যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসক হতে চাই সঠিক পরিকল্পনা
যুক্তরাষ্ট্রের সফল এক চিকিৎসকের নাম এজাজ আহমেদ। বর্তমানে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হিসেবে ক্যালিফোর্নিয়ার কায়জার পারমানেন্টে থ্রাইবে কাজ করছেন।
১৯৬৭ সালে চট্টগ্রামের পটিয়ায় জন্ম ডা. এজাজের। জন্মের পর পর স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পূর্ব শত্রুতার জের ধরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের দুইটি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। তাই সপরিবারে পাড়ি জমান ঢাকায়। নতুন আবাসস্থলে তাঁর শৈশব ভালোই কাটছিল। জাতীয় সংসদ এলাকায় বন্ধুদের সঙ্গে বৃষ্টির পানিতে ঝাঁপাঝাঁপি কিংবা দৌড়াদৌড়ি করেই কেটেছে শৈশবের বেশির ভাগ সময়। কিন্তু নতুন এই আবাসস্থলও বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবার সপরিবারে চলে আসেন নিজের আদি ভিটা চট্টগ্রামে। শৈশব থেকে ঢাকা-চট্টগ্রামে দৌড়াদৌড়ি করায় কখনো একই বিদ্যালয়ে বেশি দিন পড়ার সুযোগ হয়নি। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, চট্টগ্রাম মাওয়া স্কুল ও কলেজিয়েট স্কুলে বিভিন্ন ক্লাসে পড়াশোনার পর সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে। ব্যবসায়ী বাবা ছিলেন তাঁর অভিভাবক। বাবাই ক্যাডেট কলেজে ভর্তির সব তথ্য জোগাড় করে দেন। ক্যাডেট কলেজে ভর্তি তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল বলে তিনি মনে করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন বলেছিলেন, ‘সময়কে যদি ঠিকমতো ব্যবহার করা যায়, তবে কেউই সময় নিয়ে অভিযোগ করবে না। তুমি যদি সময়কে ঠিকমতো ব্যবহার করো, তবে কাজের পরিমাণ দেখে তুমি নিজেই অবাক হয়ে যাবে।’
ক্যাডেট কলেজের সেই নিয়মতান্ত্রিক জীবন, সময়ানুবর্তিতা ডা. এজাজের জীবনে সাফল্য এনে দিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৮৩ সালে ক্যাডেট কলেজ থেকে সাফল্যের সঙ্গে মাধ্যমিক ও ১৯৮৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পর ১৯৮৬ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ক্যাডেট কলেজে যারা পড়াশোনা করে, তাদের বেশির ভাগের ইচ্ছা থাকে আর্মি বা সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়ার। কিন্তু তাঁর কাছে বেসামরিক জীবনই বেশি ভালো লাগত। তাই মেডিকেলে ভর্তি হওয়া। ১৯৯৪ সালে মেডিকেল পাস করে বের হন।
ডা. এজাজের বাবার ইচ্ছা ছিল, ছেলে বাইরের কোনো দেশ থেকে ডিগ্রি নিয়ে এসে বাংলাদেশের মানুষের সেবা করবে। বাইরের কোনো দেশ থেকে ডিগ্রি নিয়ে আসলে এ দেশের শিক্ষা ও চিকিৎসার মান আরও উন্নত হবে বলে বাবার বিশ্বাস ছিল। বাইরে পড়তে যেতে তাঁর বাবাই জিআরই, টোফেল সব পরীক্ষা সম্পর্কিত তথ্য জোগাড় করে দেন। মেডিকেলে পড়াশোনা শেষ করেই বৃত্তি নিয়ে সুইডেনের ক্যারোলিন্সকা ইনস্টিটিউটে মাস্টার্স করতে চলে যান। একই প্রতিষ্ঠান থেকে মাস্টার্স এবং কার্ডিওভাস্কুলার মেডিসিনে ২০০১ সালে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। বিভিন্ন কারণে আমাদের হৃৎপিণ্ড ও মাথায় রক্ত জমাট, ব্লক হওয়ার কারণ, হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক হওয়ার কারণ নিয়ে গবেষণা করতে থাকেন তিনি। গবেষণার সুবাদে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাঁর গবেষণা উপস্থাপনা করার সুযোগও হয়। অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশে তিনি তাঁর গবেষণা উপস্থাপনের ফলে বেশ পরিচিতি লাভ করেন। সেই পরিচয়ের সূত্র ধরেই বায়োমেডিক্যাল সায়েন্সের ওপর জনপ্রিয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যালিফোর্নিয়ার সান ডিয়েগো স্ক্রিপস রিসার্চ ইনস্টিটিউট থেকে সায়েন্টিস্ট হিসেবে কাজ করার আমন্ত্রণও আসে।
মানুষের সেবা করার উদ্দেশ্যে বাবা ছেলেকে দেশের বাইরে পাঠালেও হঠাৎই এজাজ আহমেদের মাথায় আসল, গবেষণার কালনে দীর্ঘদিন ধরে তিনি চিকিৎসা পেশায় নেই। ফলে রোগীর সঙ্গে সরাসরি সংস্পর্শে থাকার সুযোগ ভীষণভাবে মিস করছেন। তাই সিদ্ধান্ত নিলেন, ইউএসএমএলই পরীক্ষা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা সেবায় যোগ দেবেন। গবেষণার পাশাপাশি তিনি এ কঠিন পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। নিজের লক্ষ্যে অটুট থাকলে যেকোনো কিছুই বাস্তবায়ন করা সম্ভব আর যারা সব বাঁধা-বিপত্তি পেছনে ফেলে দিনরাত এক করে পরিশ্রম করতে পারে, তারাই হয়তো নিজের অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়।
চিকিৎসক এজাজও ইউএসএমএলইয়ের বাঁধা টপকে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা সেবায় যোগ দেওয়ার সুযোগ পান। ২০০৫ সালে নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে একটি হাসপাতালে রেসিডেন্সির প্রথম বছর শেষ করার পর নিউইয়র্ক শহর ভালো না লাগায় আবার ক্যালিফোর্নিয়াতে চলে যান। সেখানে ক্যালিফোর্নিয়ার সান্টা ক্লারা কায়জার হাসপাতাল থেকে রেসিডেন্সির বাকি দুই বছর সম্পন্ন করেন। তারপর ২০০৯ সালে ফিজিশিয়ান হিসেবে কাজ শুরু করেন। একজন ডাক্তার হিসেবে তিনি তাঁর পেশা বেশ উপভোগ করেন। নিজের অনুভূতি জানাতে গিয়ে বলেন, কোনো রোগী সুস্থ হওয়ার পর যে মানসিক প্রশান্তি পাওয়া যায়, তা হয়তো আর কোনো কিছুতে পাওয়া সম্ভব নয়। আবার অনেক সময় রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয় না, তখন খুবই খারাপ লাগে।
বাংলাদেশ থেকে যারা এমবিবিএস পাস করে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন, তারা পর্যাপ্ত জ্ঞান ও তথ্যের অভাবে অনেক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। ফলে এ দেশে এসে ভালো ক্যারিয়ার নির্বাচন করতে পারেন না। আবার অনেকে ইউএসএমএলই পরীক্ষার ভয়ে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্নও বাদ দিয়ে দেন। কিন্তু ডা. এজাজ আহমেদ মনে করেন, কারও যদি যুক্তরাষ্ট্রে এসেও চিকিৎসা সেবায় যোগ দেওয়ার ইচ্ছা থাকে, তাহলে সঠিক পরিকল্পনা করে প্রস্তুতি নিতে পারলে এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব। যদিও পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া, পাস করা এবং পরবর্তীতে রেসিডেন্সি শেষ করা চ্যালেঞ্জিং এবং সময়সাপেক্ষ। কিন্তু এ বাঁধা অতিক্রম করতে পারলে সামনে সুন্দর ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। তিনি আশা করেন, বাংলাদেশ আরও অনেক চিকিৎসক যুক্তরাষ্ট্রে এসে একদিন চিকিৎসা সেবায় যোগ দিতে সক্ষম হবে।