রংধনুর দেশ

অক্টোবরে প্রকৃতির বেগুনি রূপ
অক্টোবরে প্রকৃতির বেগুনি রূপ

এই দেশকে কী বলে সম্বোধন করতে পারি, ভেবে পাচ্ছি না। রংধনুর দেশ নাকি চিরসবুজের দেশ! যে সুন্দর শুধু মন দিয়ে ছোঁয়া যায় তা কি সব সময় ভাষায় প্রকাশ করা যায়!
এতদিন দেশটির সৌন্দর্য শুধু মন আর চোখের ভাষায় প্রকাশ করেছি। আজ প্রথম আলোর সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণায় দূর পরবাস বিভাগকে উপলক্ষ করে আমার লেখনীর মাধ্যমে দেশটি সম্পর্কে অনুভূতি প্রকাশ করার সুযোগ পেয়ে আমি দারুণভাবে আপ্লুত। জানি না এই মন আর আমার দুটো চোখ দিয়ে যে সৌন্দর্য আমি অবলোকন করেছি সেই সৌন্দর্য আমার লেখনীতে কতটা ফুটিয়ে তুলতে পারব। এখানে আসা না হলে হয়তো সৃষ্টির আপন সৌন্দর্যে সাজানো সুন্দরকে দেখার সুযোগ হতো না। যে সুন্দরের কাছে মনুষ্যনির্মিত সব সৃষ্টি ম্লান হয়ে যায়। অবারিত সুন্দর আর এই সম্পদের মোহেই যুগে যুগে শাসকেরা এসেছিলেন শুষে নিতে।

অক্টোবরে প্রকৃতির বেগুনি রূপ
অক্টোবরে প্রকৃতির বেগুনি রূপ

যতটুকু জেনেছি, দক্ষিণ আফ্রিকানরা রংধনু জাতি বলে খ্যাত। সাদা, কালো ও সাদা-কালো মিশেল সব ধরনের মানুষের বাস এখানে। শুধু জাতি হিসেবেই তারা রংধনু, তা নয়। আমার কাছে দেশটাকেও রংধনুর দেশ বলেই মনে হয়। রং-বেরঙের পশু-পাখি, জীবজন্তু, নানা রকমের গাছপালার বসবাস যেখানে, সেই দেশকে রংধনুর দেশ না বলে পারি! পৃথিবীর কোথাও খুব ঠান্ডা, আবার কোথাও খুব গরম। কিন্তু এখানে না ঠান্ডা না গরম। কোনোটাই খুব বেশি তীব্র নয়। এত চমৎকার আবহাওয়া পৃথিবীর আর কোথাও আছে কি না, আমার জানা নেই। তাই হয়তো এখানে জীবজন্তুর অবাধ বিচরণ দেখা যায়।
খুব আগ্রহ এবং উচ্চ ধারণা নিয়ে যে দক্ষিণ আফ্রিকায় আসিনি, সেটা বলাই বাহুল্য। কারণটা হচ্ছে নিরাপত্তাজনিত। যদিও সেটার নেপথ্যে রয়েছে অনেক কারণ। সে প্রসঙ্গে আজ না–ই বা গেলাম। এই কালো মানুষদের মুক্তির দূত ‘নেলসন ম্যান্ডেলা’ জন্ম না নিলে হয়তো আজও এই দেশের ইতিহাস হতো অন্য রকম। শুধু এই দেশে কেন, গোটা পৃথিবীতেই হয়তো আজও তারা অবহেলিত থাকত। তাহলে হয়তো বা আজও পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট একজন কৃষ্ণাঙ্গ হতে পারতেন না। কোনো কিছুর বিনিময়ে তাঁর এ অবদান ভোলার নয়।

অক্টোবরে প্রকৃতির বেগুনি রূপ
অক্টোবরে প্রকৃতির বেগুনি রূপ

এই কালো মানুষদের নিয়ে আমাদের ধারণা, তারা অনেক বুনো স্বভাবের। কিন্তু এই কালো কালো মানুষের মাঝেও যে অনেক সাদা সাদা মন আছে, তা আমরা এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও খোঁজার চেষ্টা খুব কমই করি। পরিচিত হোক আর অপরিচিত হোক, কাউকে দেখলে হাসিমুখ মাখা সম্বোধন আর কুশল জিজ্ঞাসা সত্যি আমার খুব ভালো লাগত। যদিও আসার পর প্রথম প্রথম এই মানুষগুলোকে দেখে মনের অগোচরে ভয় উঁকি দিত। কিন্তু এই ভয় কাটতে খুব বেশি সময়ও লাগেনি।
সত্যিই নৈসর্গিক ও সৌন্দর্যে ভরা এই দক্ষিণ আফ্রিকা। প্রকৃতি এখানে আপন সাজে সজ্জিত। পাহাড়গুলোকে দেখলে মনে হয় সবুজের ডালি মেলে নীলাকাশকে যেন ছুঁয়ে দিয়েছে। সবুজ প্রকৃতি, পাহাড় আর নীলাকাশ মিলেমিশে একাকার। এমন একটা সুন্দরের প্রতিচ্ছবি কার না ভালো লাগবে! হাজার রকমের গাছ, নানা রঙের পশু-পাখি, তাদের মুহুর্মুহু প্রতিধ্বনিতে এক সুরের মোহনা তৈরি হয়।
সৌভাগ্যবশত এখানে আমাদের বাসার ভিউটা এক কথায় চমৎকার। যেটা আমি সব সময় প্রত্যাশা করতাম নতুন কোনো বাসায় ওঠার আগে। আর আমার এই প্রত্যাশা এখানে এসে পূরণ হয়েছিল। এখানে আমার সকালে ঘুম ভাঙে গাড়ি আর বাসের ভেঁপুর শব্দে নয়। ঘুম ভাঙে পাখির কলকাকলি, সূর্যের আলোর ঝলকানি এবং পাহাড়ের বুকে ঘুমিয়ে থাকা সবুজের সম্মোহনী সৌন্দর্যে। সকালে ঘুম থেকে উঠে যখন জানালা দিয়ে পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি, তখন মনে হয় সদ্যস্নাত পাহাড়গুলো তার সমস্ত স্নিগ্ধতা দিয়ে আমার ঘুমগুলোকে তাড়িয়ে দিতে তৎপর।

অবাধে ঘুরে বেড়ায় হরিণ
অবাধে ঘুরে বেড়ায় হরিণ

প্রবাসের এ নিঃসঙ্গ জীবনে প্রকৃতির থেকে বিশ্বস্ত সঙ্গ আর কী–ই বা হতে পারে? যার সঙ্গ ভুলিয়ে দিতে পারে অনেক কিছুই। তখন মনে হয় আমি তো একা নই, আমাকে কেউ একজন সঙ্গ দিচ্ছে, অবলোকন করছে। যার সঙ্গে আমি আমার হাসি-কান্না-বেদনা সব ভাগ করে নিতে পারি। তখন মনে হয়, আমি কাঁদলে বুঝি আমার চারপাশের প্রকৃতিও কাঁদে, আর আমি হাসলে সে–ও বুঝি হেসে ওঠে। এ ক্ষেত্রে প্রকৃতিপ্রেমিক কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমি’ কবিতার দুটো লাইন উল্লেখ না করে পারছি না: ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ, চুনি উঠল রাঙা হয়ে। আমি চোখ মেললুম আকাশে, জ্বলে উঠল আলো পুবে পশ্চিমে। যাঁর চেতনার প্রতিটি রঙ প্রকৃতির সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে থাকতো।’
দক্ষিণ আফ্রিকা এসে দেখলাম সবগুলো ঋতু আপন আপন বৈশিষ্ট্য নিয়ে সগৌরবে এসে হাজির হয়। যখন আমি লিখছি তখন প্রিটোরিয়াতে অক্টোবর মাসের শেষ দিক। এ সময় পুরো প্রিটোরিয়া শহর বেগুনি রঙে ছেয়ে যায়। এটা দেখে মতিভ্রম হয়, আকাশের রং বুঝি বেগুনি। পুরো মাসজুড়ে বেগুনি রঙের জাকারান্ডা ফুলের সৌন্দর্য সত্যিই বিমোহিত করে। সত্যিই কি অপরূপ স্রষ্টার সৃষ্টি! পৃথিবীর একেকটি সৃষ্টি যেন একেকটি অনন্য। তাই কবির ভাষায় বলতে হয়, ‘তোমার মতো এমন নিপুণ কারিগর কে আছে এ ভবে প্রভু-মম তোমার মতো।’
ইলমা আফরিন সিলভিয়া
প্রিটোরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা