যা কিছু আর ফিরবে না

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কোভিড পূর্ব জীবন আর ফিরে আসবে না। এ কথা শুনে করোনায় থমকে যাওয়া জীবনে আরেকবার থমকে গেলাম।

এই কোভিড পূর্ব জীবন কেমন ছিল তা মনে করার চেষ্টা করলাম।

২০২০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। ঢাকার পথে জেএফকে বিমানবন্দর ছেড়েছি টার্কিশে। প্লেনে সর্বোচ্চ দুই থেকে তিন ভাগ যাত্রীর মুখে মাস্ক। করোনা তখনো বৈশ্বিক নয়, চীনের উহানের একটি সমস্যা মাত্র।

মাস্ক পরা যাত্রীদের দেখে হাসি পেয়েছিল, কি কষ্ট! ছয় মাস পর ফেরার পথে একই প্লেনে এবার সব যাত্রীর মুখে মাস্ক। এ সব মাস্কের আড়ালে কার কি কান্না লুকিয়ে ছিল, কোনো দিন জানা যাবে না।

যত কথাই বলি, আগের স্বাভাবিক জীবন আর নেই। পাল্টে গেছে সব। অলিম্পিক হয় দর্শক শূন্য মাঠে। টোকিওর বাতাসে আনন্দের চেয়ে উদ্বেগ বেশি। সিডিসির খবরে ভয় কমে না, বাড়ে। দুটি টিকা নিলে মাস্ক খুলে জনসমাগমে যাওয়ার অনুমতি ছিল। এবার নতুন নির্দেশনা এল, টিকা নিলেও মাস্ক পরতে হবে।

এই পরিস্থিতিতে কারও বাড়িতে সহসা যাওয়া হয় না, আসেও না কেউ। স্বাগত জানানো হবে কিনা, এই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব উভয়ের।

এখন খেলাধুলা হয় দর্শক শূন্য মাঠে। ব্রাজিলে কোপা আমেরিকার সব কয়েকটি খেলা হলো দর্শক ছাড়া। বাংলাদেশের ক্রিকেটও তাই। অবশ্য ইংল্যান্ডে ইউরো হয়েছে মাঠভর্তি দর্শক নিয়ে।

এখন চিকিৎসক সাক্ষাৎকার নেন ভিডিও কলে। আমার চিকিৎসকের চেম্বারে গিয়ে দেখি, বারান্দায় দেয়ালের সঙ্গে লাগানো সাতটি চেয়ারের তিনটি টেপ দিয়ে ক্রস করা, বসা যাবে না। নতুন বাস্তবতা, সামাজিক দূরত্ব।

সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকেরা বসেন দূরে দূরে। ভিত্তি প্রস্তর বা উদ্বোধন, এমনকি বিচার কাজও এখন সম্পন্ন হয় ডিজিটাল ব্যবস্থায়। সামাজিক, রাজনৈতিক সব সংস্কৃতি বদলে যাচ্ছে।

নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস বাঙালির প্রাণকেন্দ্র। প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার অফিসও। যাইনি দেড় বছরের বেশি সময় ধরে। আগে জ্যাকসন হাইটস পৌঁছে খাবার বাড়ি বা প্রিমিয়ামে আয়েশে এক কাপ চা খেয়ে যেতাম প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার আড্ডায়। প্রিমিয়ামে প্রতিদিন দেখা মিলত ছড়াকার সুফিয়ান চৌধুরীর সঙ্গে। সামনে ধূমায়িত চা, হাতে ফোন। তাঁর পাশে বসে গল্প করে করে চা শেষ করতাম। এরই মাঝে সুফিয়ান চৌধুরীর ফোন-ক্যামেরায় বন্দী হয়ে সোজা চলে যেতাম ফেসবুকের দুনিয়ায়।

সুফিয়ান চৌধুরী কি এখনো আগের মতো বসেন? এক সময় নর্দার্ন বুলেভার্দের ডানকিনে নাশতা সেরে দিন শুরু হতো আমার। প্রায় দিনই কফি লাইনের আগে-পিছে থাকতেন আড়ংয়ের রানা ভাই। চোখাচোখি হতেই দুজন মৃদু হাসি বিনিময় করতাম। কফি শেষে রানা ভাই কয়েক ব্লক হেঁটে চলে যেতেন তাঁর কর্মস্থল আড়ংয়ে। আর আমি আমার গন্তব্যে।

এখন আর ডানকিনে যাওয়া হয় না আগের মতো, আর গেলেও দেখা পাব না রানা ভাইয়ের। মহামারি কেড়ে নিয়েছে তাঁকে।

প্রায় দুই বছর পর সেদিন গেলাম এস্টোরিয়ার আলাদিনে। ঘর থেকে বের হই না, খোলা বাতাসে চলাফেরা করি না, পরে এক সময় পুরো অচল হয়ে যাব। ছেলে-মেয়ের অব্যাহত চাপ, বাইরে যাওয়ার, হোক না হুইল চেয়ারে। সেদিন এক আফগান রেস্তোরাঁয় নৈশভোজের পর রুম্পা ও তাঁর স্বামী জনি প্রস্তাব করল, আলাদিনের চা-মিষ্টি খেতে হবে। সবাই গেলাম আলাদিনে। হাসি বাড়তি পেলেন পান-সুপারি, টোকনের (আলাদিনের অন্যতম মালিক) সৌজন্যে।

হঠাৎ ‘মাহবুব ভাই’ ডাক শুনে ফিরে দেখি নিনি আপা। সাংবাদিক নিনি ওয়াহেদ। দৈনিক সংবাদে আমার সিনিয়র। কণ্ঠে তাঁর ক্লান্তি ও উদ্বেগ। নিনি আপার স্বামী বাবুল ভাই ভীষণ অসুস্থ। হাসপাতালে আছেন। সারা দিন তাঁরও কেটেছে ওখানে। দোয়া চাইলেন।

এর দুই তিন দিন পর খবর পেলাম দৈনিক সংবাদে আমার এক সময়ের সহকর্মী কিংবদন্তিতুল্য চিত্র সাংবাদিক লুৎফর রহমান বিনু মারা গেছেন। এই তো সেদিন নিউইয়র্কে তাঁর সঙ্গে আলাপ হলো। পুরোনো দিনের কত গল্প! এর মধ্যে রওশন হক প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার জন্য তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নিলেন। যথারীতি তা ছাপাও হলো গুরুত্বের সঙ্গে।

মনে পড়ে তাঁর এক অভিজ্ঞতার কথা। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে কড়া সেনসরের মধ্যে পুরোনো ঢাকার এক ব্যস্ততম রাস্তা। সবকিছু বন্ধ, জনমানবহীন, স্ট্রিট লাইটের নিচে অলস ভঙ্গিমায় বসা দুই তিনটা কুকুর—এমন এক দৃশ্য ধারণ করলেন তাঁর ক্যামেরায়। পরের দিন এ ছবিটিই হলো টক অব দ্য কান্ট্রি।

গণসংগীত শিল্পী ফকির আলমগীর চলে গেলেন না ফেরার দেশে। যুক্তরাষ্ট্রে এলে অফিসে আসতেন, ফোন করতেন। সিলেটের মরহুম সাংবাদিক মহিউদ্দিন শিরুর সঙ্গে ছিল ঘনিষ্ঠতা। বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগে ছিলেন সহপাঠী। বৈবাহিক সূত্রে মৌলভীবাজারের জামাই ছিলেন। তাঁর সঙ্গে মিশিগানের এক স্মৃতি আছে, এ কথা মনে পড়ে তাঁর প্রসঙ্গ এলেই।

এই শতাব্দীর শুরুতে, মিশিগানে বাঙালিরা আয়োজন করেন বর্ণাঢ্য প্যারেড, মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অতিথি হিসেবে আমিও যোগ দিই এতে। সন্ধ্যার পর খোলা মাঠে অনুষ্ঠিত হয় জমজমাট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রধান আকর্ষণ ছিলেন ফকির আলমগীর। সেই অনুষ্ঠান গড়াবে মধ্যরাত পর্যন্ত। সারা দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালায় যোগ দিয়ে ক্লান্তিবোধ করছিলাম, ভাবলাম ঘরে ফিরে বিশ্রাম নিই। স্টেজের কাছে আটকে দিলেন ফকির আলমগীর।

—মাহবুব ভাই, আমার একটি অনুরোধ রাখতে হবে।

—কি অনুরোধ?

—আমার গানের আগে ভূমিকা দিয়ে আমাকে উপস্থাপন করবেন আপনি।

—অনুষ্ঠানের উপস্থাপক আমার চেয়ে ভালো উপস্থাপন করতে পারবেন, সুতরাং...

—না, এক কথা হলো না। আপনি উপস্থাপন করলে আমার মর্যাদা বাড়বে। সিলেটি কমিউনিটিতে আপনার অবস্থান জানি। আমার জন্য এই ছোট্ট কাজটুকু করতে পারবেন না?

মধ্যরাত পর্যন্ত জেগে সেই কাজ করেছি। এর মাঝে ছোট্ট একটি ঘটনা আছে, অন্য কোনো দিন বলব।

ফকির আলমগীরের ‘ও সখিনা’ ও ‘নেলসন ম্যান্ডেলার’ গান আমাকে দারুণ উজ্জীবিত করে।

আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফখরুল ইসলাম খান। তিনি নিউইয়র্কে জ্যামাইকার হিলসাইড অ্যাভিনিউর সাটফিন বুলেভার্দ এলাকাকে আলোকিত এবং ওই এলাকায় বাঙালি বসতির সূচনা করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে স্মরণ সভা ছিল সম্প্রতি। সাহাবুদ্দিন ও লুফা ফোনে অনুরোধ করেছিলেন অংশ নিতে। যানবাহন না পাওয়ায় সেই মুহূর্তে যেতে পারিনি। তাঁর ছেলে মাহবুবের সঙ্গে আলাপ হলো। আলাপ হলো স্মরণ সভায় উপস্থিত ইশতিয়াক রূপুর সঙ্গে। তাঁর ক্ষোভ, জীবিতকালে ফখরুল ইসলাম খানের একটু অনুগ্রহের জন্য যাদের বসে থাকতে দেখতাম, তাঁদের কাউকে দেখলাম না।

ফখরুল ইসলাম খান সিলেট পৌরসভার প্যানেল চেয়ারম্যান ছিলেন। শহরের ছড়ারপারের বীর মুক্তিযোদ্ধা লন্ডনপ্রবাসী আনোয়ার উদ্দিন চৌধুরীর মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। নিউইয়র্কে হিলসাইড অ্যাভিনিউর ১৪৮ স্ট্রিটের কাছে একটি গ্রোসারি ও ভিডিও স্টোরের মাধ্যমে ওই এলাকায় বাঙালি উপস্থিতির সূচনা করেন। পরে ওখানে দারুস সালাম মসজিদ, তাজমহল পার্টি হলসহ বহু প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।

যুক্তরাষ্ট্রে গুণীজনদের সংবর্ধনায় তিনি থাকতেন এগিয়ে। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, এ এম এ মুহিত, কবি দিলওয়ারের সম্মানে তিনি সংবর্ধনার আয়োজন করেন। কয়েক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র সফররত সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর সম্মানে অনুষ্ঠান আয়োজনের অনুরোধ করলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি সাড়া দেন এবং অন্য কয়েকজনকে নিয়ে জমজমাট অনুষ্ঠান উপহার দেন। তাঁর মৃত্যু নিউইয়র্ক প্রবাসীদের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।

বদলে যাওয়া পৃথিবীর কথায় ফিরে আসি। কোভিড পূর্ব জীবন আর আসবে না। এর অর্থ কি আমরা হেরে গেলাম? না, এখানে জয়-পরাজয়ের কোনো প্রশ্ন নেই। অতীতে মানুষ বহুবার মহামারির মুখোমুখি হয়েছে। প্লেগ, স্প্যানিশ ফ্লুসহ বিধ্বংসী মহামারিতে অসংখ্য জীবনহানির মধ্য দিয়ে মানুষ সম্মুখপানে এগিয়ে গেছে। নতুন বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। কোভিড মহামারি কত দিন চলবে জানি না। তবে নতুন যে বাস্তবতা, এই যেমন মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এগুলো সবই নতুন বাস্তবতা। আর এটাই নতুন স্বাভাবিকতা।

ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও বদলে গেছি। আমার শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখ আয়নার সামনে নিয়ে মিলাতে চেষ্টা করি, কোনটা ভালো?

কোভিড পরবর্তী বিশ্বে শ্মশ্রুধারীর সংখ্যা বেড়েছে। কারণ? আমারটা বলতে পারি, তবে এখন না বলাই উত্তম।