যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়াটা অনেক সহজ

যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সদস্য হওয়া বেশ সহজ একটি প্রক্রিয়া মনে হয়েছে আমার কাছে। কেননা, আমি নিজে মেয়ে, কিছুটা মোটা এবং কম উচ্চতার হওয়া সত্ত্বেও প্রায় আমার চাকরিটা হয়েই গিয়েছিল। হ্যাঁ, যাঁদের গ্রিনকার্ড আছে এবং যাঁরা চ্যালেঞ্জ নিতে চান, তাঁদের জন্যেই লিখছি নিজের অভিজ্ঞতার কথা।

গত বছর যুক্তরাষ্ট্র পাড়ি দেওয়ার আগে অনেক স্বপ্ন ছিল, অনেক কিছুই করব। পারিবারিক অভিবাসনের ফলে এখানে চলে এলাম। কিন্তু এসে দেখি এখানে তো কেউ আমার জন্য ফুলের ডালা নিয়ে অপেক্ষা করছে না। বরং জীবনধারণের তিক্ত বাস্তবতাই টের পাচ্ছিলাম দিন দিন। হাতের কাছে টুকটাক কাজের ব্যবস্থা আছে যার প্রতিটাই নিম্ন আয়ের, এদেশিরা সেটাকে বলে অড জব। তো এই অড জব করে কত দিনই বা টিকে থাকব! তাই একদিন ইউএস আর্মির ওয়েবসাইটে গেলাম কৌতূহলবশে। দেখলাম, ওদের স্থানীয় নিয়োগকেন্দ্র আমার বাসা থেকে মাত্র ১০টি রাস্তার পরে।
পরের দিন অফিসে চলে গেলাম, একটু ভয় ভয় করছিল। বললাম, আমি সৈনিক হিসেবে যোগ দিতে চাই। আমাকে জিজ্ঞেস করল গ্রিনকার্ড আর হাইস্কুল ডিপ্লোমা আছে কি না, ব্যাস এটুকু। উচ্চতা, বয়স কোনো ব্যাপার না। এরা শুধু দেখবে বয়স ও উচ্চতার সঙ্গে ওজন সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না। আমার ওজন ও উচ্চতা মেপে বলল, উচ্চতা অনুযায়ী আমার ওজন ২৫ পাউন্ড বেশি। আমি হেসে বললাম, ২৫ পাউন্ড কমানো তো প্রায় অসম্ভব। ওরা আমাকে আশ্বস্ত করল যে ২৫ পাউন্ড ওজন খুব সহজে তিন মাসে কমাতে পারব, যদি ওদের রুটিনে চলি। আমি বেশি কিছু না ভেবেই বললাম রাজি।
আমাকে জিজ্ঞেস করল আমি ফুলটাইম না পার্টটাইম কীভাবে কাজ করতে চাই? আমি একটু অবাক হলাম, আর্মিতে আবার ফুলটাইম, পার্টটাইম কী? এতক্ষণে লোকটা আমাকে বলে দিয়েছে সবাই তাঁকে সার্জেন্ট ভি বলে ডাকে। সার্জেন্ট ভি আমাকে বলল ফুলটাইম হলে বেতনের পাশাপাশি পড়ার খরচ, বাসাভাড়া, খাবার খরচ পাব। আর যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে যেতে হতে পারে যেকোনো সময়। আর পার্টটাইম হলে বেতনের বাইরে অন্য কোনো সুবিধা পাব না। শুধু নিউইয়র্কে কাজ করতে হবে। প্রতি সপ্তাহে ২০ ঘণ্টার চাকরি।
একদিন সার্জেন্টকে জিজ্ঞেস করলাম, বিবাহিত ব্যক্তিরা যোগ দিতে পারে কি না? আমার প্রশ্ন শুনে বিরক্তির সঙ্গে বলল হ্যাঁ, কেন নয়? আমি আবার জানতে চাইলাম, অবিবাহিত ব্যক্তিরা যোগ দিলে কত দিন পর বিয়ের অনুমতি পায়? আমি প্রশ্ন করে বোকা হয়ে গেলাম। আর্মিতে জয়েন করার পরের দিনও বিয়ে করতে পারবেন এটা আপনার ইচ্ছা।
সার্জেন্ট ভি সাহেব, ওই দিনই একটা পরীক্ষা নিল অঙ্ক আর ইংরেজির ওপর। আর বলে দিল ওজন কমলে চূড়ান্ত পরীক্ষা নেবে। বাসায় কিছু না জানিয়েই আর্মি রুটিন ফলো করতাম। ছুটির দিনে নিয়মিত ওদের সঙ্গে মাঠে যেতাম। আমাদের দলে ২০ জন ছিল। আমি বাংলাদেশি। অন্যরা ইন্ডিয়ান, কোরিয়ান, স্পানিশ আর কিছু আফ্রিকান আমেরিকান। তো আমি দুই মাসে কমিয়ে ফেললাম ২০ পাউন্ড।
ইউএস আর্মির নিয়োগ দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী সার্জেন্ট তখন আমাকে একটি US ARMY লেখা টি-শার্ট আর ট্রাউজার দিল। অর্থাৎ ট্রেনিংপ্রাপ্ত ২০ জনের আর্মিতে যোগ দেওয়ার প্রাথমিক ধাপটি আমরা পার করেছি। এখন বাদবাকি আনুষ্ঠানিকতা এবং যোগদান-পরবর্তী প্রশিক্ষণ ও অন্য কিছু।
টি-শার্ট পাওয়ার পর বাসায় বললাম আমি আর্মিতে জয়েন করব। বাসার সবাই হেসে উড়িয়ে দিল। কয়েকজন তো বলেই দিল, আমার মতো মোটা আর খাটো মেয়েকে আর্মিতে নেবে কোন হিসেবে? যদিও তারা ২০ পাউন্ড ওজন কমানোর বিষয়টি খেয়াল করেছে। টি-শার্ট দেখে বিশ্বাস করল আমি সিরিয়াস।
যাই হোক, একজন মেয়ে হিসেবে আমি আমার আগ্রহের সীমাটাকে বাড়াতে গিয়ে আর্মিতে যোগ দিয়ে দেশসেবার কাজ করতে চেয়েছিলাম। তবে সামর্থ্য আর বাস্তবতার সীমারেখাটা মাড়াতে পারিনি। অর্থাৎ কিছু পারিবারিক আপত্তি আর পিছুটানের কারণে শেষমেশ আমার যোগ দেওয়া হয়নি আর্মিতে। তবে আমরা যারা ২০ জন একত্রে অনেক দিন প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম, তাদের অনেকেই এখন যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর গর্বিত সদস্য। আর আমাদের সেই সার্জেন্ট আমার যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত শুনে কিছুটা অবাক হয়েছিলেন। যদিও তিনি আমাকে বলে রেখেছেন, যখনই আমি মনস্থির করব, তখনই যেন যাই আর্মিতে যোগ দিতে। আমি সেই সুযোগ হয়তো কোনো একদিন নেবই ভবিষ্যতে।