যাপিত জীবনের দিনলিপি-১০

ক্রিসমাসের সাজ
ক্রিসমাসের সাজ

চারিদিকে উৎসবের আমেজ। লাল, সবুজ, আর সাদা রঙে রঙিন হয়ে আছে শহর। সাজ সাজ রব চারিদিকে। রাতেরবেলার বরফ ঢাকা শহরে আলো ঝলমলে রূপ। ক্রিসমাস বলে কথা। দোকানে সাজানো নানা রকম পণ্য—ক্রিসমাস উপহার, চকমক কাগজে লাল-সাদা বো দোকানের দেয়ালে ঝুলছে। প্লাস্টিকের পুতুলগুলো লাল-সাদা শীতের পোশাকে মোহনীয় রূপে তাকিয়ে আছে খদ্দেরের দিকে। কানাডীয়রা ব্যস্ত কেনাকাটা নিয়ে। ক্রিসমাস কারড, মোজা, বাথ সুট, গিফট কার্ড কোনোটাই বাদ যাচ্ছে না উপহারের লম্বা লিস্ট থেকে।
লাল-সাদা পোশাকে মাথায় লম্বা টুপি পরে সান্তাক্লজ বসে আছে শপিং মলের সিংহাসনে। ফটো সেশন চলছে বাচ্চাদের সঙ্গে কিংবা পুরো পরিবারের সঙ্গে। উপহার বিনিময়, পরিবার-বন্ধু মিলে একসঙ্গে রাতের খাবার খাওয়া, এভাবেই সবাই মেতে ওঠে ক্রিসমাস উৎসবে।
আমরাও এক কনকনে শীতের সন্ধ্যায় তৈরি হলাম জ্যাকুলিনের বাসায় যাওয়ার জন্য। জ্যাকুলিন আমার প্রথম কানাডীয় বন্ধু। ওর সঙ্গে পরিচয় রোদেলার স্কুলে। এরই মাঝে রোদেলার স্কুলে কাজ শুরু করেছি। এরা বলে ভলান্টিয়ার ওয়ার্ক। বিনা বেতনে কাজ।
ওখানেই শিক্ষকের সহকারী হিসেবে কাজ করে জ্যাকুলিন। এরা বলে এডুকেশনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট (EA)। প্রচণ্ড ভদ্র, দয়ালু একটি মেয়ে। আমাদের বন্ধুত্ব হতে সময় লাগল না।
বন্ধুত্বের শুরুটা এ রকম—একদিন স্কুলে সমুচা নিয়ে গিয়েছিলাম। ওকে বললাম, খাও বাংলাদেশি খাবার। সে একটু মুখে দিল। ওর মুখে তৃপ্তির ছোঁয়া। ভাবখানা এমন, এত মজার খাবার জীবনেও খায়নি। আমার রাঁধুনি জীবন সার্থক বলা যায়। কারণ সেদিনই প্রথম সমুচা বানিয়েছি। আমি আনন্দিত চোখে ওর তৃপ্তি করে খাওয়া দেখতে লাগলাম।
অসম্ভব মুগ্ধতা নিয়ে বাসায় এসে এজাজকে বললাম, জ্যাকুলিন বাংলাদেশি খাবার খুব পছন্দ করেছে।
শুনে এজাজ বলে, বাদ দাও, এরা খুশি করার জন্য বলে এ রকম। তবে এজাজ যাই-ই বলুক, জ্যাকুলিন আর আমি বন্ধু হয়ে গেলাম। যদিও আমাদের বয়সের দূরত্ব বেশ। তাতে কী? বন্ধুত্ব তো আর ওসব বিবেচনা করে হয় না। আমার আগ্রহই অবশ্য বেশি ছিল। মনে গোপন বাসনা, আমার ভাঙাচোরা ইংরেজিটা যদি ওর সঙ্গে কথা বলে একটু পোক্ত হয়। এরা মূলত খুব ঘনিষ্ঠ না হলে বাসায় কাউকে আমন্ত্রণ করে না। কিন্তু আমাকে ডেকেছে, কারণ আমি বাংলাদেশি বিরিয়ানি আর কোর্মা খাইয়ে ওকে মোটামুটি কুপোকাত করে ফেলেছি।
ক্রিসমাস ডিনার। আমি আর এজাজ সাবওয়ে (মাটির নিচের ট্রেন লাইন) ধরে জ্যাকুলিনের বাসায় রওনা হলাম। এদিকে কনকনে বাতাস হাড্ডির ভেতর সুইয়ের ফোড়ের মতো ঠুকছে যেন। আমাদের পরনে ভারী জ্যাকেট, মাথায় টুপি, হাতে হাত মোজা। এর পরেও শীতে জবুথবু হয়ে জ্যাকুলিনের বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ালাম। লাল-সবুজ আর সোনালি বাতির ঝালরে ঠেকে আছে ওর ছাদের কার্নিশ।

সান্তা ক্লজের সঙ্গে শিশুরা
সান্তা ক্লজের সঙ্গে শিশুরা

দরজায় বেল বাজাতেই লম্বা-ফরসা সোনালি চুলের মাঝবয়সী একজন পুরুষ দরজা খুলে দিলেন। ইংরেজিতে বললেন, কেমন আছ? আমি জ্যাকির ছেলেবন্ধু, এডাম। হাত বাড়িয়ে দিল আমার দিকে।
আমি কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে আমার হাতও বাড়ালাম। এটাই কানাডীয় নিয়ম। হাতটা কিন্তু বেশ নরমই। মেয়েদের মতো। ওর মুখটা এখনো হাসি হাসি। আমিও জোর করে হাসি চাপিয়ে রাখলাম চেহারায়। মনে বেশ অস্বস্তি, শুধু ওর বাড়ানো হাতেই না, অস্বস্তি লাগছিল ওই বয়ফ্রেন্ড শব্দটাতেও। জুতা খুলে, জ্যাকেট পাশের ক্লোজেটে রাখলাম।
আমি এজাজকে পরিচয় করিয়ে দিলাম—আমার হাজব্যান্ড। সে এজাজের দিকেও হাত বাড়িয়ে দিল।
সাদা সোফাতে বসতে বসতে ওর লিভিং রুমে চোখ বুলিয়ে নিলাম। বেশ সুন্দর করে সাজানো রুমটা। এককোনায় একটা ক্রিসমাস ট্রি। চমৎকার করে সাজানো লাল-নীল বাতি দিয়ে। তার নিচে র‍্যাপিং পেপারে সাজানো উপহারের প্যাকেট।
জ্যাকুলিনের বয়ফ্রেন্ড বলল, কি খাবে চা, কফি, নাকি ওয়াইন?
আমি মাথা নাড়লাম, না কিছু খাব না।
কিন্তু এজাজ বলল, হ্যাঁ চা খেতে পারি। সে হাসল একটু, তারপর রান্নাঘরে পা বাড়াল।
আমি এজাজকে ফিস ফিস করে বললাম, বয়ফ্রেন্ড বলল যে? বিয়ে হয়নি মনে হয়। এজাজ কিছু বলার আগেই জ্যাকুলিন চলে এসেছে।
সে একটা লাল শার্ট আর সাদা প্যান্ট পরেছে। সোনালি চুলগুলো ছোট করে কাটা, কাঁধ ছুঁয়েছে। বয়স ২৬-২৭, দেখলে মনে হয় আরও কম। চেহারাটা বেশ মিষ্টি। এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরল। ওর গায়ে চমৎকার মিষ্টি গন্ধ। সেই গন্ধে আমার মন ভরে গেল। জ্যাকুলিন আলাপী মেয়ে। এজাজের সঙ্গে গল্প জমাতে তার সময় লাগল না।

আমরা সবাই ডাইনিং টেবিলে বসলাম। টেবিলে সাজানো কাচা ফুলকপি, ব্রুকলি, টমেটো ও শসা। বেক করা চিকেন, বিস্কুটের সঙ্গে চিজ ও জুস। একটা প্লেটে নানা রকম ফল। খাবারের নমুনা দেখে তো আমার আক্কেল গুড়ুম। এজাজের দিকে তাকালাম। সে আমাকে পাত্তা না দিয়ে কাচা সবজি, বেক করা চিকেন, হাপুস হুপুস খেতে লাগল। আমারও খিদে পেয়েছে অনেক, কিন্তু কিন্তু এসব কাচা সবজি বেক করা মুরগি কীভাবে খাব তাই ভাবছিলাম।
মনে মনে ভাবলাম, তোমারে কত বিরিয়ানি আর সমুচা খাইয়েছি জ্যাকুলিন। আর তুমি কিনা আমারে এই খেতে দিলা? কী আর করা, বাধ্য হয়ে একটা বিস্কুট আর চিজের টুকরো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলাম। এজাজ এক গ্লাস জুস রাখল আমার সামনে। ফিস ফিস করে বলল, জুস খেয়েই পেট ভরাও।
সোনালি চুলে ছাই রং জ্যাকেটে জ্যাকুলিন। স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে তোলা ছবি।
জ্যাকুলিনের বাড়িতে আরও অতিথি এসেছে। সে তাদের সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত। ওরা এত দ্রুত কথা বলছে যে, আমি কিছুই মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছি না। জ্যাকুলিন আমাকে ডাকল, কলি আসো এখানে।
আমি উঠে রান্নাঘরে গেলাম। জ্যাকুলিন বসে ছিল একটা উঁচু চেয়ারে। ওর পাশেই বসেছিল লম্বা, ফরসা, শুকনো মতো একজন। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখ আমার এক্স বয়ফেন্ডের স্ত্রী।

জ্যাকুলিনের বন্ধুদের সঙ্গে লেখিকা
জ্যাকুলিনের বন্ধুদের সঙ্গে লেখিকা

আমার চোখ ছানাবড়া হলো। মনে মনে ভাবলাম, বলে কী! মুখে তো আর সেটা বলা যায় না। হাসি হাসি মুখ করে তার দিকে তাকালাম। জ্যাকুলিন চমৎকার করে হাসল। বলল, আমার বড় ছেলে রায়ানের বাবার স্ত্রী।
এবার প্রচণ্ড ধাক্কা খেলাম। পানি খাচ্ছিলাম, সে পানি গলায় আটকে গেল যেন। আমি একটা বড় রকম বিষম খেলাম। এতক্ষণ বয়ফ্রেন্ড শব্দটাই হজম করতে পারছিলাম না। এখন আবার একস বয়ফ্রেন্ড আবার তার ওয়াইফ। এসব কী বলে জ্যাকি।
আমি জানতাম, জ্যাকির দুটা বাচ্চা। প্রথম ছেলের নাম রায়ান, তার বয়স ছয়। এরপর একটা মেয়ে ইসাবেলা, ওর বয়স পাঁচ। ইসাবেলার বাবা আর রায়ানের বাবা ভিন্ন এ কথা তো জানতাম না।
ইসাবেলার বাবা তো এডাম, তোমার বয়ফ্রেন্ড? খুবই বোকার মতো প্রশ্ন করলাম। প্রশ্ন করে তো তা আর ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। তাই চুপ করে গেলাম।
হ্যাঁ ইসাবেলা এডামের মেয়ে, আমার সৎ মেয়ে। আমাদের সঙ্গেই থাকে সে।
আমার কাছে বড়ই বিচিত্র লাগছিল ওদের সম্পর্ক। ওদের কী মন বলে কিছুই নেই। সন্তানের বাবাকে তার নতুন স্ত্রী নিয়ে বাসায় দাওয়াত দেওয়া যায়। একটুও কষ্ট বা হিংসা নাই মনে? আর এডামই বা বিষয়টাকে কীভাবে নিচ্ছে।

সৎ ছেলেমেয়ে নিয়ে দিব্যি দুজন সংসার সাজিয়েছে। আড়চোখে লিভিং রুমে তাকালাম। এডাম বেশ উচ্ছ্বাস নিয়েই সবার সঙ্গে গল্প করছে। পাশে জ্যাকির প্রাক্তন প্রেমিক। বুঝতে পারছিলাম না কীভাবে এটা সম্ভব। সবাই মেতে আছে গল্প-গুজবে। অর্ধেক বুঝি, অর্ধেক বুঝি না। কারও হাতে বিয়ার, কারও হাতে স্যামপেন। মেয়েগুলো দেখি আবার কাচা শসা, ব্রুকলি কচকচ করে খেয়েই যাচ্ছে। আবার অকারণে হেসেই যাচ্ছে।
বাংলাদেশ থেকে এসেছি এক বছরও হয় নাই। বাংলাদেশের ভাতের গন্ধ, ডালের পানি আমার এখনো ভীষণ প্রিয়। বড় হয়েছি মফস্বলে। পড়াশোনা করেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শামসুন নাহার হলের হাউস টিউটর রেবু আপার অগ্নিচক্ষু ফাঁকি দিয়ে সন্ধ্যার পর হলের বাইরে থাকা ছিল আমাদের কল্পনারও বাইরে। আইল্যান্ডে বসে, কিংবা টিএসসির বারান্দায় বাদামের চোকলা ছিলতে ছিলতে প্রেম। এরই মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল আমাদের জীবন। এখন এই কৃত্রিম আলোর ঝাড়বাতির নিচে, ক্রিসমাস ট্রির পাশে নিজেকে ভীষণ বেমানান মনে হচ্ছিল। আমি ফতুয়ার ওপরে পরা আমার ওড়নার কোনা আঙুলে জড়াতে লাগলাম। ওড়নার ঝালরগুলো যে কখন প্যাচ লেগে গিয়েছে টেরই পাইনি। এত চেষ্টা করছি, টেবিল লাইটের মৃদু আলোয় সেই অন্ধ প্যাচ কিছুতেই ছুটছে না।

জ্যাকুলিনের সঙ্গে লেখিকা
জ্যাকুলিনের সঙ্গে লেখিকা

অনেক রাতে বাসায় ফেরার পথে স্টেশন থেকে বেরিয়ে রাস্তায় উঠতেই পা পিছলে পড়ে যাচ্ছিলাম। এজাজ শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। হাত-পা ভাঙা থেকে রক্ষা পেলাম। আলো আঁধারি রাস্তা। কোথাও কোথাও রাস্তা ঢেকে আছে স্বচ্ছ কাচের মতো বরফে। সে বরফে পা পিছলে পড়ে হাত-পা ভাঙা স্বাভাবিক। স্নো বুট পরা আছে আমার। তারপরও খুব সাবধানে নরম বরফে পা রাখি, এটাই নিরাপদ। কিন্তু পা বাড়াতেই হঠাৎ করে পা ডুবে গেল গহিন বরফে। হাঁটু পর্যন্ত ডুবে গেলাম। মনে হচ্ছিল আমিই শুধু ডুবিনি, ডুবে গেছে আমার অস্তিত্বও। বরফ ঝাড়তে ঝাড়তে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালাম কোনোরকমে। তারপর চুপচাপ হাঁটতে লাগলাম।
এজাজ বলল, কি হলো চুপচাপ যে।
আমি কথা বললাম না।
এজাজ বলল, শকড?
জানি না। হতাশ সুর বেরিয়ে এল আমার কণ্ঠে।
এজাজ অনবরত কথা বলে যাচ্ছে। লিভ টুগেদার এটাই ওদের সংস্কৃতি। অনেক দিনের সামাজিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে তারা এই ব্যবস্থাকে গ্রহণ করেছে। সমাজ একে অনুমোদন দেয়। আর তুমি যে শেড, এটা কালচারাল শেড।
আমি অতশত বুঝলাম না। কালচারাল শেড, বিশাল শকডই বটে আমার জন্য। আমার এতদিনের মূল্যবোধ, সংস্কৃতির সঙ্গে এর তো আকাশ-পাতাল তফাৎ। আমি চুপচাপ হাঁটতে লাগলাম। বরফের জুতোগুলো ভীষণ ভারী লাগছিল।

সাবওয়েতে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ট্রেন চলে এল। ট্রেনের খালি কামরায় বসে আছি। ট্রেন ছুটে চলেছে অনেক দ্রুত, শব্দ করে। মাটির নিচে ট্রেনে বসে মনে হচ্ছিল আমি এক বিশাল লম্বা গুহায় ঢুকে পড়েছি। যে গুহার গোলকধাঁধায় পাগলের মতো আমি হাতড়ে বেড়াচ্ছি আমার সংস্কৃতি, আমার দেশ, আমার কৃষ্টি।
শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে ছোট্ট একটা মফস্বল শহরে আমি বড় হয়েছি। নদীর পার ঘেঁষে জুট মিল, সার কারখানা ও বিদ্যুৎকেন্দ্র। আমার বাবা চাকরি করতেন বিদ্যুৎকেন্দ্রে। ওখানেই আমার শৈশব, কৈশোর কেটেছে গ্রামের রক্ষণশীল পরিবেশে। সার কারখানা কলেজে যখন পড়ি তখন হঠাৎ করে আমার বাসায় ঘন ঘন প্রেমপত্র আসতে লাগল। কোনো এক হতচ্ছাড়া আবার কলেজের ঠিকানায় চিঠি পাঠানো শুরু করল। অনেক চিন্তা-ভাবনা করে বাসায় সিদ্ধান্ত হলো, কলেজ যাওয়া বন্ধ আমার। বাসায় বসে প্রাইভেটে পরীক্ষা দেব। যা হোক, কোনোরকমে ইন্টারমিডিয়েট পাস করলাম। অবশেষে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে যখন ভর্তি হলাম, তখন আব্বা কঠিন গলায় বললেন, পড়তে যেতে পার কিন্তু কারও সঙ্গে যেন রাস্তায় দাঁড়িয়েও কথা বলতে না শুনি। কী কঠিন আদেশ। মুখে কিছু না বললেও মনে মনে বিরক্ত হই।
আমার মা এত রাখ-ঢাক করতে পারেন না। একদিন রান্না ঘরে ডেকে বললেন, শোন কারও সঙ্গে প্রেম ভালোবাসা করে বংশের মান-মর্যাদা কিন্তু নষ্ট করবি না। তোদের বংশে কেউ প্রেম করে নাই, এটা মনে রাখিস।
বংশের মর্যাদা বলে কথা। আমি একটু লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে বললাম, না আম্মা, কী যে বলেন। আম্মা চোখে চোখ রেখে আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করাল।
আমি চেহারায় ভালোমানুষি ফুটিয়ে মার আদেশ বাধ্য মেয়ের মতো মেনে নিলাম।
যে পরিবারে প্রেম-ভালোবাসা এমন নিষিদ্ধ, সেখানে আমার বেড়ে ওঠা। যতই পড়াশোনা করি, আর বিদেশে পাড়ি দিই, মূল্যবোধ তো সেভাবে বদলায়নি। তাই আজ সকালে যখন জ্যাকুলিন ফোন করল, সে আসছে, আমি একটু বিব্রত বোধ করছিলাম। জ্যাকুলিন আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল আমার পরিবারের ঐতিহ্য। আমার সামাজিক মূল্যবোধ, আমার সংস্কৃতি, অনুশাসন। সে সব কত দূরে ফেলে এসেছি।
আমার কাছে বারবার মনে হচ্ছিল আমি অচেনা কোনো এক পৃথিবীতে চলে এসেছি, যেখানে সবকিছুই আমার এত দিনকার চেনা জগৎ থেকে আলাদা। কেমন যেন হারিয়ে গেছি, আর কোনো দিন বাড়ির ঠিকানা খুঁজে পাব না।

স্বামী ও মেয়ের সঙ্গে লেখিকা (কানাডায় যাওয়ার আগে)
স্বামী ও মেয়ের সঙ্গে লেখিকা (কানাডায় যাওয়ার আগে)


ঘড়ির কাটা ধরে সে চলে। ১০টায় আসবে বলেছে, ঠিক ১০টায়ই দরজার কলিং বেল টিং টিং বাজতে শুরু করল।
আজও একটা লাল সোয়েটার পরে এসেছে সে। কী চমৎকার যে লাগছিল তাকে। ওর বাচ্চা বাচ্চা চেহারাটা দেখে কে বলবে, ওর ছয় বছরের একটা ছেলে আছে।
দুজনে দু-কাপ কফি নিয়ে বসেছি-মুখোমুখি। কালো কফিতে কফি ম্যাট মিশালে বাদামি রং হয়। এর ওপর সাদা রঙের ফেনা। সেই ফেনাটা আমার খুবই পছন্দ। ওটা দেখেই কফিটা খেতে ইচ্ছা করে। আমি খুবই আগ্রহ নিয়ে কফিতে চুমুক দিলাম। প্রথম চুমুকেই শরীরটা চাঙা হয়ে উঠল। ঝরঝরে লাগছিল খুব
ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, আজ তোমার কথা বল জ্যাকি।
সেদিন ওর বাসা থেকে ফেরার পর মনের খচখচানি তো কম হচ্ছে না। মধ্যবিত্ত সমাজ থেকে উঠে আসা আমি মোটামুটি ভালোই ধাক্কা খেয়েছি লিভ-টুগেদার বা একসঙ্গে থাকা নিয়ে। তাই কৌতূহলও কম নেই ওদের সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে।
আমার কি কথা।
তোমার ভালোবাসা, তোমার বয়ফ্রেন্ড।
আমার প্রথম বয়ফ্রেন্ড ছিল ক্লাস নাইনে। আমরা একই ক্লাসে পড়তাম। সে ছিল সো কিউট। এরপর তার সঙ্গে ব্রেকআপ হয়। আরও কজনের সঙ্গে ডেটিং করলাম। কোনোটাই স্থায়ী হলো না। কলেজে পড়ার সময় আমার পরিচয় হয় রায়ানের বাবার সাথে। আমরা দুজন দুজনের জন্য পাগল। আমরা একসঙ্গে থাকতে থাকলাম। জ্যাকুলিনের চোখে কী আনন্দের ঝিলিক? হয়তো বা। সে আবার বলতে শুরু করল, তখন আমার বয়স ১৮। আমি প্রেগন্যান্ট হলাম।
আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম। এই বয়সে প্রেগন্যান্ট?
হ্যাঁ, আমি পরিবার পছন্দ করি। ছোটবেলায় আমি ব্রোকেন পরিবারে বড় হয়েছি। আমার যখন তিন বছর তখন আমার মা-বাবার ডিভোর্স হয়ে যায়। আমার মার সঙ্গে থাকতাম আমি। সত্যি বলতে কী আমি বাচ্চা পছন্দ করি। তাই যখন প্রেগন্যান্ট হলাম, তখন ভীষণ খুশি হয়েছিলাম।
কিন্তু তোমাদের তো বিয়ে হয়নি।
জ্যাকুলিন একটু অবাক হলো। হ্যাঁ তাতে কী? সে কফির কাপে ঠোঁট ছুঁয়ে একটু হাসল। বাচ্চা নেওয়ার জন্য তো বিয়ের দরকার নেই।
তোমরা বিয়ে পছন্দ কর না কেন বল তো? আমি বোকার মতো, কিছুটা অবাক হয়েই ওকে জিজ্ঞেস করলাম।
বিয়ে করলে ঝামেলা অনেক। যদি একসঙ্গে না থাকতে চাও, ল-ইয়ারের ফি, কাগজপত্রের ঝামেলা বেশির ভাগ মানুষই পছন্দ করে না।
বিয়েটা তাহলে কাগুজে ঝামেলা। আর কিছু না?
হ্যাঁ, আমি তো তাই মনে করি। তোমার কাছে কী তাই মনে হয় না?

স্বামীর সঙ্গে লেখিকা
স্বামীর সঙ্গে লেখিকা

এজাজ সেদিন জ্যাকুলিনের বাসা থেকে ফেরার পথে বলছিল, শোন, কানাডীয়রা প্রথমে তরুণ বয়সে ডেট করে বিভিন্ন জনের সঙ্গে। এরপর রুচি, ব্যক্তিত্ব, পছন্দ মিললেই একসঙ্গে থাকে, একে বলে লিভ-টুগেদার। তখন কখনো তাদের সন্তানও হয়। এরপর যদি একসঙ্গে থাকতে চায়, এর অনেক পর তারা বিয়ে করে। বিয়েটা আসলে গুরুত্বপূর্ণ নয়। এটা একটা কাগজ মাত্র। গুরুত্বপূর্ণ ভালোবাসা, বিশ্বাস, পারস্পরিক শ্রদ্ধা।
জ্যাকুলিনকে আমার অনেক কথা বলার ছিল। আমি আমার সীমিত ইংলিশ জ্ঞান দিয়ে বোঝাতে পারছিলাম না আমার কাছে বিয়ে মানে অনেক কিছু। ভালোবাসা, বিশ্বাসের বাইরেও সামাজিক সম্পর্ক। বাইরের লোকজন, পরিবারের লোকজন, সবাই দেখতে চায় বিবাহিত সম্পর্ক। আমাদের সমাজ তো এর বাইরে অন্য কিছু অনুমোদন করে না।
সংসার, সন্তান আমাদের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মনে মনে বললাম, আমি শান্ত শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ের মেয়ে। এই নদী ধীরলয়ে বয়ে চলেছে অবিরাম। নদীর পলি মাটির মতো নরম আমাদের মন। এ রকম ভাঙাগড়ার জীবনকে আমরা ভয় পাই। বাঙালি নারীরা মায়াবতী। কী এক ভীষণ মায়ায় আমরা ভুলে যাই আমাদের প্রতি অন্যায়, মেনে নেই কষ্ট, সন্তানের জন্য ত্যাগ করি সুখ।
হয়তো তোমরা তার উল্টো। তুমি ক্রিসমাস ট্রির দেশের মেয়ে। প্রচণ্ড তুষার ঝরে, কিংবা হাড় কাঁপানো শীতেও এই গাছে সামান্য আঁচড় লাগে না। স্থির দাঁড়িয়ে থাকে চীর সবুজ রং নিয়ে। লেকের পাড়ের কঠিন পাথরের মতো কঠিন তোমাদের হৃদয়।
লিভিং রুমে জানালার কোন ঘেঁষে ছোট্ট একটা টিভি। সেই টিভির ওপর আমাদের তিনজনের ছবি। বাবার কোলে রোদেলা। কী মিষ্টি করেই না হাসছে। চোখে আনন্দ ঝলমল করছে। আমাদের এই পরিবারের ছবির চেয়ে সুন্দর কী আছে পৃথিবীতে? এই সুন্দর হাসি ছেড়ে আমি আর কী চাই? কিছু না-কিছুই না।
জ্যাকুলিনের দিকে তাকালাম আড়চোখে। সোফায় গুটিসুটি মেরে বসে আছে। ওর চোখমুখ কেমন নির্বিকার। জানি না সে কতটুকু সুখী। আর সুখের সংজ্ঞাই বা কী ওর কাছে? মনে মনে বললাম, সুখে থাক জ্যাকি। থাকো তুমি তোমার ভাঙাগড়ার জীবন নিয়ে। (চলবে)
ধারাবাহিক এই রচনার আগের পরর্ব পড়তে ক্লিক করুন:
http://www.prothom-alo.com/durporobash/article/613543
http://www.prothom-alo.com/durporobash/article/627919
http://www.prothom-alo.com/durporobash/article/632575
http://www.prothom-alo.com/durporobash/article/641398
http://www.prothom-alo.com/durporobash/article/643861
http://www.prothom-alo.com/durporobash/article/656035
http://www.prothom-alo.com/durporobash/article/664282
http://www.prothom-alo.com/durporobash/article/705639
http://www.prothom-alo.com/durporobash/article/691222
http://www.prothom-alo.com/durporobash/article/726331