
এমন চমৎকার ঝকঝকে রোদ চারদিকে। মন ভালো করে দেয়। আমার মন কিন্তু ভালো হয় না। রোদের আলোয় ভর করে মন ছুটে যায় শাজাহানপুরে। বাংলাদেশে আমার মা-বাবা আর ছোট্ট বোনটার কাছে। কেমন আছে তারা? ভীষণ অস্থির লাগে। খুব ইচ্ছে করে একটু ফোন করি। দুপুরের রোদের আলোয় চোখ রাখি। কখন রোদ ফুরিয়ে আকাশের রং বদলাবে। অপেক্ষা ছাড়া উপায় নেই। আটলান্টিকের ওপারে যখন আমার দিনের শেষ, তখন ওদের শুরু। এখন বাংলাদেশে মাঝ রাত। ফোনের কার্ড হাতে নিয়ে আমি সূর্য ডোবার অপেক্ষা করি।
আমরা তিন বোন, এক ভাই। আমার ছোট বোন মেহেরুন নিসা মালা। ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে ল পাস করে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের জুনিয়র ল’ইয়ার হিসেবে কাজ শুরু করল হাইকোর্টে। তারপর থেকে সে স্বপ্ন দেখতে থাকল ব্যারিস্টারি পড়তে যাবে লন্ডন। অবশেষে একদিন সত্যিই সে লন্ডন চলে গেল। এক বছর পর আমাদের একমাত্র ভাই নাজমুলকে নিয়ে গেল বিবিএ পড়ার জন্য। এর দু বছর পর আমিও পাড়ি দিলাম কানাডা। আব্বা-আম্মা বাংলাদেশে রয়ে গেলেন ছোট বোন শীলাকে নিয়ে। শীলার কাছে আব্বাকে রেখে ভীষণ স্বার্থপরের মতো আমরা তিন ভাইবোন বিদেশে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত রইলাম।
হঠাৎ যেন টেন মেসির ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে আমার দম বন্ধ অস্থিরতা পেয়ে বসল। ছুটে গেলাম রান্নাঘরে। ওখানে ড্রয়ারে আছে ছোট একটা পুরোনো ছবির অ্যালবাম। অ্যালবামের পাতা উলটাতেই আব্বার একটা ছবি। কী যে চমৎকার দেখতে আমার আব্বা। ঠিক যেন অমিতাভ বচ্চন। আঙুল ছুঁয়ে দিলাম, স্পর্শ করতে চাইলাম তার চমৎকার মায়াময় মুখটা। কত কথাই না মনে পড়ছিল সে মুহূর্তে।
মনে পড়ে আমার বিয়ের আগের কথা। রাতে বিছানায় বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যেতাম। মশারি টানাতে ভুলে যেতাম কিংবা আলসেমি লাগত। সকালে উঠে দেখতাম আমি মশারির ভেতর শুয়ে আছি। প্রতিদিনই এমন হতো। একদিন কী একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলতেই দেখি আব্বা মশারির কোনা বাধছেন। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে বললাম, আব্বা কি করেন আপনি?
বাবা মশারিটা না টানাইয়া ঘুমাও প্রত্যেক দিন। মশা তো রক্ত খেয়ে শেষ করে ফেলবে।
সেদিন জানলাম আমার মশারি কার ভালোবাসায় ছোঁয়া দিয়ে বাধা হয় প্রতিদিন। কে আমাকে রক্ষা করতে চায় রক্ত চোষা মশা থেকে। বিয়ের পরও আমি আর রোদেলা আব্বার বাসায় থাকলে প্রতিরাতে খুবই যত্ন করে মশারি গুঁজে রাখা হতো আমাদের মা-মেয়ের জন্য।
আমার এসএসসি ও ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার সময়ের কথা, আব্বা প্রতিবারই লম্বা ছুটি নিতেন। অফিসের জিপ গাড়িতে রাস্তার পাশে বসে থাকতেন। গাড়ি থেকে আমাকে দেখা যেত। গাড়িতে বসে সারা দিন আমার দিকে তাকিয়ে থাকতেন।
একবার এসএসসি পরীক্ষার সময় আমার কলমের কালি শেষ হয়ে গেল। রুমের সবাইকে অবাক করে দিয়ে একটা ছোট্ট ছেলে এসে দরজায় দাঁড়াল। ক্লাসের শিক্ষকের দিকে তাকিয়ে বলল, নেন আফারে কলমডা দেন।
শিক্ষক তো মহা আশ্চর্য। কে দিয়েছে?
ওই যে সাহেব জিপে বইসা রইছে। হের মাইয়ারে পাঠাইছে।

শিক্ষক অবাক হয়ে তাকালেন সবুজ জিপের দিকে। তারপর আমাকে এগিয়ে দিলেন কলমটা। আমি লজ্জায় লাল হয়ে হাত বাড়িয়ে কলমটা ধরলাম। আমি জানি না, আব্বা কী ভাবে অত দূর থেকে দেখলেন আমার কলমের কালি নেই।
দুপুরে আব্বার পাশে বসে ডাবের পানি খেতে খেতে বললাম, কেন আপনি প্রতিদিন আসেন আব্বা। এত গরমে সারা দিন জিপে বসে থাকেন। কাল থেকে আসবেন না।
আব্বা চমৎকার করে হাসলেন। আমিতো তিন সপ্তাহের ছুটি নিয়েছি বাবা তোমার পরীক্ষার জন্য।
কেন? আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম।
অফিসে টেনশন লাগত। তুমি কী করো, কী লাগে তোমার কখন।
এমনিতে পরীক্ষার চিন্তা তারপর আব্বার অতি যত্ন। আমি প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে জিপের বাইরে গনগনে রোদে তাকিয়ে থাকলাম।
আজ এত বছর পর আমার চোখ ভরে পানি টলমল করছে। সে পানি আর আটকাতেও চাই না। এত ভালোবাসা আর কে দেবে আমায়। কে ও রকম বুকভরা মায়ায় আগলে রাখবে আমাকে? টেন মেসির অন্ধকার রান্নাঘরের কাউন্টার ধরে দাঁড়িয়ে আমি আকুল হয়ে কাঁদি। পুরোনো দিনের কথা ভাবি। নিজকে ভীষণ স্বার্থপর মনে হয়। সব সময় চোখে ভাসে আব্বার অসহায় চোখ দুটো। মাইক্রোবাসের পেছনে আববার কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা।
আব্বাকে ফোন করতেই ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসে-চমৎকার এক কণ্ঠস্বর। হয়তো সে কণ্ঠ ভরাট নয়। হয়তো সে কণ্ঠে শুদ্ধ উচ্চারণ নেই। সে কণ্ঠে কী আছে জানি না। আছে অদ্ভুত এক মায়া। আমি অনেক দূরে, সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর পাড়ে সে মায়ায় আচ্ছন্ন হই। টের পাই অগাধ ভালোবাসা, অপত্য স্নেহ। আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি পিতৃস্নেহের আকুলতায়। আব্বা প্রতিদিন তার ঘোলা চোখে কালো টেলিফোনের দিকে হয়তো তাকিয়ে থাকেন। ফোনে একটা রিং হতেই সেটি রিসিভ হয়ে যায় ওপাশ থেকে।
হ্যালো কে কলি? কেমন আছ বাবা? এজাজের শরীর ভালো? নানা ভাইয়া কেমন আছে? এত প্রশ্নের উত্তর একসঙ্গে দেওয়া যায় না।
হাসতে হাসতে বলি, একসঙ্গে কত প্রশ্ন করেন আব্বা। ভালো আছি আমরা। আপনি কেমন আছেন?
ফোনের ওপাশ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। আমার শরীর বেশি ভালো না। তোমরা কবে আসতে পারবা?
কষ্টরা খামচে ধরে আমার বুক, ভীষণ কষ্ট হয়। ওপাশে আব্বাকে বুঝতে দিই না। মাত্র তো আসলাম কানাডায়। বছর খানেক পর আসব আব্বা।
তত দিন কী আর বাঁচব বাবা। আব্বার বুকভরা দীর্ঘশ্বাসে বিষাদের সুর। সে সুর বিকট শব্দ তুলে আমার বুকের পাঁজরগুলো দুমরেমুচড়ে দেয়। হয়তো আব্বার বুকের পাঁজরও আমার চেয়ে আরও বেশি চূর্ণবিচূর্ণ হয়। আমরা অবুঝ সন্তানেরা তা বুঝতে চাই না। বুঝেই বা কী করব? অত দূরে কীভাবে যাব। মনে মনে ভাবি, ইস যদি পাখি হয়ে যেতে পারতাম। ডানায় ভর করে নীল আকাশে উড়ে উড়ে বাংলাদেশে চলে যেতাম। আমি সত্যি সত্যি পাখি হয়ে যেতে চাই সে মুহূর্তে। ছোটবেলায় যেমন আব্বার কাঁধে চড়ে মেলায় যেতাম। সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিয়ে তেমনি করে ছোট্ট পাখি হয়ে আব্বার কাঁধে গিয়ে বসব।
পরদিন ট্রেনে করিম ভাই প্রশ্ন করেন আপা আপনার মন খারাপ?
কাল ফোনে আব্বার সঙ্গে কথা বলে মনটা খুবই খারাপ।
করিম ভাইও যেন একটু বিষণ্ন হন। আমি তা উপেক্ষা করে বলি, করিম ভাই, কীভাবে আমার মা-বাবাকে এ দেশে আনতে পারি?

ভিজিট ভিসায় আসতে পারে। কিন্তু চিকিৎসা সুবিধা পাবেন না সেরকম। হেলথ ইনস্যুরেন্স করতে হবে, এক বছরের জন্য দু হাজার টাকা দিয়ে। তবে শুধুমাত্র সাধারণ চিকিৎসা পাবেন। বড় অসুখ, হসপিটাল এসব কিছুই পাবেন না।
ভীষণ হতাশ হই। চিকিৎসা সুবিধা না পেলে এখানে এসে কী করবেন। আমি তো তাদের আমার সঙ্গে রাখতে চাই। বৃদ্ধ মানুষের চিকিৎসাসেবা তো বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
বাবা-মা হিসেবে স্পনসর করা যায় না?
যায় আপা, আপনাদের তিনজনের সংসারে তাঁরা দু-জন। প্রায় সত্তর আশি হাজার টাকা বাৎসরিক আয় দেখাতে হবে। করিম ভাই বিজ্ঞ লইয়ারের মতোই ভাব নিলেন। আমি সম্পূর্ণ হতাশায় নিমজ্জিত হই। এত টাকা কখনো কী আয় করতে পারব?
মনে মনে অঙ্ক কষি কীভাবে, কত টাকা আয় করলে বছরে সত্তর হাজার টাকা আয় দেখানো যায়। হিসাবটা মেলানো একটু হাস্যকরই সে মুহূর্তে। অনেক কঠিন তো বটেই।
বাসায় এসে এজাজকে গম্ভীর হয়ে প্রশ্ন করি, তুমি বাংলাদেশে ইউনিসেফে কত টাকা বেতন পেতে?
এজাজ অবাক হয়ে বলে, কেন? ওসব কথা আবার কেন তুলছ?
আমি সুটকেস খুলে ইউনিসেফের চাকরির অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা বের করি। এরপর কেন জানি আমি পাগল হয়ে গেলাম মুহূর্তে। এই দেখ তুমি আশি হাজার টাকা বেতন পেতে। আশি হাজার টাকা বেতনের চাকরি ফেলে তুমি নাচতে নাচতে কানাডায় আসলে।
আমার উন্মাদ চেহারা দেখে এজাজ অবাক হয়ে গেল, একটু যেন ভয়ও পেল।
শোন, কী হয়েছে তোমার?
আমি মেঝেতে পাতা ফোমের বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়লাম। এজাজ অবাক হয়ে, অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। ওর চোখে বিস্ময়। আমি কষ্টের পাহাড়ের চূড়োয় বসে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকলাম আমার প্রিয় বাবার জন্য। আমি বুঝতে পারছি স্পষ্ট, পাহাড় থেকে নামার সব পথ বিলীন হয়ে গেছে।
আর আমার আব্বা? আব্বা হয়তো বারান্দায় রাখা পুরোনো কাঠের ইজি চেয়ারটায় বসে আছেন। একাকী, আমার চেয়ে আরও বেশি, আরও বিশাল দুঃখের পাহাড় নিয়ে মাথায় নিয়ে। ঘোলাটে চোখে আমাদের আরেকটি ফোনের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। (চলবে)
ধারাবাহিক এই রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন:
http://www.prothom-alo.com/durporobash/article/613543
http://www.prothom-alo.com/durporobash/article/627919
http://www.prothom-alo.com/durporobash/article/632575
http://www.prothom-alo.com/durporobash/article/641398
http://www.prothom-alo.com/durporobash/article/643861
http://www.prothom-alo.com/durporobash/article/656035
http://www.prothom-alo.com/durporobash/article/664282
http://www.prothom-alo.com/durporobash/article/705639
http://www.prothom-alo.com/durporobash/article/691222
http://www.prothom-alo.com/durporobash/article/726331
http://www.prothom-alo.com/durporobash/article/733858
http://www.prothom-alo.com/durporobash/article/742651
http://www.prothom-alo.com/durporobash/article/746662