রঞ্জুর ডায়েরি

(দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব)
পর্ব চার
ঢাকায় ফেরার পর থেকে রঞ্জুর কাছে তার বোনেরা সবাই একের পর এক কল করেই যাচ্ছিলেন। সবার কথা মোটামুটি একই, ‘তোর কারণে আজকে পরিবারে অশান্তি নেমে এসেছে। তোর কারণেই বড় ভাই রাগ করে বাড়ি থেকে চলে গেছেন। তুই যেভাবেই পারিস, যেখান থেকেই পারিস, বড়ভাইকে খুঁজে বের করে তার পা ধরে মাফ চাইবি এবং তাঁকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আসবি। ইত্যাদি।’
ফাতেমার কষ্ট, পরিবারের ভয় নিয়ে রঞ্জু কয়েক দিন ঘুমাতে পারেনি, খাওয়া-দাওয়াও করেনি ঠিকমতো, অফিসের কাজেও মনোযোগ দিতে পারছিল না পুরোপুরি। এর মধ্যেই দুটো ফোন কল আসল রঞ্জুর মোবাইলে। প্রথম কল করেছিলেন ফাতেমার মা। বলেছিলেন, ফাতেমার বাবা তাঁর মেয়ের বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন। পাত্র পক্ষকে তিনি কথা দিয়ে দিয়েছেন। এপ্রিল মাসের চার তারিখে বিয়ের দিন ধার্য করা হয়েছে। ফাতেমার মা ও দাদা মিলে অনেক চেষ্টা করেও ফাতেমার সঙ্গে রঞ্জুর সম্পর্কের কথা তার বাবাকে বোঝাতে পারেননি। এমনকি ধর্মীয় বিয়ের ব্যাপারটাও তিনি নিছক ছেলে খেলা বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। ফাতেমার বাবার এক কথা, ‘রঞ্জু, ফাতেমার সহপাঠী, কম বেতনে মাত্র নতুন একটি চাকরিতে যোগ দিয়েছে, প্রতিষ্ঠিত হতে অনেক সময় লাগবে। আর যে ছেলেকে আমি ঠিক করেছি, সে অলরেডি প্রতিষ্ঠিত, মোটা অঙ্কের বেতন পায়। বাবা হয়ে আমি আমার মেয়েকে একটা হতদরিদ্রের হাতে তুলে দিতে পারবে না। আর আমার সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ফাতেমা যদি ওই রঞ্জুর সঙ্গে সংসার করার স্বপ্ন দেখে, তাহলে বাবার নামের জায়গায় আমার নাম যেন ও আর কোনোদিনই ব্যবহার না করে।’
দ্বিতীয় ফোন কল করেছিলেন রঞ্জুর খালু। রঞ্জুর বড়ভাই চিটাগাংয়ে ছোট খালার বাসায় ছিলেন। রঞ্জু চিটাগাং গিয়ে বড়ভাইয়ের কাছে মাফ চাইতে হবে এবং প্রতিজ্ঞা করতে হবে ফাতেমার নাম সে আর কোনোদিনই মুখে আনবে না। শৈশব-কৈশোরের ভয়ার্ত শিক্ষার প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘আত্মসমর্পণ’। সেবারও তাই হয়েছিল। অসুস্থতার কথা বলে রঞ্জু অফিস থেকে তিন দিনের ছুটি নিয়ে যাত্রা করে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্য। বড়ভাই বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন, পারিবারিক শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু, রঞ্জু? দুঃখ, হতাশা আর ভয়ের অথই সাগরে ভাসছিল মুমূর্ষু অবস্থায়। দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায়, ফাতেমার বিয়ে হয়ে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করতে করতে এক সময় ভ্রম হয় রঞ্জুর। সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহের ওপর নাবিশ্বাস জন্মাতে থাকে তার মনে। ধর্ম-কর্মের প্রতি অনাগ্রহ চলে আসে, পারিবারিক বন্ধনের প্রতি অবহেলা জন্মাতে থাকে। একটা সময় এসে চাকরি পারমানেন্ট হয়ে যায়, বেতন বৃদ্ধি পায়। কিন্তু কোনো কিছুতেই তার আর মন বসে না।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তখন রঞ্জুকে কম সুদে ঋণ সাধে; ঋণ নেয়, টাকা উড়ায়, নষ্ট করে৷ তবুও কিছুতেই যেন আনন্দ নেই, প্রশান্তি নেই, ভালোবাসা নেই, কিচ্ছু নেই মনে হতে থাকে। একপর্যায়ে প্রায় দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার মত অবস্থায় এসে বন্ধুদের পরামর্শে চাকরি ছেড়ে, দেশ ছেড়ে, ইউরোপে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। দেশ ছাড়ার আগ মুহূর্তে নিজের বাড়িতে গিয়ে সবার সঙ্গে দেখা করে আসে এবং ঢাকায় ফেরার পথে ফাতেমাদের বাড়ির গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নীরবে কিছুক্ষণ। ওখানে দাঁড়িয়েও তখন আর কোনো অতীত স্মৃতি মনে করার ইচ্ছা হয়নি। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে আবার ফিরে এসেছিল ঢাকায়। ঋণের টাকা আর বন্ধুদের সহযোগিতায় গ্রিস-সাইপ্রাসের ভিসা জোগাড় করে যাত্রা করে ইউরোপের উদ্দেশ্যে। গ্রিস থেকে জার্মানি, জার্মানি থেকে ইতালি, ইতালি থেকে ফ্রান্স, ফ্রান্স থেকে নরওয়েতে এসে থিতু হয়।
নরওয়েতে এসে ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি সরকারি এইড নিয়ে ভর্তি হয় এমবিএতে। পড়াশোনার পাশাপাশি পার্টটাইম কাজ নেয় একটা পাকিস্তানি গ্রোসারি শপে। এমবিএ পরীক্ষা শেষ করে অপেক্ষা করতে থাকে সমাবর্তনের। জীবনের প্রথম সমাবর্তন দিন থেকে হিসাব করলে প্রায় আট বছর পার হয়ে গিয়েছিল দ্বিতীয় সমাবর্তন আসতে আসতে। প্রথম সমাবর্তনের পরে জীবনের অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষাকে সমাহিত করে দিতে হয়েছিল। কিন্তু সেবারের সমাবর্তনে নিজের ভেতরে কোন উচ্ছ্বাস ছিল না, উদ্দীপনা ছিল না, কোনো স্বপ্ন ছিল না। শুধু একটাই ইচ্ছা ছিল মানুষ হিসেবে একটা মর্যাদা লাভ করা আর বেঁচে থাকার জন্য একটা সুবন্দোবস্ত করা। সমাবর্তনের অপেক্ষায় থাকাকালে গ্রোসারি শপের পার্টটাইম কাজকে ফুলটাইম করে নিয়েছিল রঞ্জু।
ইচ্ছা ছিল কিছু অর্থ জোগাড় করে সমাবর্তনের জন্য একটা ভালো স্যুট কিনবে। এরই মধ্যে একদিন পরিচয় হয়ে গিয়েছিল সদ্য বাংলাদেশ থেকে আসা শায়েরের সঙ্গে। শায়ের চাকরি নিয়ে এসেছিল নরওয়েতে। রঞ্জুর সমাবর্তন হতে তখনো প্রায় দুই মাস বাকি ছিল। রঞ্জুর গল্প শোনে শায়ের খুব উৎসাহ দিত রঞ্জুকে, সমাবর্তনের পর রঞ্জুও ভালো চাকরি করতে পারবে, রঞ্জু যেহেতু ভাষা শিখে গিয়েছিল, সেটা তাকে ভালো চাকরি পেতে সাহায্য করবে, অতীতের অভিজ্ঞতাগুলো অনেক কাজে লাগবে ইত্যাদি। শায়েরের দেওয়া উৎসাহ বাণী শোনে রঞ্জু কখনোই খুব একটা উচ্ছ্বসিত হতো না দেখে শায়েরের মনে একটা খটকা লাগত। ব্যাপারটা নিয়ে শায়েরও কখনো খুব একটা ঘাটায়নি রঞ্জুকে। ভাবত, হয়তো এটা সাময়িক হতাশার কারণে এমন করত, চাকরি পেলে ব্যস্ততায় সব ঠিক হয়ে যাবে।
পর্ব পাঁচ
রঞ্জুর সমাবর্তন হওয়ার আগেই শায়েরের অফিসে একটা চাকরির বিজ্ঞাপন আসল। শায়েরের পরামর্শে রঞ্জু আবেদন করল এবং ইন্টারভিউ দিতে গেল। ইন্টারভিউ ভালো হলেও নিয়োগকর্তারা রঞ্জুকে দুজন মানুষের রেফারেন্স দিতে বলেছিলেন, যারা অসলো শহরেই থাকেন। রঞ্জু পরে জানাবে বলে বেরিয়ে এসেছিল এবং ফেরার পথে শায়েরকে টেক্সট করে জানাল রেফারেন্সের কথা। সন্ধ্যায় শায়ের রঞ্জুর কাজের জায়গায় দেখা করতে আসল এবং সে নিজে ছাড়া আরও একজনের রেফারেন্স জোগাড়ের সম্ভাব্যতা নিয়ে কথা বলছিল। গ্রোসারি শপের মালিক পাকিস্তানি হলেও বাংলা কথা কিছুটা বোঝেন। মূলত রঞ্জুর কাছ থেকেই শিখেছিলেন কিছু কিছু। তাদের আলাপের মাঝখানে এসে মালিক বলেছিলেন, ‘তোমাদের কোন সমস্যা হলে আমাকে বলতে পারো, আমি চেষ্টা করব সাহায্য করতে।’ শায়ের তখন রঞ্জুর চাকরির ব্যাপারটা তাকে জানাল এবং একজন রেফারেন্স লাগবে বলল। 

গ্রোসারির মালিক রঞ্জুকে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, ‘আমার রেফারেন্সে যদি তোমার কাজ হয় তাহলে বলো, তোমার মতো একজন বিশ্বস্ত মানুষের রেফারেন্স হতে পারলে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করব। তবে একটা শর্ত আছে, তুমি নতুন চাকরি শুরু করলেও আমার দোকান কিন্তু ছাড়তে পারবে না। তোমাকে রেগুলার আসতে হবে। কাজ করতে নয়, কাস্টমার হয়ে অথবা কুশল বিনিময় করতে।’
সমাবর্তনের পরের সপ্তাহেই নতুন চাকরির যোগদানের তারিখ ছিল। তাই সমাবর্তনের আগের দিন রঞ্জু ফোন করেছিল বাংলাদেশে, বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলে সমাবর্তন আর নতুন চাকরির খবর জানিয়েছিল। খবর শুনে বাবা-মা দুজনেই বলেছিলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ তোমার ভালো করুক।’ রঞ্জুর বাবা আরও বলেছিলেন, ‘সুবিধা করতে পারলে একবার দেশে এসো, আমার শরীরটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। তোমাকে একবার দেখতে আমার খুব ইচ্ছা করছে।’ শায়েরের সঙ্গে আড্ডার সময় রঞ্জু অনেক দিন পরে বাবা-মায়ের সঙ্গে কী কথা হলো—তার গল্প করছিল। শায়ের বলেছিল, ‘বেশ তো, আগামী বছর মার্চ মাসে আমি দেশে যাচ্ছি। তখন চলো, দুজনে একসঙ্গে গিয়ে ঘুরে আসব।’
রঞ্জু সেদিনও কোন বিকার দেখায়নি, না খুশি, না রাগ, না অভিমান—কিছুই না। নতুন চাকরি, নতুন পরিবেশ, নতুন রুটিন—সব মিলিয়ে বেশ ভালোই যাচ্ছিল রঞ্জুর। শায়েরের সান্নিধ্যে এসে সবকিছু নতুন করে ভাববার একটা উচ্ছ্বাস ফিরে পেয়েছিল সে। তখন মাঝে মধ্যেই দেশে ফোন করে বাবা-মায়ের পাশাপাশি পরিবারের অন্য সবার সঙ্গেও টুকটাক কথা বলত, বিশেষ করে বড় ভাতিজির সঙ্গে অনেক গল্প করত। প্রায় প্রতিটা ফোন কলে বাংলাদেশ থেকে সবাই বলত, বাবার শারীরিক অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছে। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে একদিন শায়ের ফোন করে জানাল, মার্চের মাঝামাঝিতে এয়ার টিকিটের বেশ ভালো ডিল আছে। সে চায় রঞ্জুও তার সঙ্গে দেশে গিয়ে একবার বাবাকে দেখে আসুক। রাজি থাকলে শায়ের তখনই দুজনের টিকিট বুকিং দিয়ে দেবে। শায়েরের পীড়াপীড়ি দেখে রঞ্জু রাজি হয়ে গেল। ওদিকে, বাবার অবস্থা তখন খুবই খারাপ, কাউকে ঠিকমতো চিনতেও পারছিলেন না। তবে মাঝেমধ্যেই নাকি রঞ্জুর নাম ধরে ডাকতেন আর কাঁদতেন।
রঞ্জু ফোন করে মাকে জানিয়েছিল, মার্চ মাসের ১৮ তারিখ টিকিট বুকিং দিয়েছে, সে বাবাকে দেখতে দেশে আসছে। ফ্লাইট বুকিং অনুযায়ী ১৮ তারিখেই রঞ্জুরা দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিল। রঞ্জুর ফ্লাইটের ঘণ্টা তিনেক পরে রঞ্জুর বাবা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। কনিষ্ঠ সন্তানের সঙ্গে তাঁর শেষ দেখাটা আর হয়নি। দেশে পৌঁছার কিছুক্ষণ পরে খবর পেয়েছিল যে, তাঁর বাবা আর নেই। খবর পেয়ে রঞ্জুর ভেতরে অভিমান আর দুঃখের মিশ্র একটা অনুভূতি হচ্ছিল সেদিন। রঞ্জুর জন্য বাবার লাশ হিমাগারে রাখা হয়েছিল। হিমাগার থেকে লাশ আনতে গিয়ে রঞ্জু কেবল নীরবে চোখের জল ফেলেছিল, কোনো আবেগী আর্তনাদ করেনি।
মনে মনে ভাবছিল, ‘স্বাভাবিক অনেক প্রাপ্তিই তো আমার ভাগ্যে লেখা হয়নি। এ রকম বাবার সঙ্গে শেষ দেখা হওয়ার কথাটাও ভাগ্যে লেখা ছিল না।’ জানাজার শেষে লাশ কবরে সমাহিত করার সময় রঞ্জু চুপ করে একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। ভাবছিল, বাবার লাশ কবরে নামানোর ক্ষেত্রে বড় ভাইদেরই অধিকার তার চেয়ে অনেক বেশি। জীবিত থাকা অবস্থায় রঞ্জু বাবার কোনো উপকারই করতে পারেনি। বাবার মৃত্যুর পর লাশ কবরে নামাতে নিজের অধিকার দাবি করার কোন যোগ্যতাই তার নেই।
বাবার লাশ দাফনের দুই দিন পরে রঞ্জুদের বাসায় দোয়া মাহফিল ও কুলখানির আয়োজন করা হয়েছিল। বাবার মৃত্যু উপলক্ষে রঞ্জুর সব ভাইবোন, চাচা-ফুফুরা সবাই একত্রিত হয়েছিলেন। মরিয়ম ফুফু সেই কবে থেকেই একটু পর পর বিলাপ করে কান্নাকাটি করে যাচ্ছিলেন। সন্ধ্যার পরে যখন সব আত্মীয়স্বজন চলে গেলেন, তখন রঞ্জুর মায়ের রুমে সবাইকে ডাকলেন মরিয়ম ফুফু। সবাই এসে বসার পরে কান্না জড়ানো কণ্ঠে মরিয়ম ফুফু বলতে শুরু করলেন, ‘ভাইজান অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিলেন। তাঁর জীবদ্দশায় মোটামুটি সবাইকে পরিপূর্ণ দেখে যাওয়ার সুযোগ হলেও রঞ্জুর জন্য শেষ জীবনে খুব বেশি আফসোস করতেন। ভাইজানের খুব ইচ্ছা ছিল, রঞ্জু দেশে আসলে ভালো বংশের একটা মেয়ের সঙ্গে রঞ্জুর বিয়ে দেওয়ার। ভাইজানের ইচ্ছাটা উনি নিজে পূরণ করে যেতে না পারলেও আমরা সবাই মিলে রঞ্জুকে বিয়ে দিয়ে ওনার আত্মাকে শান্তি দিতে চাই এবং এতে তোমাদের সবার সহযোগিতা আমাদের প্রয়োজন।’
ফুফু কথা বলার সময় মায়ের রুমের ভেতরটা পিন পতন নীরবতায় স্তব্ধ হয়েছিল। রঞ্জুর মা ও ভাইবোনেরা সবাই নীরবে চোখের পানি ফেলে যাচ্ছিলেন। তসবি হাতে রুমে এক কোনায় বসেছিলেন রঞ্জুর বড় দুলাভাই। নীরবতা ভেঙে তিনি রঞ্জুকে প্রশ্ন করলেন, ‘তুই কত দিন দেশে থাকবি রঞ্জু?’ রঞ্জু উত্তর দিয়েছিল, সে ছয় সপ্তাহের ছুটি নিয়ে এসেছে। ঢাকায় কিছু কাজ আছে, এই ছুটির বেশ কিছুদিন তার ঢাকাতেই থাকতে হবে।
বড়ভাই জিজ্ঞেস করলেন, চাইলে আরও কিছুদিন ছুটি বাড়াতে পারবে কি না? রঞ্জু বলল, ‘আমার চাকরিটা এখনো নতুন, ছুটি বাড়ানো সম্ভব হবে না। আর আমার এখন বিয়ে করার কোনো ইচ্ছা নেই। বাবাও তো আর এখন বেঁচে নেই। আমার মনে হয়, আমরা সবাই মিলে দোয়া করলেই বাবার আত্মা অনেক শান্তি পাবে। তাই বিয়ের ব্যাপারটা না ভাবলেই হয়।’
রঞ্জুর কথা শুনে ভাইবোন, ভাবি-দুলাভাই সবাই কথা বলতে শুরু করলেন। একপর্যায়ে, বড়ভাই বলতে শুরু করলেন, ‘আমাদের আসলে উচিত ছিল, বাবা বেঁচে থাকতেই তোকে দেশে এনে বিয়ে করানো। সাংসারিক ঝামেলা আর বাবার অসুস্থতার কারণেই সেই সুযোগটা আমাদের হয়ে উঠেনি। বাবার অবর্তমানে তোকে বিয়ে করানোটা এখন আমাদেরই দায়িত্ব। তুই বিয়ে না করলে সবাই মনে করবে, আমরা কেউ আমাদের দায়িত্ব পালন করিনি। এমনকি লোকজন তখন বাবার কথাও বলবে, বাবা হয়তো আমাদের দায়িত্বটা সঠিকভাবে বুঝিয়ে দিয়ে যাননি। আর বাবা নেই বলে কী হয়েছে। মা তো আছেন, আমরা তো আছি, আমাদের সবারই ইচ্ছা হচ্ছে তোকে বিয়ে করিয়ে সংসারী বানানো। মানুষ মাত্রই ভুল করে, তাই বলে আমাদের অতীতের ভুল ভ্রান্তির ভুক্তভোগী একা তুই কেন হবি? তোর অতীত জীবনের কোন দুঃখ-কষ্ট হয়তো আমরা লাগব করতে পারবে না। তবে সমাজে তুইও যাতে সুস্থ-সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে পারিস, তার একটা চেষ্টা করার সুযোগ আমাদের দে। তুই আর অমত করিস না। প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য সময় আমরা তোকে অবশ্যই দেব। আর একটা ভালো মেয়ে খুঁজে বের করতেও তো আমাদের কিছুটা সময় লাগবে। বাবার মৃত্যুর পরে তাঁর পক্ষে দায়িত্ব পালন করার এটাই আমাদের প্রথম পদক্ষেপ। আমার মনে হয়, সবার কথা বিবেচনা করে তোর আর অমত করা ঠিক হবে না। আর তুই তো আজীবনই আমাদের কথা শুনেছিস। আমরা মনে করি, বিয়ে করে সংসারী হলে, সবার দোয়ায় তুই সুখীই হবি।’
বড়ভাইয়ের কথায় যখন সবাই সমর্থন জানিয়েছিলেন, রঞ্জু একদম চুপ করেই ছিল শেষ অবধি। মরিয়ম ফুফু জোরে আলহামদুলিল্লাহ বলে রঞ্জুর মাকে জড়িয়ে ধরে দুজনে আবারও কাঁদতে লাগলেন। সেখানে বসেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সবাই যার যার চেনা জানা অনুযায়ী পাত্রীর সন্ধান শুরু করার। যা হোক, সে যাত্রায় সময় স্বল্পতার কারণে রঞ্জুর বিয়ে হয়নি। তবে, সবাই মিলে পাত্রী খোঁজ করা অব্যাহত রাখলেন। চাহিদামত পাত্রীর সন্ধান পেলেই রঞ্জুকে আবার দেশে আনা হবে বিয়ের জন্য। রঞ্জুর নিজের বিশেষ কোনো চাহিদা নেই, তাই পরিবারের সবাই মিলে যেই মেয়ে ঠিক করবে, রঞ্জু তাকেই বিয়ে করবে। রঞ্জু ফিরে যাওয়ার আগে মায়ের কাছে বিদায় নিতে গেলে মা আর মরিয়ম ফুফু তাকে বেশ করে বলে দিলেন, ‘আমরা পছন্দমতো মেয়ে পেলেই তোকে খবর দেব, তুই কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই চলে আসবি। আর টাকা-পয়সা নিয়ে কোনো চিন্তা করিস না। আল্লাহর রহমতে তোর ভাইদের আয় রোজগার এখন অনেক বেড়েছে, মন মানসিকতাও এখন অনেক ভালো হয়েছে।’
রঞ্জু কিছু না বলেই মা আর ফুফুর পা ছুঁয়ে সালাম করে বিদায় নিল।
শেষ পর্ব
ফ্লাইটে উঠে রঞ্জু শায়েরের বাসার সবার কথা জিজ্ঞেস করল। তারপর নিজের কথা বলতে শুরু করল। বাবার জানাজা কোথায় হলো, দাফন কীভাবে হলো, কুলখানি কী রকম হলো এবং সর্বশেষ তার বিয়ে নিয়ে সবার ইচ্ছার কথা বলল। রঞ্জু বিয়ে করবে শুনে শায়েরের চোখ ঝলমল করে উঠল। বলল, ‘ভাই তুমি তাহলে বিয়ে করছ, তোমার তো এখন খুশি হওয়ার কথা। যে ভাইবোনদের তুমি সব সময় ভয় পেয়ে এসেছ, আজকে তোমার বাবার অনুপস্থিতিতে তারাই তোমার বিয়ের আয়োজন করতে ব্যস্ত। সবই তো ভালো ভাই, কনগ্র্যাচুলেশন।’
কিন্তু রঞ্জুর ভাবভঙ্গিতে আনন্দের কোনো রেশ নেই। শায়ের ভেবেছিল, বাবাকে এসে জীবিত অবস্থায় দেখতে না পাওয়ার কষ্ট হয়তো রঞ্জুকে এখনো দুমড়ে রেখেছে। এদিকে রঞ্জু মনে মনে হিসাব মেলানোর চেষ্টা করছিল, ‘একদিন ফাতেমাকে বিয়ে করার কথা বলায়, কতই না তুলকালাম কাণ্ড হয়ে গিয়েছিল, সব ভাইবোন কী রকম বেঁকে বসে থেকে কী না কি বলেছিল, রাগারাগি করে বড়ভাই বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলেন। আর আজ তারা সবাই মিলেই রঞ্জুর জন্য ভালো বংশের, ভালো মেয়ে খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। তাহলে ফাতেমার মাঝে কিসের কমতি ছিল? ভালো বংশের, সুন্দরী, শিক্ষিতা, ভালো মেয়েই তো ছিল ফাতেমা। ভাগ্যের মুদ্রা এই কয়েক বছরে কীভাবে একদম উলটে গেল?’
রঞ্জু ভাবছিল, হয়তো এটাই তার ভাগ্যে লেখা ছিল। তার ভাগ্যটা তো আর অন্য সবার মত স্বাভাবিক করে লিখেননি বিধাতা। এদিকে রঞ্জু চলে যাওয়ার পর পাত্রী ঠিক করা নিয়ে ওদের বাসায় প্রতিদিনই চলছিল নানা রকমের সার্কাস। পরিবারের যে যেই মেয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন, সেই মেয়েই সবচেয়ে ভালো। অন্যদের প্রস্তাবে আনা পাত্রীদের নানা রকমের সমস্যা খুঁজে বের করে বাতিল করার আগ পর্যন্ত কেউই পিছপা হতে রাজি নন। তার উপর বিদেশি পাত্রের জন্য পাত্রী খোঁজার খবর পেয়ে দালালদের আনাগোনাও বেড়ে গেল রঞ্জুদের বাসায়। এসব সার্কাস চলতে চলতে প্রায় আরও দেড় বছর সময় পার হয়ে গেল। এমন অবস্থায় রঞ্জুর বড় আপার আনা প্রস্তাবের এক পাত্রীকে ঠিক করা হলো, যদিও এতে কারও কারও আপত্তি বিবদমান। 

রঞ্জুকে দেশে আসতে বলা হলো। রঞ্জু আসলেই অ্যানগেজমেন্ট, তারপরেই বিয়ে। রঞ্জুও বড়ভাইয়ের ফোন পেয়ে যথা সময়ে দেশে এসে পৌঁছাল। কিন্তু এরপরও বিপত্তি আর কাটে না। রঞ্জুর এক ভাই এবং এক বোন সাফ জানিয়ে দিলেন, এই প্রস্তাবের বিয়েতে তাঁরা রাজি না। কারণ, মেয়ের বয়স কম, পড়াশোনা বেশি করেনি এবং মেয়েদের বংশও খুব একটা উঁচু না। বাসায় জরুরি মিটিং বসিয়ে এই প্রস্তাব বাতিল করে দেওয়া হলো। কিন্তু রঞ্জু তো দেশে চলে এসেছে, ছুটিও অল্প দিনের, তাহলে কী করা যায়। তাড়াহুড়োর মধ্যে দালালের মাধ্যমে পাওয়া গেল ভালো বংশের, উচ্চশিক্ষিতা এক পাত্রীর খোঁজ। সময় যেহেতু কম আর ভালো বংশের শিক্ষিতা মেয়েও পাওয়া গেছে, তাহলে আর অহেতুক সময় নষ্ট করার কোনো দরকার নেই। ধুম করে কিছুদিনের ভেতরেই হয়েও গেল রঞ্জুর বিয়ে। বিয়ের তিন সপ্তাহ পরে রঞ্জু আবার ফেরত চলে গেল নরওয়েতে। সেখানে গিয়ে সব কাগজপত্র জোগাড় করে ভিসা প্রসেসিংয়ে সময় লেগে গিয়েছিল প্রায় নয় মাস। এই সময়ের ভেতরে রঞ্জুর সঙ্গে তার স্ত্রীর আর দেখা হয়নি, শুধু ফোনে আলাপ হতো প্রায় প্রতিদিনই।
ভিসা হয়ে যাওয়ার পরে রঞ্জু আবার এক সপ্তাহের জন্য দেশে গিয়েছিল বউকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে। বউ আসার আগেই রঞ্জু নতুন বাসা ঠিক করে, সাংসারিক নিত্য প্রয়োজনীয় প্রায় সব জিনিসপত্রের জোগাড় করে রেখেছিল। বউ আসার পর প্রথম কিছুদিন বেশ ভালোই কাটছিল তাদের নতুন সংসারে। নতুন বউ খুব বেশি রান্না–বান্নার কাজ পারে না বলে রঞ্জু প্রতিদিন বাসায় ফিরে রান্নার কাজে বউকে সহায়তা করত, বাজার–সদাই করতে বউকে সঙ্গে নিয়েই যেত।
আনুমানিক দুই মাস পর থেকে বউয়ের আচরণ দেখে রঞ্জুর মনে কিছুটা ভয়ের সঞ্চার হতে শুরু করল। দুই মাসের মধ্যে রঞ্জু আর শায়ের মিলে নতুন বউকে অসলো শহরের প্রায় সব দর্শনীয় স্থান ঘুরিয়ে দেখাল। কীভাবে বাসে চড়তে হয়, কীভাবে ট্রেনে চড়তে হয়, কীভাবে ম্যাপ দেখতে হয়—মোটামুটি সবই দেখাল নতুন বউকে। রাস্তাঘাট চিনে নেওয়ার পর থেকে বউ একা একাই বাইরে ঘুরতে যেত। এক সময় রঞ্জু লক্ষ্য করে দেখল, প্রায় প্রতিদিনই বাসায় ফিরে দেখে তার বউ ঘরে নেই। মাঝে–মধ্যে অনেক দেরি করেও বাসায় ফিরে। কোথায় গিয়েছিল জানতে চাইলে রাগ দেখাত। প্রয়োজন ছাড়া একা বাইরে না যাওয়ার কথা বললে রঞ্জুর সঙ্গে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিত। বলত, ‘আমি কোথায় যাই, না যাই, তার কৈফিয়ত আমি তোমাকে দিতে পারব না। আমি একজন শিক্ষিতা মেয়ে, তোমার ঘরে বসে ঝি–চাকরের কাজ করার কোনো ইচ্ছা আমার নেই।’
বউয়ের এসব আচরণ দেখে রঞ্জুর আবারও মাথায় হাত। কোন কারণে যে সে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল, তার আর দিশা সে খুঁজে পাচ্ছিল না। আরও মাস তিনেক এভাবে ঝগড়াঝাঁটি করেই কেটে গেল। শেষমেশ বাধ্য হয়ে রঞ্জু দুই পরিবারের মুরব্বিদের কাছে বউয়ের এমন আচরণের কথা জানাল। পারিবারিকভাবে জানাজানি হওয়ার পর বউয়ের উচ্ছৃঙ্খল আচরণ আরও বেড়ে গেল। ঝগড়ার ছলে নিজের শরীরে আঘাতের চিহ্ন একে রঞ্জুকে ট্র্যাপে ফেলার চেষ্টা করত। এক ছুটির দিনে রঞ্জু তাকে বাইরে যেতে বারণ করলে সে চিৎকার চেঁচামেচি করে ঘরের বাসনপত্র ভাঙচুর করে। ভাঙা কাচের টুকরো দিয়ে নিজের হাত–পা কেটে রক্তাক্ত হয়ে পুলিশকে কল করে। পুলিশ এসে রঞ্জুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় এবং তাকে হাসপাতালে পাঠায়।
গ্রোসারি শপের মালিক আর শায়ের খবর পেয়ে আদালতে গিয়ে রঞ্জুকে জামিনে ছাড়িয়ে আনতে যায়। আদালতে বিচারক রঞ্জুকে তার স্ত্রী থেকে আলাদা থাকতে হবে বলায় শায়ের রঞ্জুকে তার নিজে বাসায় নিয়ে রাখবে বলে আদালতকে জানায়। কিন্তু রঞ্জুর স্ত্রী একা ওই বাসায় থাকবে না জানায় এবং সে তার কোন এক আত্মীয়ের আশ্রয়ে থাকতে চায় বলে আদালতের অনুমতি প্রার্থনা করে। আদালত অনুমতি মঞ্জুর করে এবং রঞ্জুকে তার নিজের বাসাতেই থাকার ব্যাপারে পরামর্শ দেয়।
আদালত থেকে বের হওয়ার পর থেকে রঞ্জুর স্ত্রীর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। আদালতের নথিতে জমা দেওয়া আত্মীয়ের ঠিকানায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মামলার জামিনের দিন রাতেই নাকি রঞ্জুর বউ এবং ওই আত্মীয় বাসা ছেড়ে ইউরোপের অন্য কোন এক দেশে চলে গেছে। বিদেশের আদালতে রঞ্জুর বিরুদ্ধে স্ত্রীকে নির্যাতনের মিথ্যা মামলা ঝুলে থাকলেও দেশে দুই পরিবারের মধ্যে বাকবিতণ্ডা একপর্যায়ে এসে থামে। রঞ্জুর শ্বশুর তার মেয়ের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থী হন রঞ্জুদের পরিবারের কাছে। তিনি স্বীকার করেন, অল্প বয়সে অবাধ প্রেমে বাধা দেওয়ার কারণেই তাদের মেয়ে অনেকটা অবাধ্য হয়ে উঠে। তারা ভেবেছিলেন বিয়ে দিয়ে মেয়েকে বিদেশে পাঠিয়ে দিলে নিজেদের সম্মানটাও বাঁচবে এবং মেয়ের আচরণও আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। তাইতো দালালকে অনেক টাকা পয়সা দিয়ে মেয়ের জন্য বিদেশি পাত্রের সন্ধান করেছিলেন তারা। মেয়েকে ভালো করার তাদের নিদারুণ চেষ্টাকেই কাজে লাগিয়ে মেয়ে তাদের সঙ্গে এমন প্রতারণা করেছে। রঞ্জুকে বিপদে ঠেলে দিয়ে সুযোগ তৈরি করে নিয়েছে পুরোনো প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার।