মিশিগানে পিঠাপুলিতে একুশ

সাংস্কৃতিক পরিবেশনার একটি দৃশ্য। ছবি: সাইফুল আজম সিদ্দিকী
সাংস্কৃতিক পরিবেশনার একটি দৃশ্য। ছবি: সাইফুল আজম সিদ্দিকী

মিশিগানের প্রবাসী বাংলাদেশিদের আয়োজনে হয়ে গেল ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠান পিঠাপুলিতে একুশ পালন। প্রবাসজীবনেও দেশীয় সংস্কৃতির ছোঁয়া এনে দিতে মিশিগানে উইক্সম শহরের কমিউনিটি সেন্টারে ভাষা দিবসের পাশাপাশি আয়োজন করা হয় বাংলাদেশি পিঠা উৎসব।

মিশিগানে যথাযোগ্য মর্যাদায় ও ভাবগাম্ভীর্যে মিশিগান বেঙ্গলস ক্লাব আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করে।

গত শনিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) বিকেল পাঁচটা থেকে প্রবাসী বাংলাদেশি আমেরিকানদের অংশগ্রহণে পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও পিঠা উৎসব। স্থানীয় শিল্পীদের উপস্থাপনায় ছিল মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

বিকেল পাঁচটার পর থেকেই কমিউনিটি সেন্টারের মিলনায়তনে দেশীয় পোশাক সাদা–কালো রঙের শাড়ি পাঞ্জাবি পরে হাজির হতে থাকেন প্রবাসীরা। কনকনে ঠান্ডা আর তুষারপাতকে পাশ কাটিয়ে হঠাৎ আকাশে দেখা দেয় বিকেলের মিষ্টি রোদ। অনুষ্ঠান স্থলে পৌঁছাতেই চোখে পড়েছে থরে থরে সাজানো পিঠা। প্রতিটি পিঠার প্লেটে চোখধাঁধানো সব নাম আর প্রস্তুতকারীদের নাম।

সাংস্কৃতিক পরিবেশনার একটি দৃশ্য। ছবি: সাইফুল আজম সিদ্দিকী
সাংস্কৃতিক পরিবেশনার একটি দৃশ্য। ছবি: সাইফুল আজম সিদ্দিকী

তুষারে ঢাকা শ্বেতশুভ্রতা আর কনকনে শীতে নতুন ধানের চালের গুঁড়ায় তৈরি পিঠার অতুলনীয় স্বাদ নিতে ভোলেননি মিশিগানের প্রবাসী বাংলাদেশিরা। নোভাই-নর্থভিল, কেন্টন, আন আরবার, ট্রয় উইক্সম, ফারমিংটন হিলস সাগিনাও শহরের আশপাশের বাংলাদেশিরা মিলিত হন মিশিগান বেঙ্গলসের এ আয়োজনে। মঞ্চসজ্জা করা হয়েছিল প্রমাণ সাইজের শহীদ মিনার আর ফুল দিয়ে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতেই হল ভরে যায় আগত অতিথিতে। লোকসমাগম দেখে মনে হয় পরবাসে এ যেন ছোট্ট একটি বাংলাদেশ।

প্রতিটি পরিবার একথালা করে পিঠা নিয়ে হাজির হয়েছেন। উৎসবে ভাপা, পুলি, চিতই, পাটিসাপটা, চন্দ্র বাহার, চুঙ্গা পিঠা, গোলাপ ফুল পিঠা, লবঙ্গ লতিকা, রস ফুল পিঠা, জামদানি পিঠা, হাঁড়ি পিঠা, ঝাল পোয়া, ঝুরি পিঠা, ঝিনুক পিঠা, সূর্যমুখী পিঠা, নকশি পিঠা, নারকেল পিঠা, নারকেলের ভাজা পুলি, দুধ চিতইসহ বিচিত্র নামের ও সৌন্দর্যের সব পিঠার সৌন্দর্যে ভরপুর ছিল। ছিল ময়মনসিংহ, বরিশাল, বগুড়া, নোয়াখালী, রাজশাহী, নরসিংদী, সিলেট ও চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী নানা ধরনের পিঠাও। পিঠার সেই ম–ম গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে পুরো হলরুমে।

সাংস্কৃতিক পরিবেশনার একটি দৃশ্য। ছবি: সাইফুল আজম সিদ্দিকী
সাংস্কৃতিক পরিবেশনার একটি দৃশ্য। ছবি: সাইফুল আজম সিদ্দিকী

৬টা ৩০ মিনিটে অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক ও মিশিগান বেঙ্গলসের পরামর্শক আবেদুর রাসুল মিন্টু ও যুগ্ম আহ্বায়ক শারমিন হেলাল আগত অতিথিদের ধন্যবাদ জানিয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন।

সাংস্কৃতিক পর্বের প্রথমেই ভাষাসংগ্রামের ওপর অনবদ্য এক পরিবেশনা ছিল প্রবাসে বেড়ে ওঠা শিশু–কিশোরদের। এতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর চরিত্রে ছিল ফাইয়াজ ভূঁইয়া। ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’–এর নৃত্যে ছিল ছোট্ট বন্ধু আলিশবা, আলিশা, তাজরী, শায়রিন ও মঞ্জুরী।

ভাষার দাবিতে মিছিলের অংশে ছিল আয়ান, শারার, আরিজ, আরিয়ান, রিয়ান, ইহান, আতিফ। ‘আমি বাংলায় গান গাই’ গানের মাধ্যমে এ পর্বের শেষ হয়। এ গানে অংশ নেয় এলিশা, শ্রেয়া, রায়া, রিদিতা, ফারিজা, জারা ও ফারিয়া। এ পর্বের সমন্বয়ে ছিলেন রিশাদ ফারিহা।

‘রক্ত লাল, রক্ত লাল’ গান সমবেত কণ্ঠে পরিবেশন করেন আবেদুর রাসুল, ফরিদ চৌধুরী, জাফরি আল ক্বাদরী, মোহাম্মদ মামুন, ফজলে আহাদ, মারুফ মনোয়ার, নাজমুল আনোয়ার ও ইফাজ করিম। উৎসবে প্রবাসে বেড়ে ওঠা বাংলাদেশি কিশোরীদের অংশগ্রহণে দেশের গান ‘সুন্দর সুবর্ণ’–এর সঙ্গে নাচ করে আলিশবা, আলিশা, তাজরী, শায়রিন, মঞ্জুরী, আতিফ আরিয়ান, রিয়ান ও ইহান। বড়দের নাচে ছিলেন এমি ইসলাম, সুমাইয়া করিম শাম্মা, শারমিন তানিম ও সানজিদা বন্যা।

সাংস্কৃতিক পরিবেশনার একটি দৃশ্য। ছবি: সাইফুল আজম সিদ্দিকী
সাংস্কৃতিক পরিবেশনার একটি দৃশ্য। ছবি: সাইফুল আজম সিদ্দিকী

দেবাশিষ মৃধা ও চিনু মৃধা আগতদের উদ্দেশে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন। সেরা পিঠার জন্য পাঁচজন, স্বেচ্ছাসেবার জন্য পাঁচজন, লটারির মাধ্যমে পাঁচজন ও দুজনকে সাংস্কৃতিক অংশগ্রহণের জন্য পুরস্কৃত করা হয়। সেরা পিঠার জন্য পুরস্কার পান শান্তা খন্দকার, নীপা ভূঁইয়া ও ফারজানা ফেরদৌস।

‘একটা গান লিখো আমার জন্য’ পরিবেশনায় ছিল জারা আনোয়ার। ‘একতারা তোর দেশের কথা’ গান পরিবেশন করে মা–মেয়ে আমিতা মৃধা ও চিনু মৃধা। ‘অলির কথা শুনে’ পরিবেশন করেন নাজমুল আনোয়ার ও আইরিন সুলতানা দম্পতি। রিশাদ ফারিয়া শোনান আধুনিক গান ‘একটা ছেলে’। ‘আগে যদি জানতাম’ গেয়ে শোনান ফজলে আহাদ। ‘ওরে নীল দরিয়া’ ও ‘তারায় তারায় রটিয়ে দেব’ পরিবেশন করেন শাফকাত রহমান। ‘তোমার ঘরে বসত করে’সহ দুটি গান করেন ত্রিনা বড়ুয়া। দেশের গান ‘সুন্দর সুবর্ণ’ পরিবেশন করেন শিমুল ইউসুফ। ‘সালাম সালাম’ পরিবেশন করেন জাফরি আল ক্বাদরী। এ ছাড়া শাকিল খন্দকার ও নিলুফা আক্তার বেশ কিছু জনপ্রিয় গান গেয়ে শোনান।

উৎসবে সাজিয়ে রাখা পিঠা। ছবি: সাইফুল আজম সিদ্দিকী
উৎসবে সাজিয়ে রাখা পিঠা। ছবি: সাইফুল আজম সিদ্দিকী

পিয়ানোতে ‘বড় আশা করে এসেছি গো কাছে ডেকে নাও’ রবীন্দ্রসংগীত বাজিয়েছেন শ্রেয়া হাসান। ‘একবার যেতে দে মা’ গিটারে শোনান মিথুন। ‘পৃথিবীর সবচেয়ে মর্মঘাতী রক্তপাত’ কবিতা আবৃতি করেন পপি দাস। নুরুলদীনের সারা জীবনের একাংশ পড়ে শোনান সাইফ সিদ্দিকী।

আগত সব অতিথির পিঠাসহ অংশগ্রহণের জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ফাইসাল সাইদ ও আবেদুর রাসুল।

একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনা শুধু বাঙালি সংস্কৃতিরই নয় বরং বিশ্বের বৈচিত্র্যপূর্ণ ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার এক অবিনাশী চেতনা। প্রবাসে বেড়ে ওঠা প্রজন্মের জন্য বাংলাদেশিদের অহংকার বাংলা ভাষা ও তার সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সাংস্কৃতিকে জানানোর আয়োজনের জন্য সবাই আয়োজকদের সাধুবাদ জানান।