১৮ এপ্রিল ২০১৯–এ প্রথম আলোর প্রধান শিরোনাম ছিল, ‘দোষ পাচ্ছে না পুলিশ, তবু হয়রান ছাত্ররা’।
গত জুলাই মাসে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়, প্রথম আলো বলছে, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ৬০টি মামলা হয়। কিছু মামলা ভয়ংকর—মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দাঙ্গাহাঙ্গামা করা, সরকারি কাজে বাধা, পুলিশের ওপর আক্রমণ, পুলিশের সরকারি যানবাহনে ভাঙচুর, বাড্ডা পুলিশ ফাঁড়িতে অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করা ইত্যদি।
গুরুতর সব অপরাধের অভিযোগ। আন্দোলনকারী ২২ ছাত্রকে এসব মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের কিছুদিনের মধ্যে তাঁরা জামিন পেয়ে যান। এখন মামলাগুলোর তদন্ত চলছে। তদন্ত করার কাজটা পুলিশের। কোন ছাত্র মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দাঙ্গাহাঙ্গামা করেছিল, কে থানায় আগুন লাগাবার চেষ্টা করেছিল, এবং একইভাবে অন্য অপরাধগুলোর সঙ্গে কে বা কারা কীভাবে জড়িত ছিল, তা নির্ধারণ করার দায়িত্ব পুলিশের। এখন প্রতি মাসে মামলাগুলো তদন্ত রিপোর্ট প্রাপ্তির জন্য আদালতে আসে; পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয় যে তদন্ত এখনো চলছে এবং পরবর্তী মাসে আরেকটা ‘তারিখ’ পড়ে। অভিযুক্ত ছাত্রদের প্রতি তারিখে আদালতে হাজির হতে হয়; অন্যথায় জামিন বাতিলের আশঙ্কা থাকে। পুলিশ বলছে, ছাত্রদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ তারা খুঁজে পাচ্ছে না কিন্তু তদন্ত চলছে। যত দিন তদন্ত চলবে, মাসে মাসে মামলার তারিখ পড়বে, তত দিন ছাত্রদের আদালতে হাজির থাকতে হবে। তাঁদের জীবন থমকে গেছে এবং আরও কত মাস বা বছর যে থমকে থাকে, তা বলা অসম্ভব।
২. বহুদিন ধরেই বলছি, আমাদের বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থায় ভিন্নমত দমনে ও সমালোচকদের টুঁটি চেপে ধরার প্রধান অস্ত্র এখন ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা। প্রায় সব সময় সব দেশেই ফৌজদারি বিচারব্যবস্থাটা রাষ্ট্রের একটা মারাত্মক অস্ত্র। এই অস্ত্রটা রাষ্ট্র প্রায়শই ভালো কাজে ব্যবহার করে। অর্থাৎ, অপরাধীদের নিবৃত্ত রাখতে, কেউ অপরাধ করলে তাকে খুঁজে বের করতে, এবং তদন্ত করে অপরাধীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণ আদালতে হাজির করে শাস্তি নির্ধারণে সহায়তা করতে অস্ত্রটি ব্যবহৃত হয়। মাঝে ২-৪ বার এই ক্ষমতার অপব্যবহার বা অপপ্রয়োগ হয়ে যায়। নিরপরাধ ব্যক্তিও আটক হয়। সরকারের সমালোচকেরাই নিগ্রহের শিকার হয় কিন্তু এইসব থেকে যায় ব্যতিক্রম হিসেবে। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রে এই ব্যতিক্রমটাই প্রধান রীতি হয়ে গেছে বহু বছর ধরে, যার শুরুর সময়টা, অধমের হিসাবে অক্টোবর ২০০২ থেকে।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকারীরা অন্যের অনিষ্ট করতে চায়নি। তারা চেয়েছিল সমাজের অন্তত একটা দিন যাতে ভালো হয় সেই চেষ্টা করতে। সড়কে যাতে বেঘোরে প্রাণনাশ না হয়, সড়ক যাতে নিরাপদ থাকে, সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে অক্ষত অবস্থায় সন্ধ্যায় বা রাতে ঘরে ফেরা যায়, সেটা নিশ্চিত করতে চেয়েছিল নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের ছাত্রছাত্রীরা। তাদের এই দাবিদাওয়া ও আন্দোলনে কেউ কোনো অপরাধ খুঁজে পায়নি। কিন্তু যা কিছু ভালো, সেটাকে নষ্ট করাই আজকাল আমাদের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার কাজ। তাই যারা সমাজের ভালো চেয়েছিল, এখন তদন্তের নামে তাদের ভোগান্তি চরমে।
৩. রাষ্ট্রের ন্যূনতম কিছু ভালো গুণ থাকলে তদন্ত কর্মকর্তা—বলা বাহুল্য, সাক্ষ্য প্রমাণ সাপেক্ষে—এই উপসংহারে উপনীত হতেন যে যাঁদের অভিযুক্ত করে মামলার তদন্ত শুরু হয়েছিল, ৮-১০ মাস খোঁজাখুঁজি করে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলায় জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ, এই ২২ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো প্রমাণিত হয়নি। অতএব, তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতে আবেদন করতে পারেন, যাতে এই ২২ জন ছাত্রকে মামলাগুলো থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। কিন্তু সে আশাটি হবে আকাশকুসুম। কারণ, সভ্য রাষ্ট্রে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে, ন্যায়বিচারের রাষ্ট্রে নাগরিকদের হেনস্তা করা, ভোগান্তি নিশ্চিত করা, হয়রানি করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধান উদ্দেশ্য ও কাজ না। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা এখন আর সভ্য, গণতান্ত্রিক, বিচার আর ন্যায়বিচারের দেশ না। অতএব, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের এই ২২ জন অভিযুক্ত তরুণ ছাত্র আরও বহুদিন রাষ্ট্রীয় অত্যাচারের শিকার হয়ে থাকবেন। কারণ, অত্যাচার করাই রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান কাজ।
লেখক: সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী