মৃগী রোগীর হাতে একটি অণু

আজম সাহেব নামাজ পড়ছেন। মাগরিবের নামাজ। ওয়াক্ত হয়নি এখনো, তবুও পড়ছেন। মানুষটা খেয়ালখুশি মতো যা ইচ্ছে তাই করেন। ঘরের লোকজন তার কাজে বাধা দেয় না। গত দশ বছর ধরে তিনি উপার্জন অক্ষম। বয়স আর তেমন কী, পঞ্চাশ হবে হয়তো! হঠাৎ করেই একটি রোগ ধরা পড়ল! ডাক্তার বলল, এপিলেপসি। মৃগী রোগ নামেও পরিচিত এটা। শরীর কাঁপতে কাঁপতে আছড়ে পড়েন; কোনো পূর্বাভাস থাকে না। নামাজে রুকু দিতে গিয়েও পড়ে গেছেন কয়েকবার। হুঁশ হলে কাঁদেন। অঝোরে কাঁদেন। মানুষ তার ভাগ্যের কাছে অসহায়। যদিও ভাগ্যের সংজ্ঞা এখনো অসংজ্ঞায়িত।
আজম সাহেবের স্ত্রী মালিহা দরগায় দরগায় মানত করেন। স্বামীর আরোগ্য লাভের জন্য কত হুজুর-দরবেশ দেখিয়েছেন। আজমির শরিফ থেকে তবারক এনেছেন কয়েকবার। কাজ হয়নি কিছুই। মালিহা জানেন, তার স্বামী এগুলোতে বিশ্বাস করেন না। তবুও থেমে নেই সে। বিপদে মানুষ যুক্তিহীন হয়ে পড়ে। প্রকৃতি মানুষকে যুক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা দিয়েছে আবার সেটাকে গুটিয়ে নেয়ার নাটাইও হাতে রেখেছে। চব্বিশ বছর হয়ে গেছে দুজনের এক সাথে। স্ত্রীর কোনো কাজে তিনি বিরক্তবোধ করেন না। মানুষটা তাকে অনেক ভালোবাসে।
পরিবারের একমাত্র সন্তান আনু। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণ-রসায়ন পড়ে। বাবা চেয়েছিল মেয়ে ডাক্তার হোক। বাবাকে সারিয়ে তুলবে—এ স্বপ্ন ছিল মেয়েরও। সব স্বপ্নরা বড় হয় না। কিন্তু মানুষ বড় হয়। আজম সাহেব নিজেও শিক্ষিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান পড়েছেন। যদিও ব্যাংকে চাকরি করেছেন কিন্তু তার বিজ্ঞান পিপাসা ছিল সবসময়।
মেয়ের সঙ্গে গল্প করেন তিনি খুব। মেয়েকে কাছে নিয়ে তার ইচ্ছের কথা বলেন। বাংলাদেশে মৃগী রোগীদের জন্য কিছু করতে ইচ্ছে করে তার। মৃগী রোগীদের এ দেশে অনেক অবহেলা করা হয়।
বাবা, তুমি কী কখনো ছোটবেলায় এপিলেপসির রোগী দেখেছ?
হুঁ, দেখেছি। তোর দাদুর বাড়িতে দেখেছি। গ্রামে এর চিত্র খুবই বীভৎস! মৃগী রোগীদের নাকে জুতার গন্ধ শুকতে দেওয়া হয়। কেউ বলে, জ্বীনের আসর! কেউ বলে, আলগা বাতাস! নারীরা সবচেয়ে দুর্ভোগে থাকে। অনেক স্বামী মৃগী রোগী স্ত্রীর সঙ্গ ত্যাগ করে। দরিদ্র সমাজে এমন রোগী নিঃসঙ্গ। ভয়ংকর রকমের অসহায়! অসহায়ত্ব নিয়ে তারা শুধু নিজেদের মৃত্যু কামনা করেন।
কী বলছ এসব! ওহ মাই গড! ইটস এ হরর স্টোরি!
কড়িশূন্য মূর্খ সমাজটাই হরর। সেখানে মানুষের দোষ দিয়ে লাভ কী বল! সেটাকে বদলাতে হয়।
এপিলেপসির তো তেমন উন্নত কোনো চিকিৎসা নেই বাবা। এটাতো একটা নিউরো ডিজিজ।
আমি জানি মা। হয়তো অনেক পড়িনি! কিন্তু জানি এটার কোনো ভালো চিকিৎসা নেই।
বাবা, মানুষের মস্তিষ্ক খুবই জটিল একটি বস্তু। বিজ্ঞান এটি নিয়ে গবেষণা শুরু করেছে খুব বেশি দিন হয়নি। মস্তিষ্কজনিত অনেক রোগই উন্নত বিশ্বেও অজানা। ধীরে ধীরে গবেষণা বেড়েছে এখন।
তুই কী ব্রেইন নিয়ে গবেষণা করতে পারবি? নিউরো সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা হয় না?
পারব না কেন! নিউরো সায়েন্স এখন খুবই দারুণ বিষয়। গবেষণার জন্য চমৎকার!
দুই
কিছুদিন পর আনু বাসায় ফিরে এসে দেখে তার বাবা চোখ বুজে গান শুনছেন। লোক সংগীত তার প্রিয়। শরীরটা ভালো থাকলেই বারান্দায় বসে গান শোনেন। জীবনে যেন কোনো তাড়া নেই তার!
বাবা, বাবা!
আরে, তুই আজ তাড়াতাড়ি চলে এলি মনে হয় মা?
হুঁ। একটা সেমিনার ছিল আজ। শেষ হতেই চলে এলাম। দারুণ একটি খবর জানলাম।
কী বিষয়ে?
এপিলেপসি নিয়ে বাবা! এপিলেপসি নিয়ে গবেষণা হচ্ছে অনেক জায়গাতেই। খুব সম্প্রতি জাপানের কয়েকজন রসায়নবিদ একটি অণু নিয়ে কাজ করেছেন। তাদের গবেষণা থেকে দেখা গেছে অণুটি অনেক কার্যকরী হতে পারে।
কী বলছিস! তাই নাকি?
হুঁ বাবা, সত্যি বলছি! আজ সেমিনারে, একজন সেই আর্টিকেল সম্পর্কে সামান্য তুলে ধরল। গবেষণা খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে কিন্তু খুবই আশানুরূপ।
দারুণ খবর! তুই বুঝেছিস ঠিকমতো?
খুব ভালো করে বুঝেছি বললে মিথ্যে বলা হবে। বেশ জটিল কাজ। প্রকাশিত হয়েছে সায়েন্স ম্যাগাজিনে। বিজ্ঞানের জন্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রকাশনা এটা।
তাহলে নিশ্চয় খুব ভালো কাজই ওরা করেছে। আমাকে অণুটি দেখা তো। যদিও আমি এখন এগুলো বুঝব না তেমন!
আনু সেই অণুর মডেল তৈরি করে বাবার কাছে নিয়ে এসেছে। অণুর নাম আইসো-সেফরল। আজম সাহেব অণুটি হাতে নিয়ে হাসছেন। বাবার হাসির বিশুদ্ধ প্রতিফলন আনুর চেহারায়। মনে হচ্ছে মেয়ে তার আবিষ্কার দেখাচ্ছে বাবাকে।
তিন
আজম সাহেবের মন সেদিন খুব ভালো। তিনি বহুদিনের পুরোনো এক জামা বের করলেন। শাশুড়ি তাকে উপহার দিয়েছিলেন সেটি। মেয়ের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন বিকেল থেকে। সন্ধ্যা হতেই, ছাদে যেতে চাইলেন। আজ আর মাগরিবের নামাজ পড়বেন না। অনেক দিন ছাদে যাওয়া হয় না। বাবা আর মেয়ে যাওয়ার সময় মালিহা শুধু বললেন, তোর বাবাকে ধরে রাখিস।
আনু, তুই ব্রেইন নিয়ে গবেষণা করিস।
হুঁ বাবা, করব।
আচ্ছা, এই আইসো-সেফরল কী একজন মৃগী রোগীকে সারিয়ে তুলবে?
মনে হয় না বাবা। তুমি তো জানো, গবেষণায় চূড়ান্ত ফলাফল পেতে অনেক সময় লাগে। হয়তো আরও নতুন নতুন অণু গবেষণা করে বের করা হবে। অনেক কার্যকরী অণু। সেসব অণু হয়তো একজন এপিলেপসি রোগীকে সারিয়ে তুলবে।
হুঁ, বুঝতে পারছি। পৃথিবীতে মানুষের চেষ্টাই বিশুদ্ধ ও সুন্দর।
আনু হঠাৎ টের পেল তারা বাবা তাকে খুব শক্ত করে ধরছেন। বাবাকে আগলে ধরার আগেই তার গায়ে হেলে পড়লেন। বাবা বাবা বলে চিৎকার করতে লাগল সে। কোনো সাড়া পাচ্ছে না। হতভম্ব হয়ে আনু মাকে ডাকছে খুব! এশার নামাজের আজান শুরু হলো শহরময়। তার মায়ের কানে ডাক পৌঁছেনি তখনো।
(লেখক ডক্টরাল গবেষক, স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়, সুইডেন। ই-মেইল: [email protected])