যাপিত জীবনের দিনলিপি

প্লেনটি যখন টরোন্টোর আকাশে উঁকি দিচ্ছে আমি আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠলাম। আমার স্বামীকে বললাম, ও মাই গড দেখ দেখ কি চমৎকার। এজাজ উঁকি দিল প্লেনের ছোট্ট জানালা দিয়ে। সত্যিই তো এটা যেন কাগজে আঁকা ছক-কাটা ছোট্ট একটা আলো ঝলমলে দাবার বোর্ড। আমি অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকলাম আলোর তারা বিছানো রাতের টরন্টোর দিকে। এত আলোর ঝিকিমিকি আমার এই প্রথম দেখা। রাতের অন্ধকারে নিয়নবাতির আলো ঝলমলে রূপ ভুলিয়ে দিল আমার ফেলে আসা শহর ঢাকা, আমার প্রিয়জনদের।
আমরা এজাজের ফুপাতো ভাইয়ের বাসায় উঠলাম। টেবিলভর্তি বাংলাদেশি খাবার। দুদিনের না খাওয়া আমি হাপুস-হপুস করে ভাত খেলাম। সেদিনই আবিষ্কার করলাম, ভাত-ডালই হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খাবার। পরদিন খোকন ভাই আমাদের নিয়ে বের হলেন। এলাকার নাম ড্যানফোর্থ। রাস্তার ওপর সব বাঙালি দোকান। গ্রোসারি, কাপড়ের দোকান, বই, রেস্টুরেন্ট সবই আছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশি লোকজন আড্ডায় ব্যস্ত। কেউ একজন এই মিলন বলে রাস্তার ওপাশ থেকে চিৎকার করে উঠল। আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন এলিফ্যান্ট রোডে দাঁড়িয়ে আছি। এই মিনি বাংলাদেশের দোকানে চায়ের সঙ্গে শিঙাড়া কামড় বসিয়ে আমার মন ভালো হতে থাকল। খোকন ভাই আমাদের রোদেলার স্কুলে নিলেন রেজিস্ট্রেশনের জন্য। বিশাল এলাকা জুড়ে চমৎকার একটা স্কুল। বিশাল খেলার মাঠ, বিরাট বিরাট ক্লাসরুম। প্রিন্সিপাল উঠে এসে কথা বললেন। কাগজপত্র পূরণ করতে গিয়ে আমি মহাখুশি। হয় বাবার নাম নয় মার নাম। আমি আমার নাম বসিয়ে রোদেলার একচ্ছত্র গার্জিয়ান হয়ে গেলাম। এজাজের নাম থাকল ইমার্জেন্সি কনটাক্টে। আমি সবকিছুতেই মুগ্ধ হচ্ছি খুব সহজেই। কিন্তু এই মুগ্ধতা হারিয়ে যেতে সময় লাগল না।
এরপর প্রচণ্ড হতাশ হলাম আমরা টেন মেসিতে বাসা ভাড়া নিতে গিয়ে। বাসা ভাড়া আট শ ৫০ ডলার। আমাদের এর সঙ্গে ইলেকট্রিসিটি, ইন্টারনেট, টেলিফোন, টিভির বিল দিতে হবে। ফ্ল্যাটে ঢুকেই আমার মন খারাপ হয়ে গেল আরও অনেক বেশি। এক বেডরুমের সঙ্গে একটা লিভিং ও ডাইনিং, ওপাশে রান্নাঘর। বাথরুম ও রান্না ঘরের কাঠের চলটা ওঠা মেঝে, অনেক পুরোনো কাভার্ড, নোংরা সিঙ্ক। বারান্দায় কবুতরের বর্জ্য। এত নোংরা বাসা কানাডাতে? আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। শ্যামলীর ঝকঝকে নতুন ফ্ল্যাট, বিরাট বড় বড় রুম চোখের সামনে ভাসতে থাকল। এজাজ বলল আপাতত ওঠো, পরে না হয় বদলাব। প্রচণ্ড হতাশা নিয়ে ফ্ল্যাটে উঠলাম। বাসা নিজ হাতে পরিষ্কার করে কিছুটা মনুষ্য উপযোগী হলো।

প্রথমে ধাক্কা খেলাম দোকানগুলোতে গিয়ে। বাংলাদেশের টাকা কানাডীয় ডলারে কনভার্ট করে মাথা ঘুরে যায় আমার। আমি চিৎকার দিই ভেতরে-ভেতরে, এত টাকা? তখন আর কোনো কিছুই কিনতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু কিনতে তো হবেই।
ফার্নিচার কিনতে গিয়ে মাথায় বাজ। একটা ম্যাট্রেসের দাম চার শ ডলার। তার সঙ্গের বাকি অংশের আলাদা দাম দিতে হবে। আমরা শুধুমাত্র ফোমটা নিয়ে বাড়ি এলাম। ওদের লোকজন ৫০ ডলারের বিনিময়ে সেটি বাসায় পৌঁছে দিল। পুরোনো এক সেট যাচ্ছেতাই দেখতে সোফা কিনলাম দুই শ ডলার দিয়ে, এক বাঙালির বাসা থেকে। তিন মাসের মাথায় আমাদের বাংলাদেশ থেকে আনা জমানো টাকা দ্রুত শেষ হতে থাকল। এজাজের মুখ শুকনা হতে লাগল ততই। এ মাসের বাড়ি ভাড়া দিলে বাজার করার টাকা থাকবে না। জীবনে এই প্রথম বুঝতে পারলাম টাকা না থাকলে কেমন লাগে।
বাংলাদেশে আমাকে সাহায্য করার জন্য ছিল ড্রাইভার, বাড়ির দারোয়ান, দুজন কাজের লোক। ভালো রাঁধতে পারি না বলে গ্রামের বাড়ি থেকে এজাজ সেলিনাকে এনেছিল। আমরা তিনজন মানুষ, যাদেরকে ঘিরে পাঁচজনের বিশাল টিম। আমি বাংলাদেশে কোনো দিন সে ভাবে রান্না ঘরেই যাইনি। আর কানাডায় আমাকে থালাবাটি মাজা, রান্না করা, কাপড় ধোয়া, বাড়িঘর পরিষ্কার, বাজার করা এমন হেন কাজ নেই যা করতে হচ্ছে। বাংলাদেশে আমার ছোট্ট সংসারে আমি রাজরানি ছিলাম। স্বপ্নের দেশে আমি হয়ে গেলাম ঘুটেকুড়ানি দাসী।
এবার আমার মেয়ের গল্প বলি। আমাদের বাড়ির রাজকন্যা। রোদেলা আমাদের একমাত্র মেয়ে, আমার বাবার বাড়ির একমাত্র শিশু। ২০০০ সালে তার জন্ম। সে সময় সাগর কলা ছিল দশ টাকা হালি। শ্যামলী থেকে নিউমার্কেটের রিকশা ভাড়া ১৫ থেকে ২০ টাকা। বাংলাদেশে সবকিছুই

মধ্যবিত্তের জন্য সহজলভ্য। আমরা দুজনই চাকরি করি। আমার ও এজাজের দুজনেরই পরিবার সচ্ছল। বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রা আকাশচুম্বী হয়নি তখনো। বাংলাদেশের সেরা দোকানের সেরা সব জিনিস রোদেলা না চাইতেই পায়। সেই রোদেলা রাজকন্যার জীবন থেকে দিন আনে দিন খায় মানুষের জীবনে পতিত হলো। রোদেলা কখনো না শোনেনি তার জীবনে। তো এই প্রথম সে শুনল কোনো কিছু চাইলে সে পাবে না। আমার এই রাজকন্যাকে নিয়ে দোকানে ঢুকলেই বিপদ। কোনো না কোনো খেলনা নেওয়ার বায়না ধরে। কখনো কিনি, কখনো বুঝিয়ে বলি, আজ না কিনে কাল কিনব কিংবা টাকার ব্যাগটা রেখে এসেছি বাসায়। অবুঝ শিশু কি বোঝে জানি না, মাথা নেড়ে বলে, আচ্ছা কাল কিনে দেবে তো? আমি হাসার চেষ্টা করি আর বলি সত্যি বলছি মামনি। ওখানে নতুন এক দোকান পেলাম, যার নাম ডলার স্টোর। যাই কিনিনা কেন এক ডলার। এই দোকানই নতুন ইমিগ্রান্টদের একমাত্র ভরসা। বাসার নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুই এখান থেকে কিনতে লাগলাম। একদিন মা মেয়ে ডলার স্টোরে ঢুকতেই রোদেলা প্লাস্টিকের কটা পুতুল তুলে নিল হাতে। আমি এগুলো নেবই আম্মু। আমি ব্যাংকের জমানো টাকাগুলো শেষ হয়ে যাওয়া কল্পনা করলাম। মাথাটা ঘুরে উঠল। ডলার স্টোরের ঠুনকো খেলনা আমি ওর হাত থেকে কেড়ে নিলাম। মেয়ের মুখ অভিমান, বেদনায় লাল হয়ে গেল। কিছুই না বলে আমার হাতে তুলে দিল পুতুলগুলো।
সেদিন রাতে আমার ছয় বছরের মেয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরে করুন সুরে বলল, আম্মু আমরা কি গরিব হয়ে যাচ্ছি? আমি আমার রাজকন্যার চোখের দিকে তাকিয়ে নির্বাক হয়ে গেলাম। তার ছোট্ট চোখের কাল মণিতে অনিশ্চয়তা, কষ্টের ছাপ। কী কঠিন সত্য ছোট্ট মেয়েটি অবলীলায় বুঝে গেল। অনেকক্ষণ আমার মুখ দিয়ে কথা বেরোল না। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ফিসফিস করে বললাম, আর মাত্র কটা দিন। তোমার বাবা চাকরিটা পেয়ে গেলেই তুমি সবকিছুই কিনতে পারবে মা।
মেয়েটা আমাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। আমাকে যেন মিথ্যে সান্ত্বনা দিতে চাইল। বলল, আচ্ছা আম্মু। ঠিক আছে, তখন কিনে দিলেই হবে। আমার প্রচণ্ড কান্না পেল এই প্রথম। আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। আমার কণ্ঠ জড়িয়ে গেল। চোখের তপ্ত পানি আমার গাল বেয়ে আমার মেয়ের শরীরে পড়ল। আমি ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলাম আমার চোখের এক ফোঁটা পানিও যেন সে দেখতে না পায়।