মেহেদির রং...

মেহেদির রং তখনো হাতের কোমল স্পর্শ ছেড়ে যায়নি। মনের ভেতর নববধূর আমেজটাও জীবন্ত। এরই মধ্যে হঠাৎ খবর এল, আজ থেকেই ছুটতে হবে কর্মস্থলে। মনটা বিষণ্ণতার কালো মেঘে আচ্ছন্ন হলো অবন্তির। কিন্তু করার কিছুই যে নেই।

প্রবাসে একজনের উপার্জনে সংসারের জটিল হিসাব নাকি মেলে না। সূর্যোদয়ের দেশে পা রাখার পর থেকে গেল দশ দিন কিছু মানুষের কাছে এই কথা শুনতে শুনতে কর্ণযুগলে মরিচা পড়ে গেছে।

বিয়ের দুই মাস পরই প্রবাসী স্বামী পাড়ি জমাল জাপানে। এদিকে নতুন সংসারের অর্থ বোঝার আগেই একাকী স্বদেশে পড়ে থাকা স্ত্রীর বেহাল অবস্থা! একে তো স্বামী মানুষটাই নতুন, অন্যদিকে শ্বশুরবাড়ির অচেনা পৃথিবী! সব সময় মন ছটফট করত, কখন কাছের মানুষটার কাছে যাবে। নববিবাহিত জীবন নিয়ে কতই না জল্পনা–কল্পনা ছিল। কিন্তু বিয়ের পর এত দ্রুত স্বামী বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিল যে নবরঙ্গে নতুন মানুষটির হাত ধরে আর রঙিন স্বপ্নের নকশিকাঁথা বোনা হয়নি। দীর্ঘ এক বছরের প্রতীক্ষা শেষে অবশেষে খুব কাছের সেই মানুষ প্রিয়তমা স্ত্রীকে সূর্যোদয়ের দেশে নিয়ে এল। দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর দুজনের পুনর্মিলন। এবার নবদম্পতির প্রেমের পায়রা হয়ে শুধু উড়ে বেড়ানোর পালা। হাতে হাত রেখে সূর্যোদয়ের দৃশ্য দেখার পালা, তুষারপাতের অপরূপ হিমেল স্পর্শ অনুভব করার পালা। রাতজাগা পাখি হয়ে হাজারো অব্যক্ত কথার মোড়ক উন্মোচনের পালা। কিন্তু বিধি বাম! ডাক পড়েছে অজানা কর্মস্থলে! যেতেই হবে!

সদ্য জাপানে পা রাখা অবন্তি তখনো জানত না, কী পেশায় সে কাজ করতে যাচ্ছে। খুব কাছের এক বাঙালি সুহৃদ খুব তাড়াহুড়োর মধ্যেই একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। জাপানে এসেছে মাত্র দশ দিন। দেশটাকে এখনো ঘুরে দেখার সুযোগ হয়নি। এর মধ্যেই হঠাৎ সন্ধ্যায় কাজে যাওয়ার আহ্বান। কর্মস্থলে যাওয়ার আগে হাতের মেহেদির রং তুলে ফেলতে হবে। জাপানে আসার ঠিক আগের দিন খুব শখ করে দুহাত ভরে মেহেদি লাগিয়েছিল অবন্তি। মেহেদির হালকা রং নববধূর আমেজটা তখনো আঁকড়ে ধরে ছিল। কিন্তু কাজে যেতে হলে হাতে কোনো রং, আংটি, গহনা থাকতে পারবে না। অবন্তি মনে মনে ভাবল, এ কেমন ধরনের কাজ, যেখানে হাতের মেহেদির রং নিষিদ্ধ? জাপানিরা মেহেদির সঙ্গে পরিচিত নয়। যেভাবেই হোক, এ রং এখন আর রাখা যাবে না। শুরু হলো দুহাত থেকে কল্পনার রঙিন মেহেদির রঙের ওপর কঠিন বাস্তবতার প্রলেপ। লেবু, ডিটারজেন্ট থেকে ঘষা–মাজা চলতে চলতে শেষ পর্যন্ত পৌঁছাল ম্যাজিক ক্লিনের কাছে। ম্যাজিক ক্লিন দিয়ে হাঁড়ি–পাতিলের শক্তিশালী তেল, চর্বি খুব সহজেই দূর করা যায়। হাতের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর! তবুও অনেক যুদ্ধের পর মেহেদির রং বিদায় নিল। এবার কর্মস্থলে যাওয়ার পালা। যেতে হবে একলা। পথঘাট সব অচেনা। কাজ জোগাড় করে দেওয়া সেই সুহৃদ বাসা থেকে শুধু দেখিয়ে দিল রেলস্টেশনের পথটা। স্বামী কাগজে–কলমে বুঝিয়ে দিল, কোন ট্রেনে উঠতে হবে এবং কোথায় নামতে হবে।

সন্ধ্যা ছয়টায় মেয়েটি রওনা হলো রেলস্টেশনের উদ্দেশে। বুকে দুরু দুরু কাঁপন। অচেনা পৃথিবীতে যেতে একটুও মন সায় দিচ্ছে না, কিন্তু ভাগ্যবিধাতা হয়তো ভাগ্যে কঠিন যুদ্ধের পথ লিখে রেখেছে। কিছু করার নেই। ভয়ে ভয়ে রেলস্টেশনে গিয়ে সঠিক ট্রেনটিতে উঠে বসল। নামতে হবে এবিনায়। আইকো ইশিদা থেকে এবিনায় ট্রেনে যেতে লাগে মাত্র সাত মিনিট। মাঝে কেবল একটি স্টেশন—হোনাৎসুগি। সেই স্টেশনে নামা যাবে না। জাপানিজ ভাষায় অদ্ভুত এসব নাম মনে রাখা বেশ কঠিন। ট্রেন যখন আইকো ইশিদা থেকে হোনাৎসুগি পৌঁছাল, তখন ট্রেন একবার থামল। দলে দলে অনেক যাত্রী নেমে গেল। অবন্তিকে যেহেতু বলা হয়েছে, পরের স্টেশন এবিনায় নামতে হবে, তাই সে নেমে যাওয়া যাত্রীদের সঙ্গে নামল না। এবিনায় ট্রেন থামল। ধীর পায়ে ট্রেন থেকে নেমে চতুর্দিকে তাকাল। পরিচিত এক ভাবি সেই কোম্পানিতে চাকরি করেন। তিনিই বাকিটা পথ সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন। দেখা হলো তাঁর সঙ্গে। অচেনা পথের ভয়টাও কিছুটা দূর হলো। রেলস্টেশন থেকে বাসে করে যখন কর্মস্থলে পৌঁছাল, তখন ঘড়িতে বাজে পৌনে সাতটা। ভাবি তাকে নিয়ে দৌড়ে ভেতরে ঢুকলেন। অবন্তির কাছে সবকিছু ঘোলাটে মনে হচ্ছে। যখন জানতে চাইল কোন কোম্পানিতে, কিসের কাজ সে করতে যাচ্ছে, তখন তাকে বলা হলো, ফুড কোম্পানিতে ফুড প্রসেসিংয়ের কাজ। বাংলাদেশে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত মেয়েটির কাছে এ ধরনের কোম্পানিতে কাজ করার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। জীবনের অনেক বড় বড় স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে শুধু সংসারের মায়াজালে আটকা পড়ে আজ সূর্যোদয়ের দেশে ঘর বাঁধা। পিএইচডি করার অধরা স্বপ্ন এখনো তাড়া করে ফেরে প্রতিনিয়ত!

কোম্পানির দোতলায় ওঠার পর সেই ভাবি সাদা রঙের ইউনিফর্ম পরার নির্দেশনা দিলেন। যেহেতু খাবারের কোম্পানি, সেহেতু খুব পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন হয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে হবে। খাবারের কোম্পানিতে মাথার চুল সবচেয়ে বড় শত্রু। মাথায় পরতে হলো দুই ধরনের টুপি। রোলার দিয়ে চলল মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঘষামাজা। ধুলোবালি, চুল যেন কোনোভাবেই স্থান না পায়। এরপর আলাদা জুতা পরে বেসিনের সামনে সবাই লাইন ধরে দাঁড়াল হাত ধোয়ার জন্য। ভালোভাবে হাত ধুয়ে মূল কক্ষে যাওয়ার আগে একটি মেশিনের ভেতর দুহাত প্রবেশ করানোর পর অ্যালকোহল হাতে পড়ার পর ছোট রুমটির দরজা খুলে গেল। ভেতরে ঢোকার পর দরজা আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেল। রুমটির দুপাশে ছোট ছোট ছিদ্র দিয়ে বাতাস বের হয়ে এল। একে বলে এয়ার ওয়াশ। শরীরে যেন কোনো ধুলাবালি না থাকে, সে জন্য এ ব্যবস্থা। অবশেষে দরজা খুলে যখন মূল কক্ষে প্রবেশ করল, তখন মনে হলো যেন পুলসিরাত পার করে পবিত্র হয়ে কোথাও প্রবেশ করল।

ভেতরে সবার সঙ্গে লাইনে সেও দাঁড়াল। সবার সামনে বাক্সে নানা রকম খাবার। মেশিন চালু হলো। ছোট ছোট বাক্স সারি বেঁধে আসছে। যার যার সামনে রাখা বাক্সের খাবার, সেই লাইন দিয়ে আসা ছোট ছোট বাক্সে সাজাতে হবে। এসব বাক্সকে জাপানে বেন্থবক্স বলে। একটি বাক্সে ভাত, সবজি, মাছসহ নানা রকম খাবারে পূর্ণ থাকে। কর্মস্থলে কিংবা বাইরে দুপুর অথবা রাতের খাবারের চাহিদা মেটাতে জুড়ি নেই এ বেন্থবক্সের। খুব দ্রুত চলা মেশিনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাজাতে হয় এ বেন্থবক্স। কয়েকবার হাতছাড়া হয়ে গেল কিছু বাক্স। লাইনের সামনে দাঁড়ানো লিডার বিরক্ত হয়ে ছুটে এলেন। জাপানি ভাষায় অনেক কিছু বলতে লাগলেন। সদ্য জাপানে আসা অবন্তির ভান্ডারে অল্প কিছু জাপানি শব্দ ছিল, তা–ও মুহূর্তেই কর্পূরের মতো উড়ে গেল। কিছুই বুঝতে পারল না।

সঙ্গের ভাবিটি এসে কাজটা বুঝিয়ে দিলেন। আবারও শুরু হলো মেশিনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সেই আজব বাক্স সাজানোর পালা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার হয়, কিন্তু মেশিন আর থামে না। দুহাত যেন অবশ হয়ে আসে। অবশ হয়ে আসে শৈশব থেকে তিলে তিলে গড়া জীবনের লক্ষ্যের তাসের ঘর! যে হাত দিয়ে অসংখ্য শিক্ষার্থীকে লিখতে শিখিয়েছে, সে হাত আজ ব্যস্ত সম্পূর্ণ ভিন্ন এক বিচিত্র কাজে, যে কাজ করার জন্য একটুও মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না সে! জাপানে কোনো কাজকেই ছোট করে দেখা হয় না। কিন্তু আজন্ম শিক্ষকতার স্বপ্নে বিভোর মেয়েটি কোনোভাবেই এমন কাজ মন থেকে মেনে নিতে পারেনি! কাজ শেষে যখন মধ্যরাতে সেই ভাবির সঙ্গে বেরিয়ে এল, তখন আঁধার ছাপিয়ে হৃদয় ভাঙার গোঙানি কেবল অবন্তিই শুনেছিল। অবশপ্রায় হাতের দিকে তাকিয়ে বারবার সেই মেহেদির রংটুকু খুঁজে বেড়াচ্ছিল অবন্তি, যে রং মুছে গেছে প্রবাসের কঠিন বাস্তবতার আড়ালে।