ম্যাচিং ফ্যাশন
মিলি আর সাহেদ একটা পার্টিতে যাবে সন্ধ্যায়। সে তৈরি হয়ে খুব আদুরে গলায় বলল,
এই আমাকে কেমন লাগছে?
চোখ কুচকে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল সাহেদ,
এ শাড়ি কবে কিনলে?
কিনিনি?
তবে
চেয়ে এনেছি।
সেটা তো দেখেই বুঝতে পারছি। এটা কার শাড়ি? (পাহাড় ভাঙার মতো শব্দে সাহেদ চিৎকার করে উঠল।)
তোমাকে আমি শাড়ি কিনে দিই না, যে অন্যের শাড়ি চেয়ে এনে তোমাকে পরতে হয়? (মিলি আমতা আমতা করে বলল)
সানিয়া বলেছে, ওর অনুষ্ঠানে সবাই যেন নীল শাড়ি পরে। আর ছেলেরা সাদা পাঞ্জাবি। বাচ্চারা সাদা বা নীল।
সানিয়াকে বললে পারত তোমাকে নীল শাড়িও দাওয়াতের সঙ্গে দিয়ে দিতে। তাহলে তোমাকে ভিক্ষা করতে হতো না।
এসব কি বলছ? ম্যানেজ করার জন্য এসব সবাই করে।
বছর দশেক আগেও গ্রামে দেখেছি লন্ডনফেরত, আমেরিকাফেরতের বিয়ে–শাদিতে এ রকম ফ্যাশনের চলন। এক রং পরতে হবে। এখন গ্রাম্য ফ্যাশনই শহরের অতি মর্ডানদের পার্টি থিম! যারা এসব পার্টি দেয়, তাদের তো বোঝা উচিত, সবার সামর্থ্য না হতে পারে। দাওয়াত দাও বিনা শর্তে দাও। এত শর্ত দিয়ে জীবন চলে? এই রং পরতে হবে। ওই রং হলেও চলবে।
ছি! ম্যানেজ!!! সবাই করে, তাই তুমিও করবে? বলব না? মানুষ যা বলে, তাই তোমাকে করতে হবে? আমি তো জানতাম, তুমি খুব ব্যক্তিত্ববান নারী। এই তোমার ব্যক্তিত্ব? এই তুমি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের তুমি? কোথায় ছেলেমেয়েকে খরচ কমাতে বলবে, তা না, তুমি এখন বুড়ো বয়সে মডেল সাজো। আজ এর গায়ে হলুদ, পরশু মেহেন্দি। এসবে না গেলে হয় না? একটা প্রোগ্রামে গেলে হয় না?
কথাগুলো চিৎকার করেই বলছে সাহেদ।
তুমি কিন্তু একটু বেশি কথা বলে ফেলছ। ভালো হচ্ছে না বলে দিচ্ছি।
ভালো হচ্ছে না মানে কী? তুমি কি মারবে আমাকে?
এসব কী ধরনের কথা সাহেদ? আমি কি বলেছি যে তুমি গায়ে পড়ে ঝগড়া শুরু করেছ?
তোমার আসলে তোমার মা–বাবার কথামতো কোনো লন্ডন আমেরিকান ছেলে বা ব্যবসায়ী বিয়ে করা উচিত ছিল বা কোনো ঘুষখোর চাকরিজীবী। আমারই ভুল হয়ে গেছে।
আরও জোরে চিৎকার দিয়ে মিলি বলে উঠল,
হ্যাঁ, তাই উচিত ছিল। তখন বুঝতে পারিনি যে জীবনে ভুল করছি। এখন প্রতিমুহূর্তে বুঝতে পারছি।
যাও না গিয়ে ভুল শোধরাও।
হ্যাঁ, তাই করব।
যাও এখনই চলে যাও আমার বাড়ি ছেড়ে।
বলে হাতে একটা ঠেলা দেয় সাহেদ। দাঁতে দাঁত চেপে বলতে থাকে,
এসব সাজগোজ জঘন্য লাগে আমার। যাও আমার সামনে থেকে। ভিক্ষা করে সাজার চেয়ে নিজের তাঁতের শাড়ি পরা অনেক ভালো। যাও বের হয়ে যাও।
মিলি আর কথা বলতে পারল না, চোখ থেকে টপটপ করে চোখের পানি পড়ছে। এ দিকে তার মোবাইল বেজে চলেছে। সানিয়া সমানে রিং দিচ্ছে। সে উঠাচ্ছে না। সাহেদ হন হন করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
মিলি কখনো ভাবেনি আজকের দিনটা এ রকম যাবে। সে স্কুল থেকে এসে কত কী মনে মনে প্ল্যান করেছে। সানিয়ার ছেলের জন্য গিফট কেনা হয়ে গেছে। ওরা যাবে জানিয়েছে। বনানী পার্টি সেন্টারে অনেক দাম একেকজনের খাবার। ও নিশ্চিতভাবে বলেছে, ওরা যাবে। এখন কী হবে? সে শোকে পাথর হয়ে গেছে, বেশি কাঁদতেও পারছে না। আইলাইনার সব লেপ্টে না যায়। কিন্তু ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল। সে কি আসলেই ভুল করছে?
সাহেদ ছাদে গিয়ে উঠল। সিগারেট ধরিয়ে ছাদের কিনারায় দাঁড়াল। ওপর থেকে নিচে সব বিন্দুর মতো লাগছে। মনে হলো, মাথা ঘুরছে। এক দিকে অফিসে নানান সমস্যা। ধোঁয়া টানতে টানতে কী এক গ্লানি বোধ করছে। তার ইচ্ছে হচ্ছে ওপর থেকে একটা ঝাঁপ দেয়। তার কেমন শূন্যতা বোধ হচ্ছে! নাহ এখানে সে বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না। কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারে। দৌঁড়ে বের হয়ে লিফটে একদম নিচে চলে গেল। সোজা পথের দিকে হাঁটা দিল। হাঁটতে হাঁটতে তার খেয়াল নেই, সে কোন দিকে যাচ্ছে। বেইলি রোড ছাড়িয়ে কাকরাইল মোড় হয়ে রমনার পার্কে ঢুকল। একটা বেঞ্চে কী মনে করে বসে পড়ল। তার চোখে জল পড়ছে। তবে সে কানছে না। সে ঠিক করল, না বেঠিক, বুঝতে পারছে না। সে একটু বেশি রিঅ্যাক্ট করে ফেলেছে। কিন্তু এসব কী ধরনের স্বভাব?
তার ভালো লাগে না। কিচ্ছু ভালো নাগে না। সে ভালোবাসে অফিস শেষ করে ঘরে এসে সোফায় গা এলিয়ে দিতে দিতে কোনো বই পড়তে। টুকটাক কথা বলতে। কিন্তু না, তাকেও ছুটতে হয় সামাজিকতা রক্ষা করতে। ও কোন সমাজ?
হ্যাঁ, তার এসব নতুন নতুন কালচারের প্রতি ঘৃণা ধরে গেছে। কী এক ফ্যাশন, সবাই এক রঙের শাড়ি পরতে হবে। এক রঙের সালোয়ার কামিজ পরতে হবে। এক রঙের শার্ট পরতে হবে। কখনো আরবি ড্রেস করতে হবে। এ কোন দেশে রে বাবা? এ কি বাংলাদেশ? এটা কি আসলেই বাঙালির সংস্কৃতি?
এক রঙের কাপড় পরতে হবে কেন? তোমরা কী সিনেমা করো জীবন নিয়ে? এই কথাগুলো কোনো পার্টির হোস্টকে বলতে পারলে সাহেদ শান্তি পেত। এসব তো সে বাংলা সিনেমার গ্রামের দৃশ্যে দেখেছে। নায়িকার সাথের সব সখীরা এক রঙের শাড়ি পরে ৪২ ইঞ্চি কোমর দুলিয়ে নাচে। এ কোন জগতে এলাম? বছর দশেক আগেও গ্রামে দেখেছি লন্ডনফেরত, আমেরিকাফেরতের বিয়ে–শাদিতে এ রকম ফ্যাশনের চলন। এক রং পরতে হবে। এখন গ্রাম্য ফ্যাশনই শহরের অতি মর্ডানদের পার্টি থিম! যারা এসব পার্টি দেয়, তাদের তো বোঝা উচিত, সবার সামর্থ্য না হতে পারে। দাওয়াত দাও বিনা শর্তে দাও। এত শর্ত দিয়ে জীবন চলে? এই রং পরতে হবে। ওই রং হলেও চলবে।
সাহেদ আরেকটা সিগারেট ধরাল। বাচ্চাদের হায়দরাবাদে পড়ানো, এটাও মিলির বুদ্ধি। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা খারাপ। রাজনীতি হয়। এই হয়, সেই হয়। এখন সব খরচ জোগাড় করতে তার হিমশিম খেতে হয়ে। অফিসের টাকা অ্যাডজাস্ট করে ফেলবে ফেলবে করেও সে এখনো কিছুই করতে পারছে না। কখন কোন অডিট হয়, ঠিক নেই। কিন্তু মিলির বায়না দিন দিন বাড়ছে। এ কী সংসার না লাগামহীন ঘোড়া?
প্রচণ্ড গরমের মাঝে গাছের পাতায় যে বাতাস বইছে, তা যেন তাকে উঠতে দিচ্ছে না। সে বসে আছে ঠাঁয়, কখন যে রাত গভীর হতে শুরু করেছে, বুঝতে পারেনি। চোখ তুলে মোবাইলে রাখতে যাবে, এমন সময় এক পুলিশ এসে ধমক দেয়।
এই শালা, এখানে এত রাতে কী করিস?
‘এ কী! ভদ্রভাবে কথা বলুন। পাবলিকের কি এখানে বসার আইন নাই।
শালা, তুই আমারে আইন শেখাস? তোরে এখন আইন দেখাব।
দেখুন, আমি আমার স্ত্রীর সাথে রাগ করে এখানে এসে বসেছি।
ও বউ চান্স দিচ্ছে না, তাই পার্কে বিউটি কুইন নাগা খুঁজতে আসছ?
দেখেন, বাজে কথা বলবেন না। আপনি যা ভাবছেন, এ রকম কিছু না।
কথা কম কন। ভাবাভাবি থানায় গেলে দেখবি।
পুলিশ কর্মকর্তা তার সাথের একজনকে বলল, এই শমসের শালারে খোলা মাঠে নারী কেলেঙ্কারির কেস দিয়ে থানায় নিয়ে চল। সাহেদ প্রচণ্ড অসহায় বোধ করছে। তার ফোনও ওরা দিচ্ছে না। আগে কয়েকবার মিলি ফোন দিয়েছে, সে ধরেনি। কিন্তু তার কথা বলা দরকার। থানায় যাওয়ার পরও ওকে ওরা কথা বলতে দিল না।
এদিকে সারা রাত চলে গেল। সাহেদ ফোন ধরল না। মিলি চিন্তায় অস্থির। এ রকম কখনো হয়নি। সামান্য এক শাড়ির জন্য এ রকম ঘটনা হবে, সে ভাবতেও পারেনি। সাহেদ তাকে বাসা ছাড়ার কথা বলে নিজেই বাসা ছেড়ে চলে গেছে। ফোন হাতে নিয়েও কাউকে বলতে পারল না। এসব বলা যায়? এমন সময় থানা থেকে ফোন এল!