পৃথিবীর একজন অন্যতম মহান তথ্যচিত্র নির্মাতা মার্সেল ওফ্যুলসের দ্য মেমোরি অব জাস্টিস। জেনোসাইডের ওপর নির্মিত পাঁচ ঘণ্টা দৈর্ঘ্যের দুর্লভ তথ্যচিত্র এটি। ১৯৭৬ সালে নির্মিত এই তথ্যচিত্রটি সে বছরেই ফ্রান্সের কান চলচ্চিত্র উৎসব, নিউইয়র্ক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ও ১৯৭৮ সালে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। আর এর রেস্টোর্ড ভার্সন এবারের টরন্টো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। এটি টিফ সিনেমাথেকের একটি বিশেষ প্রদর্শনী ছিল এই উৎসবে। এর শো দেখার সুযোগ পেয়েছেন মাত্র শ খানেক দর্শক আগে আসলে আগে পাবেন ভিত্তিতে। ১৯ সেপ্টেম্বর ব্যতিক্রমী এই তথ্যচিত্রটি দেখার সুযোগ ঘটে আমারও। আর এই তথ্যচিত্রের দর্শকদের অফিশিয়ালি ফেবারিট অডিয়েন্স অব দিস ফেস্টিভ্যাল বলে সম্মান জানান উৎসবের কনভেনর।
মার্সেল ওফ্যুলসের এই এপিক ডকুমেন্টারি—ভিয়েতনাম, আলজেরিয়া ও নাজি জার্মানির যুদ্ধাপরাধের তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে পশ্চিমা সমাজের জাস্টিসের ধারণাকে তুলে ধরেছে।
ইনভেস্টিগেটর, ইন্টারোগেটর ও এসেইস্ট—এই তিন ক্ষমতার অধিকারী ও ইংরেজি-ফরাসি-জার্মান ভাষায় সমান দক্ষ মার্সেল ওফ্যুলসকে পৃথিবীর একজন গ্রেটেস্ট ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকার বলা হয়। তার দুটি খুব পরিচিত কাজ হচ্ছে দ্য সরো অ্যান্ড দ্য পিটি ও অ্যাকাডেমিক অ্যাওয়ার্ড জয়ী হোটেল টার্মিনাস: দ্য লাইফ অ্যান্ড টাইমস অব ক্লাউস বার্বি। এ দুটো তথ্যচিত্রই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সের অভিজ্ঞতার পেছনের ইতিহাস ও নৈতিক অস্বচ্ছতা তুলে এনেছে। আর এ দুই কাজের মাঝে তিনি তৈরি করেন এই মেমোরি অব জাস্টিস, যা অন্য দুটি তথ্যচিত্রের চাইতেও বেশি রিগোরাস, এম্বিশাস ও প্রোভোকেটিভ হওয়ার পরেও, বিষয়বস্তুর কারণে রোষানলে পড়ে ও এর প্রচার ব্যাহত হয়।
ওফ্যুলস তার এই তথ্যচিত্র নির্মাণের প্রেরণা পান টেলফোর্ড টেইলরের ১৯৭০ সালের বই নুরেমবার্গ অ্যান্ড ভিয়েতনাম: এ্যান আমেরিকান ট্র্যাজেডি থেকে। লেখক নাজি যুদ্ধাপরাধীদের নুরেমবার্গ ট্রায়ালের একজন ইউএস প্রসিকিউটর ছিলেন ও বইটিতে লিখেছেন কীভাবে নুরেমবার্গে প্রতিষ্ঠিত জাস্টিসের প্রিন্সিপালকে প্রয়োগ করা যায় ভিয়েতনামে আমেরিকার ইনভলভমেন্টের ক্ষেত্রে।
এই বিষয়টিকেই বর্ধিত করে ওফ্যুলস পশ্চিমা সমাজের জাস্টিসের ধারণা ও সংজ্ঞা নিয়ে করেন মাল্টিলেয়ার্ড এক্সপ্লোরেশন। নিয়ে আসেন আলজেরিয়া ও ভিয়েতনামে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের মতো উত্তপ্ত সমসাময়িক বিষয়াদি, নুরেমবার্গ ট্রায়ালের আর্কাইভাল ফুটেজ, প্রাক্তন নাজি থেকে শুরু করে নাজি হান্টারদের অনেক নতুন ইন্টারভিউ। জোয়ান বায়েজ, ফ্রেড অ্যাস্টেয়ারের গান ও ইয়াহুদী মেনুহিনের বাদন-চমৎকার সংযোজন তথ্যচিত্রটিতে।
তথ্যচিত্রের শুরুতে বর্ষীয়ান নির্মাতা আসেন মঞ্চে উৎসবের কনভেনরের সঙ্গে। কৌতুক করে বলেন স্ক্রিনিং শেষে কজন দর্শক থাকে তিনি সেটি দেখার অপেক্ষায়। কিন্তু বলাই বাহুল্য, দর্শকেরা সবাই ছিলেন শেষ পর্যন্ত।
স্ক্রিনিংয়ের শেষে মার্সেল ওফ্যুলস আবার মঞ্চে আসেন উৎসবের কনভেনর টম পাওয়ারস, আর্কাইভের দায়িত্বপ্রাপ্ত মাইক ও ফিল্ম ক্রিটিক জেনিফারের সঙ্গে। তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন এই কালজয়ী নির্মাতা।
এই দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টার দুর্লভ তথ্যচিত্রটি এখনো অনেক প্রাসঙ্গিক ও বর্তমানে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে নানান প্রশ্ন অবধারিতভাবে উসকে দেয়। এ ধরনের একটি তথ্যচিত্র ও তার নির্মাতাকে দেখার সুযোগ পাওয়া একটি লাইফ টাইম এক্সপেরিয়েন্স নিঃসন্দেহে।