ করতে পরিচালিত করেছিল।
নিরপেক্ষতা বর্তমানে এশিয়ায় নিবিড় আলোচনার বিষয়। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ান নেশনস অ্যাসোসিয়েশন (আসিয়ান) ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশ তাইওয়ান—উভয়ই চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য নিরপেক্ষতার পথটি বিবেচনা করছে। যত দিন আন্তর্জাতিক সংঘাত আছে, নিরপেক্ষতার একটি ভবিষ্যৎ আছে। বড় প্রশ্ন হলো, কীভাবে আমরা শান্তির অগ্রগতিতে এটি প্রয়োগ করতে পারি।