‘মুজিবপাঠ’থাকুক স্কুল–কলেজে

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
ছবি: সংগৃহীত

পৃথিবীর বুকে বাঙালির যেমন রয়েছে সাহসের সুনাম, তেমনি সুনাম রয়েছে শিক্ষার। অথচ স্বাধীনতার পর পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির জন্য নিয়ে এসেছে এক কলঙ্কিত অধ্যায়, নিয়ে এসেছে অন্ধকার আইন। আর আমরা বাঙালি জাতি হারিয়েছি পিতা। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের রক্তের স্রোতোধারায় প্রজন্মের আলোকিত প্রত্যাশা ঘোরতর অমানিশায় নিমজ্জিত হয়েছে। লুণ্ঠিত হয়েছে জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা। যুক্ত হয়েছে বিকৃত ইতিহাসের ধূসর পাতা।

শিক্ষাব্যবস্থার নামে কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের ইচ্ছের ডালি পূর্ণ করে একের পর এক ভঙ্গুর বিল উপস্থাপন করে চলেছে কর্তামহল। তাই হয়তো বদ্ধ প্রশ্নের উন্মাদনায় বাংলাদেশের আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা বোবা উত্তরের হাত ধরে হেঁটে চলেছে যুগের পর যুগ। প্রজন্ম তাদের উৎসমূল থেকে ছিটকে পড়ছে কালের গহ্বরে। কারণ, বাঙালির স্বাধীনতার ইতিহাস, মুক্তির আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, বাঙালি জাতীয়তাবোধ আর চেতনাকে প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে আমাদের বোদ্ধামহলের কখনোই ছিল না কিংবা এখনো নেই সুপরিকল্পিত কোনো উদ্যোগ। অথচ ইতিহাস মুছে ফেলতে বদ্ধপরিকর যারা, তাদের তাঁবেদারিতে থমকে গিয়েছি। বাঙালির হাজার বছরের শৃঙ্খলমুক্তির কারিগর যিনি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানকে কিংবা তাঁর জীবন ও কর্মকে তুলে ধরতে শিক্ষাক্রম বা শিক্ষানীতিতে ‘মুজিবপাঠ’ নামে নেই কোনো স্পষ্ট অর্থাৎ স্বতন্ত্র প্রচেষ্টা। যেখানে পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস বিকৃতকারীদের দৃপ্ত পদচারণা আমাদের প্রজন্মকে আহত করছে, ব্যাহত করছে আমাদের মূল্যবোধ, নিহত করেছে আমাদের চেতনার উৎস।

কুসুমকুমারী দাশের বিখ্যাত কবিতা ‘আদর্শ ছেলে’–এর পঙ্‌ক্তি ইচ্ছেমতো পরিবর্তনের পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাধু ও চলিতের মিশ্রণ নিয়ে বিভ্রান্তি দূরীকরণে সম্পাদক মূল কবিতার নিচে ফুটনোট দিয়ে ‘পরিমার্জিত’ কথাটি না লিখেই ‘হইতে হবে’র স্থলে ‘হতেই হবে’ লিখে দিয়েছেন নিজ দায়িত্বে।

আমাদের বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই আমাদের বাঙালি চেতনার হারিকেনটি হাতে ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন যুগের পর যুগ। যেখানে বেশির ভাগ সময়ই আমরা দেখতে পেয়েছি, বাঙালি জাতীয়তাবোধের উৎসমূল জাতির পিতার জীবন ও কর্মের তাৎপর্য প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার বদলে আধুনিকতার নামে আলোর পথযাত্রী হতে শিক্ষাক্রমে প্রযুক্তি থেকে শুরু করে সংগীত কোনো কিছুই তো বাদ যায়নি। বাদ দিতেও বলছি না, বরং ছাড় যাওয়া অনেক কিছুই পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করে শিশু-কিশোরদের কাঁধের বোঝাটা বাড়াতে রয়েছে তাঁদের হাজারো ব্যস্ততা; বিষয়টি একটু দৃষ্টিগোচর করতে চাইছি। এমনকি প্রজন্মের কাছে বাঙালি চেতনাকে বিকশিত করতে নেই সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপ। অথচ প্রজন্মের কাছে আলোর প্রকৃত উৎসের ইতিহাস কিংবা ভূমিকা তুলে ধরতে ‘মুজিবপাঠ’ যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা কখনো কেউ সামনে আনার চেষ্টাই করেননি অথবা বলা যায় এড়িয়ে গেছেন অতি সন্তর্পণে।

আমরা জানি, শিক্ষাক্রমের নীতিমালা অনুযায়ী আমাদের দেশের লেখক, গবেষক, শিক্ষাবিদ ও মনস্তত্ত্ববিদের সমন্বয়ে অর্থাৎ বলা চলে অনেকটা তাঁদের সরাসরি হস্তক্ষেপে একটি প্রাথমিক শিক্ষাক্রম তৈরি করা হয়। আর এই শিক্ষাক্রম সামনে রেখেই পাঠ্যপুস্তক রচনার দায়িত্ব দেওয়া হয় যথাযথ কর্তৃপক্ষকে। এরপর একটি পরীক্ষামূলক সংস্করণ তৈরি করা হয়। শ্রেণিশিক্ষক, অভিভাবক, লেখক, সাংবাদিকসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তিরা তা পড়ে-দেখে-বুঝে মতামত দেন, পরামর্শ ও সুপারিশ দেন। এসব মতামত ও সুপারিশ যাচাই, বাছাই ও পরিমার্জন করে পাঠ্যবইয়ের চূড়ান্ত সংস্করণ করা হয়।

দায়িত্বের ভার বোদ্ধাদের বয়সের কাছে আঁটকে যাচ্ছে কিংবা অভিজ্ঞতা দায়িত্বের কাছে স্বীয়স্বরূপ হারিয়ে ফেলছে। কেবল তাই নয়। পাঠ্যপুস্তকে ভুলের পাল্লা ভারী হতে হতে কবির কবিতার লাইনও আজকাল ইচ্ছেমতো পরিবর্তিত হয়ে রূপান্তরের পথে। উদাহরণস্বরূপ—কুসুমকুমারী দাশের বিখ্যাত কবিতা ‘আদর্শ ছেলে’–এর পঙ্‌ক্তি ইচ্ছেমতো পরিবর্তনের পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাধু ও চলিতের মিশ্রণ নিয়ে বিভ্রান্তি দূরীকরণে সম্পাদক মূল কবিতার নিচে ফুটনোট দিয়ে ‘পরিমার্জিত’ কথাটি না লিখেই ‘হইতে হবে’র স্থলে ‘হতেই হবে’ লিখে দিয়েছেন নিজ দায়িত্বে।

অন্যদিকে সহজ বাংলা বোল তুলে আধুনিকতার নামে যুক্ত বর্ণ সম্পর্কে ধারণা নেই, এমন শিক্ষার্থীদের জন্য বানান ভেঙে লেখার দায় থেকে মুক্তি পেতে মুক্তিযুদ্ধ শব্দটির বানান ভেঙে ‘মুকতিযুদধ’ ও ‘বঙ্গবন্ধু’ বানানটি ‘ঙগ’ দিয়ে লেখা হয়েছে। সত্যিই এ যেন আধুনিক বাংলার ডামাডোল! এমন ভূরি ভূরি উদাহরণের ক্ষেত্রে ভুলের পাল্লাটি প্রজন্মের একজন কান্ডারি হিসেবে নিজের কাঁধে নিয়ে বলতে চাই, লেখক, সম্পাদক বা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়েই পাঠ্যপুস্তক রচনায় অগ্রসর হওয়া উচিত। যদি সবার পরামর্শ নেওয়া হয়েও থাকে তবে এ

বেহাল দশায় বলতেই পারি, এমন পাঠ্যক্রম প্রণয়নে ‘মুজিবপাঠ’ নিয়ে ভাবনা সত্যিই যেন অমাবস্যায় ভরা পূর্ণিমা তিথি। তবু বলছি, প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ‘মুজিবপাঠ’

নামে (৫০) কিংবা (১০০) নম্বরের স্বতন্ত্র বিষয় অন্তর্ভুক্তি এখন সময়ের দাবি।

সবশেষে আমার কেবল একটাই চাওয়া, বাঙালি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্বীয় অবদানে যিনি হয়ে উঠেছেন আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের আলোকিত উৎসের বহমান ফল্গুধারা, অদৃশ্য আঁধারের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এসে ‘মুজিবপাঠ’ নামক সেই উৎসের আলোয় আলোকিত হোক প্রজন্ম।