যাঁদের নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় পৃথিবীটা এত সুন্দর

সন্তান ও স্বামীর সঙ্গে লেখিকা
সন্তান ও স্বামীর সঙ্গে লেখিকা

এক যুগ আগের কথা। জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতা। থানা জেলা পার হয়ে প্রতি বিভাগ থেকে যারা প্রথম, তারা সেদিনের প্রতিযোগী। ছয়জন প্রতিযোগী। উপস্থিত বক্তৃতা। আমি ঢাকার। চতুর্থ জন হিসেবে বলতে গিয়ে দেখি লটারিতে আমার বিষয় ‘আমার মা’। আগেও দুজন এ নিয়ে বলে গেছে, মায়েরা কত আদর করে সেটা বলে গেছে। এখন আমি কি বলব! মনে মনে ভাবলাম, ভাই তোমরা যখন আমার বলার কিছু রাখই নাই, তখন পুরস্কারের আশা ছেড়ে কিছু সত্য কথা বলে দিই!
অতঃপর যা বললাম তা হলো: আমার আব্বু খুব ভালো আর মা শুধু শাসন করেন। সব সময় ভাবি আরেকটু বেশি আদর কী আম্মু করতে পারেন না। একদিন আম্মু নানু বাড়ি ঘুরতে গেলেন। অপার স্বাধীনতায় আমার আনন্দের সীমা নেই। কিন্তু একদিন পরই কেমন যেন লাগা শুরু করল। দ্বিতীয় দিন থেকে মনে হলো জীবনে কোনো আনন্দ নাই। দুই দিনেই আম্মুর মর্ম বুঝে গেলাম। তৃতীয় দিন আম্মু ফিরে এলেন। হাসিমুখে জড়িয়ে ধরলেন। পরক্ষণেই রাগী গলায় বললেন, দুই দিন ধরে কি চুল আঁচড়াও না? যাও চুল আঁচড়ে পড়তে বস। আমি মনে মনে বললাম, পৃথিবীর সব মা ভালো মা, কিন্তু আমার কাছে আমার মা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা। বক্তৃতা শেষ করলাম। মিলল জীবনের প্রথম জাতীয় পুরস্কার।
এই হলো আমার মা। প্রবাস জীবনে প্রতিটা ক্ষণে আম্মুকে মনে পড়ে। বিদেশে আসার সময় আমাকে বিদায় দিতে এসে আম্মুর সেকি কান্না! ছোটবেলায় শাসনের সময় আম্মুর বলা, ‘খবরদার’, ‘আর একবারও যেন না শুনি’ অথবা ‘মানুষের চেহারায় নয় কাজে আদর, মানুষ হও’ এ সব কথা সব সময় এখন আমার কানে বাজে।

এবার বলি আমার আব্বুর কথা। একদিন আমার মন খুবই খারাপ। আমি আমার স্বামীকে বললাম, শোন আমি এখন আব্বুকে ডাকাডাকি করে অনেকক্ষণ কাঁদব। দেখবে আব্বু টের পাবে। বলে কাঁদতে শুরু করলাম। এর কিছুক্ষণ পরই ফোন বেজে উঠল। সে আমার দিকে ফোন এগিয়ে দিয়ে হতভম্ব গলায় বলল, আব্বার ফোন! এ রকম ঘটনা দুবার ঘটার পর আমার স্বামী যার পর নাই অবাক হলো। আমি অবাক হলাম না।
ছোটবেলা থেকেই আমার যখন খুব বেশি কষ্ট হয় তখন আমার আব্বুর কথা মনে হয় এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস আব্বু সেটা টের পান। হতে পারে সেটা কাকতালীয়, হতে পারে আমার শিশুকাল থেকে মনে ধারণ করা বিশ্বাসের কল্পনামাত্র। কিংবা হতে পারে এটাই সত্য, জগতের রহস্যময়তার কতটুকুই বা আমি জানি।
শুধু যে সত্যটা আমি নিশ্চিতভাবে জানি সেটা হলো, পৃথিবীতে যে মানুষটা আমাকে সবচেয়ে বেশি নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসে সেই মানুষটা আমার আব্বু। আব্বু আমার দেখা পৃথিবীর সব থেকে ভালো মানুষ। সরকারি বদলির চাকরিতে আজ এখানে তো কাল ওখানে। পড়ালেখার সুবিধার জন্য আমরা ভাইবোনেরা আম্মুর সঙ্গে থাকতাম ঢাকায়। সপ্তাহের ছুটির দিনগুলাতে আব্বু ছুটে আসতেন আমাদের কাছে। ভাবলে খুব অবাক লাগে একটা মানুষ সন্তানদের কতটা ভালোবাসলে এতটা কষ্ট করতে পারেন। এরই নাম বুঝি বাবা। প্রবাস জীবনে আমার সব থেকে বড় কষ্ট বাবা–মা থেকে দূরে থাকা।
বাবা–মায়ের ভালোবাসা যে কী সেটা বুঝলাম এই দূরে প্রবাসে থেকে আর নতুন করে চিনলাম নিজে মা হয়ে। যখন আমি আমার সন্তান পৃথিবীতে আসার অপেক্ষায় ছিলাম তার প্রথম তিন মাসকে এখন পর্যন্ত আমার জীবনের কঠিনতম সময় বলে মনে হয়। আমি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমি কিছুই খেতে পারি না, উঠে বসতে পারি না, কাজে যেতে পারি না, ক্লাসে যেতে পারি না। এক কথায় খুবই খারাপ সময় যাচ্ছিল। আমার নিজেকে খুবই অসহায় মনে হতো। বাসার কথা, আপনজনদের কথা ভীষণভাবে মনে পড়ত। আমি প্রচণ্ড আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লাম। একা একা খুব কাঁদতাম। বাসায় স্কাইপে কথা হতো, হাসিমুখে কথা বলতাম, সবার কাছ থেকে চাইতাম কষ্টের সময়টাকে আড়াল করতে। মায়ের পায়ের নিচে কেন সন্তানের বেহেশত তা বুঝতে এই তিন মাসই আমার জন্য যথেষ্ট ছিল।
আমার প্রকৃত অবস্থাটা জানত শুধু আমার স্বামী। আর এই সময়টাতে সে যেভাবে আমার পাশে ছিল আমি কখনো ভুলব না। বাসার সব কাজ সে নিজের কাঁধে তুলে নিল। অফিস থেকে সন্ধ্যায় বাসায় এসে রান্না করা, আমার মন ভালো করতে লং ড্রাইভে নিয়ে যাওয়া। বাসা গোছাতে সে একদমই পারে না। তারপরও যথাসাধ্য চেষ্টা করত। কখন কী খেতে চাই, কখন কী লাগবে, সব যেন বলার আগেই হাজির। আমি যদি এই কঠিনতম সময়ের মাঝে দিয়ে না যেতাম, আমি কখনই তাঁকে এই নতুন করে আবিষ্কার করতে পারতাম না। আমি বিস্ময় ও আনন্দ নিয়ে দেখলাম অনাগত সন্তানের জন্য এক বাবার ভালোবাসা।
প্রথমবার যখন আমি আমার সন্তানকে কোলে নিলাম আমার চোখে ছিল বিস্ময়, আনন্দ ও অশ্রু। দেখতে দেখতে কেটে গেল আড়াই বছর। কান্না, পরিশ্রম, ঘুমহীন একেকটি দিন। একটা বাবু বিদেশে একা একা দেখাশোনা করা বড় কঠিন। কিন্তু এই কষ্ট নিমেষেই চলে যায় বাবুর মুখের একটা আধো বোলে, একটা নিষ্পাপ হাসিতে...। সে এসে আমার জীবন পরিবর্তন করে দিয়েছে, অনেক কিছু শিখিয়েছ, কীভাবে ভালোবাসতে হয়, কীভাবে আরও শুদ্ধ মানুষ হতে হয়। যার কান্নায় আমি কাঁদি, যার হাসিতে আমি হাসি, তার মাঝে আমি আমার জীবন দেখতে পাই।
বাবা তার ভীষণ প্রিয়। বাবা অফিস থেকে আসলেই সে কোলে চড়ে বসে। বাবা তাকে কোলে নিয়ে রান্না করে, যাতে তার মায়ের একটু সাহায্য হয়। মাঝরাতে কাঁদতে থাকা তাকে কোলে নিয়ে হেঁটে বেড়ায় বাবা, যদিও ভোর হতেই ছুটতে হবে অফিসে।
বাবা মায়ের এই ভালোবাসার কোনো সংজ্ঞা আমার জানা নেই। পৃথিবীর সকল বাবা–মায়ের জন্য রইল শ্রদ্ধা। যাঁরা সন্তানদের সময় দিতে গিয়ে নিজেদের সময় দিতেই ভুলে যান, যাঁদের তুলনা শুধু তাঁরা নিজেরাই এবং তাঁদের ভালোবাসা স্বার্থের অনেক ঊর্ধ্বে! ভালো থাকুক সবার বাবা–মা। যাঁদের নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় পৃথিবীটা এত সুন্দর!