মুক্তিযোদ্ধা বাবার সঙ্গে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে

বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের কবরের পাশে (২০১৬ সালে)
ছবি: সংগৃহীত

২০১৬ সালের নভেম্বর মাসের শেষ দিকে দেশে বেড়াতে যাই অস্ট্রেলিয়ার হোবার্ট শহর থেকে। সব কাছের মানুষের সঙ্গে অনেক দিন পর দেখা করা, আনন্দ করাই উদ্দেশ্য। সঙ্গে ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম দুটি দিবসে অংশগ্রহণ করা বাড়তি পাওয়া। একটি হৃদয়বিদারক ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। আর অন্যটি হাসি-কান্নাবিজড়িত ১৬ ডিসেম্বর—মহান বিজয় দিবস।

মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে আমার জানার আগ্রহ ছোট থেকেই। আর এ আগ্রহ তৈরি হয়েছে আব্বার কাছ থেকে। তাঁর মুখ থেকে শোনা মুক্তিযুদ্ধের অনেক গল্প, অভিজ্ঞতা, কষ্ট ও ত্যাগের কথা নিজের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের একটা কাল্পনিক ছবি এঁকে দিয়েছে। নিজের ভেতরে আব্বাকে নিয়ে গর্ববোধের অন্যতম একটা জায়গা তৈরি হয়েছে জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই। চাঁপাইনবাবগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সঙ্গে কিছুটা জড়িত থাকার কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক অনুষ্ঠানের বিষয়ে আব্বা অবগত।

৭ ডিসেম্বর আব্বা আমাকে বলেন, আমরা শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে সদর থানার সব মুক্তিযোদ্ধা জেলার সীমান্তে কানসাট এলাকায় সোনামসজিদে যাব। সেখানে বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের কবর জিয়ারতসহ আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। তুমি চাইলে আমাদের সঙ্গে আসতে পারো। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যরা অনুমতি সাপেক্ষে যোগদান করতে পারে। তুমি আসতে চাইলে আমি অনুমতি নিয়ে রাখব। কোনো কালক্ষেপণ না করেই আব্বাকে আমার সদিচ্ছার কথা জানালাম। উদ্দেশ্য হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা বাবার সঙ্গে আমার পুরো একটা দিন সময় কাটানো, বাংলাদেশের অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধাকে একসঙ্গে দেখা, যেটার সৌভাগ্য আমার আগে কখনো হয়নি, আর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা।

১৪ ডিসেম্বর সকালে ঘুম থেকে উঠে তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে আব্বার সঙ্গে অটোরিকশায় চড়ে শহরের কোর্টসংলগ্ন এলাকার উদ্দেশে রওনা হলাম, যেখান থেকে সবাই বাসে করে যাবে। হোবার্ট থেকে যাওয়ার কারণে মনে মনে বাইরের ঠান্ডাকে একেবারে পাত্তা দিতে না চাইলেও শরীরে আছড়ে পড়া বাতাসে ঠান্ডার তীব্রতায় ব্যাগে রাখা অতিরিক্ত সোয়েটার ও টুপি পরে নিজেকে ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচাতে থাকলাম। দেশের শীতও যে হোবার্টের হাড়কাঁপানো ঠান্ডার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে, এর অভিজ্ঞতা প্রথম হলো।

গন্তব্যে পৌঁছে দেখি, সবাইকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনটি বাস অপেক্ষমাণ। একটা বাসে উঠে আব্বা আমাকে জানালার দিকের সিটে বসতে বললেন। মনে মনে ভাবলাম, সন্তান বড় হয়ে গেলেও মা-বাবার কাছে তারা সেই ছোটই থেকে যায়। তাদের পছন্দ-অপছন্দ কী, সেটাও সব সময় মনে রাখেন। মা-বাবার মমতার কোনো কমতি নেই। তা কোনো স্কেলেও মাপা যায় না। তখন মনে পড়তে থাকল ছোটবেলা আমার ঘন ঘন জ্বর হতো আর ঠান্ডা লাগত বলে আব্বা নিজে পড়াশোনা করে ছেলের জন্য হোমিওপ্যাথি ডাক্তার হয়ে গিয়েছিলেন।

সামনে, পেছনে, পাশের সিটের সব কটিতেই মুক্তিযোদ্ধারা বসে আছেন। কোনো কোনো মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে আমার মতো তাঁদের সন্তান ও পরিবারও এসেছে। দেড় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে বাস তিনটি সকাল নয়টার দিকে রওনা হলো ঐতিহাসিক সোনামসজিদের উদ্দেশে। ১০ মিনিট পর বাসগুলো মহানন্দা-১ সেতুর পূর্ব পাশে বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের স্মৃতিসৌধে অল্প সময়ের জন্য যাত্রাবিরতি করল। স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্য। শ্রদ্ধাজ্ঞাপন শেষ হলে আবারও সোনামসজিদের পথে যাত্রা।

আব্বাকে বললাম, বাস পৌঁছাতে এখনো প্রায় এক ঘণ্টা লেগে যাবে। তো এ সময়ে আপনার কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের কিছু গল্প শুনি।

মনে মনে ভাবি, অনেক গল্প আগে শুনেছি, কিন্তু পুনরায় শোনার উদ্দেশ্য হলো এ সত্য ইতিহাসটুকু যাতে সহজে ভুলে না যাই। দেশের জন্য আমার বাবার অবদানটুকু যাতে গর্বভরে সর্বদা মনের গভীরে ধারণ করতে পারি। সব সময় মানসপটে চিরসবুজ থাকে। অন্যকে গর্বের সঙ্গে বলতে পারি।

বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের কবরে শ্রদ্ধা
ছবি: লেখক

আব্বা বললেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ২০ বছর। যুদ্ধ শুরু হলে আমি ভারতে চলে যাই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার ট্রেনিং নেওয়ার জন্য। আমাদের ট্রেনিং হতো পশ্চিমবঙ্গের রায়গঞ্জে কালিকী নদীর পাশে ট্রেনিং ক্যাম্পে। মনে কোনো পিছুটান ছিল না। মারা যাওয়ার কোনো ভয় ছিল না।

আব্বা বলতে থাকেন, তখন গায়ে শক্তি ছিল, মনেও ছিল সাহস। বয়সের ভারে এখন আর সেইগুলো নেই।

আমি জিজ্ঞেস করি, আব্বা, আপনি কত দিন ট্রেনিং করেছিলেন?

পাঁচ সপ্তাহ। ট্রেনিংয়ের সময়টা আরেকটু দীর্ঘ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বন্যার কারণে নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় ট্রেনিংয়ের সময়টা সংক্ষিপ্ত করা হয়। ট্রেনিং শেষ হলে আমরা সীমান্তে মহাদিপুরের ক্যাম্পে চলে আসি। সেখান থেকেই আমাদের অপারেশনগুলো শুরু হতো।

আপনাদের খাওয়াদাওয়া কেমন ছিল?

খাওয়াদাওয়া ভালোই দিত। সময়মতো দিত। ঠিক সময়ে ট্রেইনারের সঙ্গে ট্রেনিং করা, খাওয়াদাওয়া, আর ঘুমানো—এ ছিল আমাদের দৈনন্দিন কাজ সেখানে।

আপনাদের পোশাক কেমন ছিল?

সাধারণ পোশাক। মানে সাধারণ জামা, প্যান্ট আর লুঙ্গি।

ট্রেনিংয়ে কোনো কোনো অস্ত্র চালানো শিখেছিলেন?

রাইফেল, এসএমজি, এলএমজি, গ্রেনেড ছোড়া, মর্টার শেল নিক্ষেপ করা।

গ্রেনেড ছোড়ার সময় আপনার কোনো ভয় লাগেনি? যদি সত্যিই হাতে ফেটে যায়?
না। তখন কোনো ভয় ছিল না। দেশ স্বাধীন করতে হবে—এটাই শুধু মনে ছিল। আর ট্রেইনার আমাদের শিখিয়ে দিল। দেখিয়েও দিল কীভাবে ছুড়তে হয়। কখন মাথা নিচু করতে হবে, তা-ও দেখিয়ে দিল। কেউ কেউ অবশ্য একটু ভয় পেত। একটু আগেই মাথা নিচু করে নিত। বলে আব্বা হাসতে লাগলেন!

আব্বা, আপনি ট্রেনিং শেষে কোন জায়গায় যুদ্ধ করলেন?

ট্রেনিং শেষে আমাদের ২৯ জনের এক একটা টিম করে দিল। টিমে একজন কমান্ডার বা ক্যাপ্টেন নির্ধারণ করে দিল। আমাদের ক্যাপ্টেন ছিল শাজাহান ভাই। বাড়ি শিবগঞ্জে, যিনি স্বাধীন বাংলাদেশে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসন থেকে সাংসদ হয়েছিলেন। ওনাকে টিমের ক্যাপ্টেন করার প্রস্তাব আমি করেছিলাম। আমাদের অপারেশন করার জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানা আর রহনপুর থানার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

একটি অপারেশনের গল্প বলেন?

আমাদের সবচেয়ে কঠিন অপারেশন ছিল শিবগঞ্জের আদিনা ফজলুল হক কলেজের কাছে। আমরা পাঞ্জাবিদের একটি ঘাঁটি আক্রমণ করার জন্য ২৯ জনের টিমটি ভারতের মহাদিপুর থেকে সোনামসজিদ পথ পেরিয়ে আদিনা কলেজের দিকে রওনা হয়েছি। কাছাকাছি এসে একটি ক্যাম্প করি কলেজের অদূরে একটি জায়গায়। এ ক্যাম্পে আমরা আমাদের অস্ত্র ও জামাকাপড় রেখেছিলাম। কীভাবে যেন পাঞ্জাবিরা জেনে যায় আমাদের আসার ও ক্যাম্পের খবর। হঠাৎ দেখি তারা সংখ্যায় অনেক, আমাদের ঘিরে ফেলেছে। আমাদের দিকে গুলি শুরু করল। তখন আমাদের হাতের কাছে যা অস্ত্র ছিল, সেটা দিয়েই তৎক্ষণাৎ আমরাও পাল্টা গুলি শুরু করি। তাদের কাছে শুধু রাইফেল ছিল। আমাদের কাছে এসএমজি ছিল। আমাদের যে এসএমজি চালাত, সে অবিরত গুলি চালিয়ে তাদের কয়েকজনকে দমাতে পারল। আমি আর আমার সঙ্গে একজন মর্টার শেল ছুড়েছিলাম। একসময় আমাদের ক্যাম্পের যে অস্ত্র জোগানোর দায়িত্বে ছিল, সে গুলিবিদ্ধ হলো। যে এসএমজি চালাচ্ছিল, সেও গুলিবিদ্ধ হলো। তবে একজন খুব সাহসী ও শক্তিশালী ছেলে ছিল। সে এসএমজি চালানোর দায়িত্ব নিল। আর এসএমজি হাতে নিয়ে গুলি করতে করতে পেছনে সরতে লাগল। আমরাও সবাই গুলি করতে করতে পেছনে সরতে লাগলাম। নিরাপদ দূরত্বে এসে যখন আমরা কয়জন আছি গণনা করলাম, দেখলাম আমাদের ৬ জন নেই। তাদেরও অনেকজন মারা গিয়েছিল। সেদিন আমরা অনাহারে থেকে খালি পায়ে হেঁটে অনেক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আবার মহাদিপুরে পৌঁছেছিলাম। পরের দিন আমরা নতুন ৬ জন নিয়ে ২৯ জনের টিম করে আবার আক্রমণের জন্য আর আমাদের যারা মারা গিয়েছিল, তাদের লাশ আনার জন্য যেখানে যুদ্ধ হয়েছিল, সেখানে গেলাম। সেখানে গিয়ে জানতে পারি, পাঞ্জাবিরা সেই জায়গা ছেড়ে চলে গেছে আর আশপাশের মানুষ লাশগুলো কবর দিয়ে দিয়েছে।

আপনারা একটা অপারেশনের কয় দিন পরে আবার অপারেশনে যেতেন?

পরের দিনই। পাঞ্জাবিদের ক্যাম্পের তথ্য পেয়ে গেলেই অপারেশন শুরু হতো।

সাধারণ মানুষ আপনাদেরকে সহযোগিতা করত?

হ্যাঁ। তারা অনেকভাবে আমাদের সহযোগিতা করত। অনেক সময় খাবার দিত। রান্না করার ব্যবস্থা করে দিত।

যুদ্ধকালে আপনি কখনো দাদির সঙ্গে দেখা করতে বাড়িতে এসেছিলেন?

একবারই এসেছিলাম। মাকে খুব মনে পড়ত। তাই আমরা কয়জন একবার কাছাকাছি অপারেশনে এসে রাতের অন্ধকারে আমি মায়ের সঙ্গে দেখা করি। দেখা করার কিছুক্ষণ পরেই জানতে পারি, শান্তি কমিটির (শান্তি কমিটির লোকজন পাকিস্তানিদের তথ্য দিত) এক লোক আমাদের আসার খবর জেনে গেছে। তাই তাড়াতাড়ি সেই রাতেই মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাই। মা সেদিন অনেক কেঁদেছিল।

এভাবে আরও কিছু যুদ্ধের গল্প শোনার পরে বাস গন্তব্যে পৌঁছাল, যেখানে বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের কবর আছে।

বাস থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞাসা করলাম, আব্বা, আপনি ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরকে দেখেছেন?

না। আমরা তাঁকে পাইনি। তবে আমাদের অন্য টিমের মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে পেয়েছিল।

ইতিমধ্যে সোনামসজিদ-সংলগ্নে শয্যাশায়ী বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের কবরের কাছে চলে আসি। সেখানে আগে থেকেই অনেক মুক্তিযোদ্ধার সমাগম ঘটেছে তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। এ যেন মুক্তিযোদ্ধাদের মিলনমেলা। বাংলাদেশের এতজন বীরসন্তানকে একসঙ্গে দেখা এক সৌভাগ্যের ব্যাপার।

সব মুক্তিযোদ্ধার শরীর ও চেহারায় সময়ের স্বাভাবিক নিয়মে বৃদ্ধের ছাপ। শরীরে আগের সেই জোরটা নেই। কারও কারও শরীরের অর্ধেকটা বয়সের ভারে একটু ঝুঁকে গেছে। ভেবে বিস্মিত হই যে এ সাধারণ মানুষগুলোই পাঁচ দশক আগে শত্রুপক্ষের বন্দুকের সামনে দাঁড়াতে একটুও ভয় পাননি। গুলি, বেয়োনেটকে দেখে ভয় পাননি। একের পর এক শত্রুদের পরাজিত করে দেশকে স্বাধীন করেছেন। কী বীরত্বই না সবার মনের ভেতরে! বুকের ভেতরে!

অল্পক্ষণের মধ্যেই বীর শহীদদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে দোয়া করা হলো।

কবরসংলগ্ন ফাঁকা জায়গাটিতে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। শহীদদের প্রতি সম্মান জানাতে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন ও জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হলো। তারপর আলোচনা সভায় সম্মানিত বক্তারা একে একে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতা ও শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের ওপর তাৎপর্যপূর্ণ অনেক বক্তব্য দিলেন। অনেকক্ষণ পর আব্বা আমাকে বললেন, চলো, তোমাকে গণকবর ও জিরো পয়েন্ট (সোনামসজিদ স্থলবন্দরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যস্থলে সীমান্তভূমি) দেখিয়ে নিয়ে আসি।

প্রথমে গণকবরে গেলাম। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক মানুষকে পাকিস্তানিরা নির্মমভাবে হত্যা করে একসঙ্গে কবর দিয়ে রেখেছে। সেখানে দাঁড়িয়ে নিহত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সঙ্গে তাঁদের প্রতি বর্বরতার চিন্তা করে অজান্তেই মন অশ্রুসিক্ত হয়। অল্প সময় পরে গণকবর থেকে আমরা জিরো পয়েন্টে চলে আসি। ইতিমধ্যে আরেকজন মুক্তিযোদ্ধা আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন, যিনি আব্বার সঙ্গে একত্রে যুদ্ধ করেছেন। চাচার সঙ্গেও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কথা বলি। বিশেষভাবে তাঁদের প্রতি নিজের কৃতজ্ঞতা জানাই। চাচাকে বলি, আপনাদের জীবন বাজি রেখে বহু কষ্ট, ত্যাগ, অবদানের ফলে আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি। আপনাদের কাছে আমরা আজীবন ঋণী।

চাচা দুঃখ করে বলেন, এখন কেউ কেউ বলে, আমরা নাকি দেশ স্বাধীন করে ভুল করেছি। চাচার মুখে স্পষ্ট কষ্টের ছাপ। আমি বলি, চাচা, যারা এ কথা বলে, তাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে বড় কোনো সমস্যা আছে। চাচাকে সান্ত্বনা দিই, অল্প কিছু মানুষের কথা শুনে মন খারাপ করবেন না। আপনারা দেশের জন্য যা করেছেন, তার জন্য দেশের সব মানুষ আপনাদের মনে রাখবে। আমরা আপনাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ।

গল্প করতে করতে ভ্যানে করে আমরা জিরো পয়েন্টের কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। জিরো পয়েন্ট খুব ব্যস্ততম একটি জায়গা বলে মনে হলো। যেখান দিয়ে পণ্যবাহী ট্রাক অবিরত বাংলাদেশ ও ভারতের ভেতরে যাতায়াত করছে।

আব্বা আমাকে ভারতের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, ওই যে দেখছ উঁচু মতো মাটির বাঁধ, তার ওই পাশের বাঁ দিকে কিছু দূর হেঁটে গেলেই ভারতের মহাদিপুর, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের ক্যাম্প ছিল। সেখান থেকেই অপারেশনের জন্য আমরা দেশে আসতাম। আর এই যে রাস্তাটা দেখছ, এটাই আমাদের প্রধান রাস্তা ছিল, যেটা দিয়ে আমরা বিভিন্ন দিকে অপারেশনে যেতাম।

আব্বা বলতে থাকেন, একসময় আমি এ রাস্তার ওপর পুরো দুদিন পাহারা দিয়েছিলাম। এখানে তখন কোনো বাড়ি ছিল না। সাপের অনেক উপদ্রব ছিল। অনেক সাপ দেখা যেত।

আমি জিজ্ঞাসা করি, সাপের কোনো ভয় লাগত না?

আব্বা উত্তরে বললেন, সামনাসামনি যুদ্ধেই কোনো ভয় লাগত না। সেখানে কি আর সাপের ভয় লাগে!

সেখানে কিছু সময় কাটানোর পরে সোনামসজিদে ফেরার পথে হজরত শাহ মখদুমের মাজার দেখতে তোহাখানা যাই। সময়ের ঢেউয়ে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির নুড়িপাথরগুলো খুঁজে বেড়াই সেখানে। যেখানে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময় প্রিয় রহিতুল্লাহ স্যার ও ওনার প্রাইভেট ব্যাচের আমাদের অনেক বন্ধুর সঙ্গে এ ডিসেম্বর মাসে বনভোজনে এসেছিলাম। বন্ধুদের সঙ্গে অনেক মজার দিন কেটেছিল সেদিন! ঊর্ধ্বশ্বাসে কিছুক্ষণ সবার পদচিহ্ন খোঁজার বৃথা চেষ্টা করে গেলাম! সময় ঘনিয়ে আসার কারণে তাড়াতাড়ি আবার সোনামসজিদে চলে আসি। সেখানে দুপুরের খাবার সেরে বিকেলে বাসে করে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হই।

বড় হয়ে আব্বার সঙ্গে সারাটা দিন একত্রে কখন কাটিয়েছি কি না, মনে নেই। দিনটি আব্বার সঙ্গে, একজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে, কাটানো আমার জীবনের একটি সৌভাগ্যময় দিন। শ্রেষ্ঠ দিন, নিঃসন্দেহে। হয়তো এমন দিন আর কখনো আসবে না। তবে আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের আর মুক্তিযোদ্ধা বাবার সঙ্গে স্মৃতিময় সময়টুকুর গল্প করার জন্য দিনটি স্মৃতিপটে চির অম্লান থাকবে।

কল্পনা করতেই বুকের মধ্যে হাহাকার ওঠে যে আজ থেকে আর খুব বেশি দূরে নয়, যখন হয়তো আর কোনো মুক্তিযোদ্ধাই বেঁচে থাকবেন না, যাঁরা আমাদের একটি স্বাধীন দেশ দিয়েছেন। আমাদের বলার অধিকার দিয়েছেন, আমার দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশ যত দিন বেঁচে থাকবে, ‘৭১ যত দিন বেঁচে থাকবে, তত দিনই আপনারা মানুষের মনের ভেতরে বেঁচে থাকবেন। ভুলতে চাইলেও কোনো না কোনোভাবে, কখনো না কখনো, মনের আয়নায় অজান্তেই আপনাদের ছবি ফুটে উঠবেই!’

বি. দ্র.: লেখাটি ২০১৬ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে বাবার সঙ্গে কাটানো সময়ের ডায়েরি থেকে নেওয়া।