মুজিব জন্মশতবর্ষে পাঠশালার অন্তর্জাল আসর
কানাডার টরন্টোভিত্তিক সাহিত্যচর্চার প্ল্যাটফর্ম পাঠশালার ২২তম অন্তর্জাল আসর অনুষ্ঠিত হয়েছে গত ৭ নভেম্বরে। আসরটি নিবেদন করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিজ বয়ানে মুজিবকে জানার জন্য ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’, ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থত্রয়ী আমাদের পরম সম্পদ-আশ্রয়। শেখ মুজিবকে নিয়ে সব অস্বীকার-বিতর্ক-বিভ্রান্তি আর উন্নাসিকতার জবাব এই তিন বই। তাঁকে আগে ঢালাওভাবে বলা হতো নিছক একজন সংগঠক বা বড়জোর উদার হৃদয়ের একজন মানুষ। এসব বই পড়ে আমরা জেনেছি শেখ মুজিব আর আমাদের জাতির ইতিহাস যে অবিচ্ছেদ্য। জেনেছি তিনি ছিলেন বাঙালির মুক্তির একজন সার্বক্ষণিক মুখপাত্র। চিনেছি ব্যক্তিগত জীবনকে বিসর্জন দেওয়া আত্মত্যাগী একজন জাতীয় নেতাকে, যিনি জীবনের বেশির ভাগ সময় জেল খেটেছেন। আবিষ্কার করেছি একই সঙ্গে প্রাজ্ঞ-সাহসী-উদার একজন মানুষকে, যিনি আন্দোলন-সংগঠন-পরিস্থিতি মোকাবিলায় জাতির অনিবার্য এক নেতা হয়ে উঠেছিলেন। আবিষ্কার করতে পেরেছি তিল তিল সংগ্রামে গড়ে ওঠা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ককে। স্বাধীন দেশেও আমরা পেয়েছিলাম এমন একজন পিতাকে, যিনি একটা জাতিকে ধারণ করতে প্রস্তুত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আবার স্থায়ীভাবে ফিরে পেতে এই ‘মুজিব ট্রিলজি’ আমাদের দরকার ছিল। এই তিন বই ঘিরেই ছিল পাঠশালার আয়োজন।
আলোচনা করেন টরন্টো থেকে প্রকাশিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘নতুন দেশ’-এর সম্পাদক শওগাত আলী সাগর।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজীবনী সংকলন। ২০১২ সালের জুনে এ বইটি প্রকাশিত হয় দ্য ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল) থেকে। এ পর্যন্ত বইটি ১২টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের অনেক সময়ই কেটেছে জেলখানায় বন্দী অবস্থায়। ১৯৬৬-৬৯ সালে তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দী ছিলেন। এ সময়ে বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী ও সহধর্মিণীর অনুপ্রেরণায় তিনি জীবনী লেখা শুরু করেন। এই বইয়ে তিনি ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তাঁর আত্মজীবনী লিখেছেন। বইটির ভূমিকা লিখেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্পাদনা করেছেন লোকসাহিত্যবিদ ও গবেষক শামসুজ্জামান খান।
‘কারাগারের রোজনামচা’র প্রথম প্রকাশ মার্চ ২০১৭-তে, বাংলা একাডেমি থেকে। ‘কারাগারের রোজনামচা’ নামটি দেন বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা। বইটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে।
১৯৬৬ সালে ছয় দফা দেওয়ার পর মুজিব গ্রেপ্তার হন। ১৯৬৬ সালের মে থেকে ১৯৬৮ সালের জানুয়ারিা—২১ মাস তাঁকে সলিটারি কনফাইনমেন্টে রাখা হয়। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আবার তাঁকে কুর্মিটোলা সামরিক জেলে বন্দী করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়। সেই সময়ে কারাগারে প্রতিদিন ডায়েরি লেখা শুরু করেন। ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত লেখাগুলো এই বইয়ে আছে। তবে শুরুর একটা গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন কিন্তু আরেক খাতা থেকে। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করে তাঁকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠান। ওই সময়ের লেখা থেকে প্রথম অংশটি যুক্ত করা হয়েছে।
১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে, বঙ্গবন্ধুর বয়স যখন ৩২, তখন ‘পিস কনফারেন্স অব দ্য এশিয়ান অ্যান্ড প্যাসিফিক রিজিওন্স’-এ পাকিস্তান প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে নয়াচীন সফর করেন তিনি (ওই বছরই তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান)। ২৫ দিন থাকেন চীনে। সেই সময়ে ডায়েরিতে টুকে রাখা স্মৃতি থেকে ভ্রমণবৃত্তান্ত লেখেন ১৯৫৪ সালে কারাগারে রাজবন্দী থাকার সময়। তাঁর সেই ভ্রমণের সাত দশক পর ‘আমার দেখা নয়াচীন’ নামে বইটি বের হয়, ২০২০-এর বইমেলায়, বাংলা একাডেমি থেকে। ভূমিকা, রচনার প্রেক্ষাপট লিখেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৫৭ সালে পূর্ব বাংলার শ্রমমন্ত্রী থাকাকালে পাকিস্তান সংসদীয় দলের নেতা হিসেবে তিনি আরও একবার চীন সফর করেন। কিন্তু বইটা শুধু প্রথমবারের ভ্রমণ নিয়েই। তবে বইয়ের শেষে যুক্ত করা হয়েছে ১৯৫৭ সালে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয়বার চীন ভ্রমণের সময়কার বেশ কয়েকটি দুর্লভ আলোকচিত্র।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে নিবেদিত পাঠশালার আসরে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ ও ‘আমার দেখা নয়াচীন’—এই তিনটি বই আলোচনার মাধ্যমে মুজিবের বয়ানেই মুজিবকে নির্মোহভাবে তুলে ধরেন আলোচক শওগাত আলী সাগর। এ আসরের সঞ্চালনায় ছিলেন ফারহানা আজিম শিউলী।