যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে স্থায়ী কনসুলেট কেন হবে না
যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যে দুই লক্ষাধিক বাংলাদেশি আমেরিকানের বসবাস। দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা মিশিগানে একটি স্থায়ী কনসুলেট সার্ভিস চালু করার দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ভুক্তভোগী প্রবাসীদের সেই দাবি পূরণ হয়নি। কী কারণে তাঁদের এই দাবি পূরণ হচ্ছে না, তাও অস্পষ্ট। বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে জনগুরুত্বপূর্ণ দাবিটি উপস্থাপন করা হলেও এখন পর্যন্ত এটি গুরুত্ব পায়নি।
নিউইয়র্কের পরই যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের সিংহভাগ বসবাস করেন বিশ্বের মোটরগাড়ির রাজধানীখ্যাত অঙ্গরাজ্য মিশিগানে, যেখানে রয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম মিঠাপানির লেক। এখানে বসবাসরত বাংলাদেশি আমেরিকানদের সংখ্যা হবে প্রায় দুই লাখ। বিপুলসংখ্যক এই বাংলাদেশি আমেরিকানসহ কমিউটির অন্যান্য মানুষের চাহিদা মেটাতে এখানে রয়েছে বাংলাদেশি মালিকানাধীন স্কুল, ফার্মেসি, ক্লিনিক, অটো ডিলার, গাড়ি মেরামতের ওয়ার্কশপ, রেস্টুরেন্ট, কাপড়ের দোকান, রিয়েল এস্টেট অফিস, ইনস্যুরেন্স অফিস, ইনকাম ট্যাক্সসহ বহুমুখী সেবামূলক প্রতিষ্ঠান এবং শতাধিক গ্রোসারিসহ সহস্রাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া এখানে রয়েছে পনেরোটি মসজিদ, পাঁচটি মন্দির ও দুটি বৌদ্ধ উপসনালয় এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী এক্সচেঞ্জসহ ডজনখানেক মানি ট্রান্সফার এজেন্সি। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী এক্সচেঞ্জ এবং অন্য এজেন্সিগুলোর মাধ্যমে মিশিগান থেকে প্রতিবছর প্রবাসী বাংলাদেশিরা কয়েক মিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়ে থাকেন।
পৃথিবীর বৃহৎ তিনটি মোটরগাড়ি কোম্পানি জেনারেল মোটরস, ফোর্ড ও ক্রাইসলারের বৈশ্বিক সদর দপ্তর মিশিগানে অবস্থিত হওয়ার সুবাদে এখানে গড়ে উঠেছে দুনিয়ার বৃহত্তম ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, ছোট–বড় মিলিয়ে যন্ত্রাংশ তৈরির লক্ষাধিক কারখানা। কর্মসংস্থানের সুবর্ণ সুযোগ থাকায় হাজার হাজার বাংলাদেশি পুরুষ ও নারী বিভিন্ন কোম্পানিতে কাজ করে থাকেন। শ্রমজীবী মানুষের পাশাপাশি এখানে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো অঙ্গরাজ্যের তুলনায় সর্বাধিকসংখ্যক উচ্চশিক্ষিত বাংলাদেশি জনগোষ্ঠী। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন প্রকৌশলী, চিকিৎসক, অ্যাটর্নি, ব্যাংকার, সরকারী কর্মচারী-কর্মকর্তা, অ্যাকাউন্ট্যান্ট এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। জেনারেল মোটরস, ফোর্ড, ক্রাইসলার ছাড়াও অন্যান্য মোটরগাড়ি কোম্পানিগুলোর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন বাংলাদেশি প্রকৌশলীরা। তাঁদের সংখ্যা হবে প্রায় ১০ হাজার। বাংলাদেশিদের রাজধানীখ্যাত মিশিগানের প্রাচীন জনপদ হ্যামট্রামিক শহরের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা বাংলাদেশি, এই শহরে দীর্ঘদিন ধরে সিটি কাউন্সিলের সংখ্যাগরিষ্ঠ পদে রয়েছেন বাংলাদেশি আমেরিকান কাউন্সিলম্যান। বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি–অধ্যুষিত হওয়ায় ২০১৫ সালের ৬ নভেম্বর মিশিগান স্টেট গভর্নর রিক স্নাইডার ডেট্রয়েট ও হ্যামট্রামিক শহরের একাংশকে বাংলাটাউন হিসেবে স্বীকৃতি দেন এবং এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এর উদ্ভোদন করেন।
প্রবাসীদের সংখ্যা, বৈদেশিক মুদ্রা ছাড়াও মিশিগানের ভৌগোলিক অবস্থানও বিবেচ্য বিষয়। এখানে কনসুলেট স্থাপিত হলে শিকাগো, ওহাইও, ইন্ডিয়ানা, পেনসিলভানিয়া, উইসকনসিন, এমনকি কানাডার ওন্টারিও প্রদেশে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা কনসুলেট–সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। বাংলাদেশ সরকার এখানে কনসুলেট স্থাপন করলে ব্যয় মেটানোর পরও প্রচুর অর্থ আয় হবে, কারণ মিশিগানে বাংলাদেশিদের সংখ্যা ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিভিন্ন স্টেট ও বাংলাদেশ থেকে প্রচুরসংখ্যক মানুষ প্রতিদিন এখানে আসছেন। সুতরাং এখানে স্থায়ী কনসুলেট স্থাপিত হলে মানুষ সহজে যেমন কনসুলেটের বিভিন্ন সেবা পাবেন, তেমনি দেশও উপকৃত হবে। কনসুলেট স্থাপিত হলে দেশে টাকা পাঠানোর পরিমাণ ও বিভিন্ন খাতে প্রবাসীদের বিনিয়োগ কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে।
নতুন পাসপোর্ট, পাসপোর্ট নবায়ন, এনভিআর, পাওয়ার অব অ্যাটর্নি ছাড়াও কনসুলেট–সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজের জন্য হিমশিম খাচ্ছেন প্রবাসীরা। অতিরিক্ত ব্যয় ও সময়ের স্বল্পতার কারণে কর্মজীবী মানুষের পক্ষে ওয়াশিংটন ডিসিতে গিয়ে কনসুলেট সার্ভিস নেওয়া খুবই কষ্টসাধ্য। এ ছাড়া কোভিড ও মূল্যস্ফীতি মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে। পাসপোর্ট ও ভ্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সময়মতো হাতে না পাওয়ায় প্রবাসীরা আর্থিকভাবে প্রচুর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তা ছাড়া পরিবারের সদস্য কিংবা নিকট আত্মীয়দের অসুখ–বিসুখ অথবা তাঁদের জীবনের শেষ সময়ে প্রচণ্ড ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দেখা করা অনেক সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। দু–এক বছর পর পর ভ্রাম্যমাণ কনসুলেট এলেও বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রয়োজন মেটাতে তাঁরা সক্ষম হচ্ছেন না।
সম্প্রতি বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে ইকোনমিক মিনিস্টার মেহেদী হাসান এসেছিলেন মতবিনিময়ের জন্য। তাঁর কাছেও বার্তাটি তুলে ধরা হয়েছে।
গণস্বাক্ষরসহ বিভিন্ন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় মিশিগানে স্থায়ী কনসুলেট স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপ কামনা করছেন মিশিগান প্রবাসীরা।
• লেখক: সৈয়দ শাহেদুল হক, সভাপতি, বাংলা প্রেসক্লাব, মিশিগান, যুক্তরাষ্ট্র