রঙে রঙিন পিঠা উৎসব

জাপানের কানাগাওয়া কেনের কামিমিজুতে প্রবাসী বাঙালিদের উঠোনে বসেছিল পিঠার মেলা। স্বাধীন বাংলার মা যেন সেদিন হরেক রকম পিঠার ডালি নিয়ে এসেছিলেন এই ভিনদেশি নগরীতে। নানান রঙের বাহারী সব পিঠা-পুলিতে যেন ভরে উঠেছিল উৎসবের টেবিলখানা। গত ২৬ মার্চ রোববার বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা দিবসে এই পিঠা মেলার আয়োজন করা হয়।
জাপানে বসবাসরত প্রবাসী বাঙালিদের কাছে পিঠা উৎসব অনেক কাঙ্ক্ষিত বিষয়। প্রিয় স্বদেশের পৌষ-পার্বণের গ্রাম-বাঙলার চিরায়ত ঐতিহ্য ধরে রাখতেই প্রতি বছর প্রবাসী তারা পিঠা উৎসবের আয়োজন করে থাকেন। প্রবাসী বাঙালি নারীরা তাদের নিজ হাতে গভীর মমতা আর আন্তরিকতায় তৈরি করেন বাংলার ঐতিহ্যবাহী হরেক রকম পিঠা। সেই বাহারী পিঠা থরে থরে সাজিয়ে তারা পিঠা উৎসবকে রঙিন করে তোলেন।
ভোজনরসিক বাঙালিরা কেবল যে শুধু খাদ্য সামগ্রী দিয়েই দেশীয় ঐতিহ্য ধরে রাখেন তা নয়, পোশাকেও থাকে স্বদেশি ঐতিহ্যের ছোঁয়া। নারীর সৌন্দর্য শাড়িতে আর সেই শাড়িই শোভা পায় প্রতিটি প্রবাসী নারীর অঙ্গে।
এবারের উৎসবেও প্রবাসী নারীরা নিজেদের সাজিয়ে ছিলেন হলুদ আর বাসন্তী রঙের ছোঁয়ায়। পুরুষেরাও পিছিয়ে ছিলেন না। তারাও পরেছিলেন বাংলার ঐতিহ্যবাহী পোশাক পাঞ্জাবি। সব মিলিয়ে এবারের পিঠা উৎসব যেন প্রিয় বাংলাদেশকেই ভিনদেশের মাটিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।

সকাল থেকেই আবহাওয়া ছিল বৈরী। বৃষ্টি আর প্রচণ্ড ঠান্ডা উপেক্ষা করেই প্রবাসী বাঙালিরা সমবেত হয়েছিলেন পিঠা উৎসবের মিলনমেলায়। নানান রকমের পিঠা-পুলিতে ভরে উঠেছিল পুরো উৎসব।
ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কলকাকলীতে মুখর ছিল পুরোটা দিন। উৎসবের শুরুতে ছিল স্মৃতির অ্যালবামে প্রাণের উৎসবকে ক্যামেরায় ধারণ করার পর্ব। যদিও অনুষ্ঠানের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ছবি তোলার পর্ব চলছিল। পিঠা উৎসবের রং-বেরংয়ের পিঠা নিয়ে ছবি তোলা যেন শেষই হচ্ছিল না। পিঠার ডালা নিয়ে প্রবাসী নারীরা এক হয়ে তুলেছিলেন চমকপ্রদ সব ছবি।
দুপুরের সুস্বাদু ভোজনের পর শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। স্বপন মিয়া ও ইলিয়াস মুনশিসহ আরও অনেকে গান পরিবেশন করে উৎসবকে আরও বেশি আকর্ষণীয় করে তোলেন। বাঙালিদের এই পিঠা উৎসবে কেবল বাঙালিই নয়, উপস্থিত ছিলেন জাপানিরাও। তারাও অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করে সবাইকে অবাক করে দেন। সবার আনন্দ-আড্ডায় এক মনোরম পরিবেশের সূচনা হয়।

এরপর থাকে প্রবাসীদের জন্য আরেক চমক আর সে চমক হলো চটপটি পর্ব। প্রিয় দেশ ছেড়ে আসা মানুষগুলো বিশেষ করে নারীদের বিদেশের মাটিতে চটপটি-ফুচকার জন্য প্রায়ই হাপিত্যেশ করতে দেখা যায়। এবারের পিঠা উৎসবে চটপটির চমক সবাইকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছে।
সবশেষে ছিল উৎসবের মূল আকর্ষণ পিঠা পর্ব। ভোজনরসিক বাঙালিরা বিদেশের মাটিতে গ্রাম-বাঙলার সব ঐতিহ্যবাহী পিঠা পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলেন। পৌষ-পার্বণে মায়ের হাতের পিঠা খাওয়ার স্মৃতিই যেন সবাইকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল প্রিয় জন্মভূমিতে।

বরাবরের মতো এবারের পিঠা উৎসবের আয়োজক ছিলেন রন্ধনশিল্পী নদী সিনা ও জেড এম আবু সিনা। তাদের কঠোর পরিশ্রম আর আন্তরিকতায় আমরা একটি চমৎকার উৎসবে অংশগ্রহণ করতে পেরেছি।
জাপানে বসবাসরত প্রতিটি প্রবাসীর কাছেই পিঠা উৎসব অনেক কাঙ্ক্ষিত একটি দিন। এই উৎসবের জন্য সবাই প্রতি বছর অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করেন। ভিনদেশের মাটিতে কাছের মানুষ ছেড়ে আসা মানুষগুলো যেন সবাই সবার পরম আত্মীয়ে পরিণত হন। উৎসবের রঙে রঙিন হয় সবার জীবন। এ রং ছড়িয়ে থাকে সবার মনে-প্রাণে। আগামী দিনগুলোতেও যেন বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পিঠা উৎসব সকল বিভেদ ভুলে সবাইকে এক কাতারে শামিল করতে পারে সেই কামনাই করি।