আমি বেশির ভাগ সময় আমার কথাই লিখি। আবার মাঝেমধ্যে অন্যের বিষয়–বাসনাও আমার লেখালেখিতে সগৌরবে জায়গা করে নেয়। আজ যাঁর কথা লিখতে বসেছি, তিনি নিঃসন্দেহে একজন অতি সম্ভাবনাময় গবেষক, সমাজবিজ্ঞানী ও শিক্ষক। তিনি পল অ্যান্ডারসন। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জগৎখ্যাত এক তরুণ অধ্যাপক।
অনেক দিন আগে ড. অ্যান্ডারসন অথবা তাঁর গবেষণাকাজের সঙ্গে আমার একটা আশাহীন ভাসা–ভাসা যোগাযোগ হয়েছিল। কীভাবে, কোন সূত্রে—সেসব কথা আজ আর মনে নেই; তবে যেটুকু ভুলিনি, তা হলো ২০০৮-০৯ সালের দিকে তিনি যখন স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডির ছাত্র, তখন সিরিয়ার ঐতিহাসিক নগরী আলেপ্পোতে গিয়ে তাঁর অভিসন্দর্ভের মালমসলা জোগাড় করেছিলেন।
গবেষণাকাজে তাঁকে সে দেশে থাকতে হয়েছিল পনেরো মাস। থিসিসের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে ওই সময়ে, ওই পরিস্থিতিতে স্কটল্যান্ড থেকে ড. অ্যান্ডারসনের সিরিয়ায় যাওয়ার দুঃসাহসী অভিযানের কারণে তাঁর গবেষণার প্রতি আমার বিশেষ আগ্রহ ও কৌতূহল তৈরি হয়। আমি এই নির্ভীক জ্ঞানপিপাসু মানুষটির প্রতি একটু দুর্বল হয়ে পড়ি এবং তাঁর থিসিসের কপি চেয়ে একটি ই–মেইল ছেড়ে দিই।
তার আগে আমার মনের দোদুল্যমানতা কাটাতে বেশ সময় লেগেছিল, কারণ, ক্যামব্রিজের সঙ্গে আমার অতীত অভিজ্ঞতা খুব সুখকর নয়। একাডেমিক কাজে এই নামীদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনেকের কাছে অনেকবার লিখেছি, এখনো তাঁদের উত্তরের আশায় পথ চেয়ে আছি। আজ মুহূর্তের মধ্যে অলৌকিকভাবে আমি অনেক দিনের সেই সব হতাশার কথা ভুলে গেলাম, আমার হৃদয়তৃষ্ণার কাছে মনের দোদুল্যমানতা হার মানল এবং আমি অপ্রত্যাশিতভাবে জিতেও গেলাম।
পল অ্যান্ডারসন সঙ্গে সঙ্গে আমার ই–মেইলের জবাব দিয়েছেন, থিসিসের কপি পাঠিয়েছেন এবং বিনীতভাবে অনুরোধ করেছেন, তাঁর গবেষণার তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়েও যদি আমার কোনো মন্তব্য তাঁকে জানাই, তবে তিনি খুশি হবেন, বাধিত থাকবেন। দোদুল্যমানতা কাটতে না কাটতে এখন আরেক বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেলাম। ‘হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা’ আমার এই নতুন বন্ধুর থিসিসের অতি সামান্য একটি বিষয় নিয়ে আজ আমি লিখছি এবং লিখছি বাংলায়।
এবার বলুন তো কী করে বোঝাই তাঁকে আমার মনের কাঁচা আর এলোমেলো কথাগুলো। ইংরেজিভাষী মানুষ, মুসলমান ও আরব সংস্কৃতির ওপর থিসিস লিখতে গিয়ে বোধ করি, আরবি ভাষা রপ্ত করেছেন। এখন আমার একটি অকিঞ্চিৎকর মন্তব্য সমঝে নেওয়ার জন্য তাঁকে যদি আবার বাংলা শিখতে হয়, সে কত বড় বিড়ম্বনা! বিড়ম্বনা কি শুধু তাঁর? আমারও কম নয়। শুরুতে যত সহজ ও সরল ভেবেছিলাম, এখন দেখছি, কথাগুলো যেমনই হোক, তা গুছিয়ে লেখা আমার জন্য বেশ শক্তই হবে।
পল অ্যান্ডারসনের থিসিসের শিরোনাম হলো: থ্রেডস অব ভার্চ্যু: দ্য এথিক্যাল লাইভস অব সিরিয়ান টেক্সটাইল ট্রেড্রারস। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে থিসিসটি তিনি ডিফেন্ড করেছেন ২০১১ সালে। দীর্ঘ ২৮১ পৃষ্ঠার গবেষণাপ্রবন্ধ। আমি কম্পিউটার স্ক্রিনে ফাইল খুলে ধীরে ধীরে আগাসে গোড়া পাতার পর পাতা আলোর সাগরে চষে বেড়িয়েছি। সাবধানে চোখ বুলিয়েছি, মাঝেমধ্যে বেশ মজার মজার বিষয়াবলি নজরে এসেছে, থেমেছি, পড়েছি; কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতেই হয়, বন্ধু পল অ্যান্ডরসন আমার চঞ্চল মনকে তাঁর থিসিসের পাতায় ধরে রাখতে পারেননি। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে শেষের দিকে ২৩০ পৃষ্ঠায় এসে এক জায়গায় থামলাম; যেখানে লেখক-গবেষক মিসাল দিয়ে বুঝিয়েছেন, ‘মিথ্যা কখন মিথ্যা হয়’।
এখানে এসে আমি একটু চিন্তা করার খোরাক পেলাম, দম নিলাম, চোখ বুজে কতক্ষণ ভাবলাম। বুঝলাম, আটলান্টিকের ওপার থেকে আমার মতোই একজন অজানা–অচেনা শিক্ষক আমার ভোঁতা অনুভূতিতে আচমকা একটি ধারালো সুচের খোঁচা বসিয়ে দিয়েছেন। এই খোঁচা খেয়ে আমার মগজে যে প্রসববেদনা উঠল, এই রচনা সেই বেদনাপ্রসূত নবজাত শিশু বৈ আর কিছুই নয়।
উৎপাদন, কেনাবেচা, ব্যবসা-বাণিজ্য, লোকসান-মুনাফা ইত্যাদি আমাদের জীবন ও যাপনের অতি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এসব বিষয়-বিবেচনা সব যুগে সব মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। বিশেষ করে যাঁরা ব্যবসা করেন, তাঁদের বেলায় তো আরও তাজা, আরও সত্য। দিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁরা এগুলোকে অবলম্বন করেই দৈনন্দিন মোয়ামেলাত চালিয়ে যান। এ চলার পথে সচেতন কিংবা অবচেতন মনে ব্যবসায়ীরা অহরহ নীতিনৈতিকতার সীমা লঙ্ঘন করে থাকেন। কখনো বুঝতে পারেন, কখনো পারেন না। কোনো সময় অনুতপ্ত হন, কোনো সময় হন না।
আবার অনেক সময় তাঁরা এসবের ধারও ধারেন না, উন্মাদের মতো টাকার পেছনে দৌড়ান।দৌড়াতে দৌড়াতে জীবনের সীমিত সুদীর্ঘ মাঠ পেরিয়ে আসেন। শেষ প্রান্তে এসে দেখেন, কেবল ব্যর্থতা ও বঞ্চনার এক ভারী বোঝা তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে। এ বোঝা দেখতে যত সূক্ষ্ম, বইতে তত স্থূল। এসব বাস্তবতাকে মাথায় রেখে, পল অ্যান্ডারসন মাসের পর মাস অ্যালেপ্পো শহরের ব্যস্ত বাণিজ্যকেন্দ্রের আনাচকানাচে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তন্তু কারবারি ও বস্ত্র ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ওঠাবসা করেছেন, খানাপিনা উপভোগ করেছেন, দোস্তিয়ানা করেছেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলেছেন, তর্কবিতর্কে মশগুল থেকেছেন, অনেক কিছু জেনেছেন, অনেক কিছু শিখেছেন।
তিনি তাঁর আরব বন্ধুদের নীতি–নৈতিকতা, ব্যবসাসংস্কৃতি, কূটকৌশল, ঠকাঠকি, প্রতারণা, প্রবঞ্চনা ইত্যাদির বিভিন্ন মাত্রা আন্তরিকভাবে বোঝার কোশেশ করেছেন। শুধু তা–ই নয়, তরুণ গবেষক এসব খুঁটিনাটি বিষয়-আশয় সমাজবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক মানদণ্ডে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন এবং পরিশেষে এখান থেকেই তৈরি হয়েছে তাঁর মূল্যবান অভিসন্দর্ভ, যার ওপর ভিত্তি করে তিনি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি হাসিল করেছেন।
আলেপ্পোতে এই প্রক্রিয়ার মধ্যে সমবয়সী যে মানুষটির সঙ্গে অ্যান্ডারসনের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, তাঁর নাম ‘মুহী’। মুহী ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রাচীন নগরীর এক ধনাঢ্য তন্তু ও বস্ত্র ব্যবসায়ীর ছেলে। সম্ভবত মুহীর মাধ্যমে আরও কয়েকজন তরুণ সিরীয় তন্তু কারবারির সঙ্গে পিএইচডি–প্রত্যাশী অ্যান্ডারসনের জানাশোনা হয়। তাঁদের মধ্যে আছেন আ’লা আল-দীন, ইব্রাহিমসহ আরও অনেকে।
মুহীর সঙ্গে তাঁর বিদেশি বন্ধুর অনেক মজার মজার অভিজ্ঞতার কথা এই গবেষণাগ্রন্থে পাওয়া যায়; কিন্তু আমার এ লেখার জন্য প্রাসঙ্গিক না হওয়ায় আমি সেগুলো এড়িয়ে যাচ্ছি। আ’লা আল-দীন একদিন পল অ্যান্ডারসনকে বোঝাচ্ছেন, কীভাবে আলেপ্পোর তন্তু ও বস্ত্র ব্যাপারীরা নিত্যদিনকার কেনাবেচায় খরিদদার, আড়তদার ও নিজ নিজ প্রতিযোগীদের সঙ্গে নানান কিসিমের কথার মারপ্যাঁচ ও কলাকৌশল এস্তেমাল করে থাকেন। আরেকটু আগ বাড়িয়ে তিনি এ-ও বলে দিচ্ছেন, ব্যবসার ক্ষেত্রে কোন কৌশলটা মিথ্যা হয় আর কোনটা মিথ্যা হলেও মিথ্যা নয়; কোনটা হালাল আর কোনটা হারাম ইত্যাদি।
এবার দেখুন, আল-দীন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী সহব্যবসায়ীর হাতে নগদ টাকা আছে কি নেই, সেটা সংক্ষেপে কথার মাধ্যমে কী করে পরখ করেন। আরেকজনের অর্থসংক্রান্ত অতি ব্যক্তিগত তথ্য বের করে আনার জন্য তিনি তাঁর প্রতিপক্ষকে যেকোনো জিনিস চলতি বাজারদর থেকে বেশ কিছু সস্তা দামে বিক্রির প্রস্তাব দেন। যদি তিনি কিনতে রাজি না হন, তা হলে বুঝতে হবে তাঁর কাছে টাকা নেই। আল–দীন আসলে সস্তা দামে বেচবেন না, এই প্রতারণামূলক প্রস্তাবের মাধ্যমে তিনি জেনে নিচ্ছেন, প্রতিযোগী বন্ধুর হাতে এই মুহূর্তে নগদ পুঁজি আছে কি নেই।
আল–দীন অ্যান্ডারসনকে কৌশল বোঝানোর সঙ্গে সঙ্গে ফতোয়াও দিচ্ছেন। তাঁর ভাষায়, এই মিথ্যা মিথ্যা নয়, তাই এটা হারামও নয়, বরং হালাল; কারণ, এটা দিয়ে তিনি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর একটি অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছেনমাত্র। তিনি কারও কোনো ক্ষতি করছেন না, কাউকে ঠকাচ্ছেনও না।
এর বিপরীতে আল–দীন তাঁর ব্রিটিশ বন্ধুকে আরও নতুন জ্ঞান দিচ্ছেন; বলছেন, ‘দেখো, আরেক কিসিমের প্রতারণা আছে, যেটা হারাম। যেমন এখানে একজন ভুয়া খরিদদার এনে পাতানো কেনাবেচার একটি মহড়া সাজানো হয়। মনে করো, সুতার মণ ৫০০ ডলার, অথচ খোলাবাজারে কৃত্রিমভাবে দেখানো হয়, একজন ক্রেতা এসে বিক্রেতার কাছ থেকে সেই সুতা ৬০০ ডলার মণ দরে কিনে নিচ্ছে। এরপর যখন একজন সত্যিকারের ক্রেতা ৫০০ ডলারে সুতা কিনতে চাইবে, তখন সেই বিক্রেতা পাতানো খরিদদারকে দেখিয়ে বলবে, “ওকে জিজ্ঞাসা করেন, একটু আগে তাঁর কাছে আমি ৬০০ ডলারে বেচেছি।” এভাবে সুতার দাম ২০ শতাংশ বাড়িয়ে নেওয়া যায়; সহজে আনাড়ি ক্রেতাদের ঠকানো সম্ভব হয়।’ এখানে আল–দীনের মত, এই মিথ্যা শুধু মিথ্যাই নয়, বরং একটি খাঁটি প্রতারণা এবং এটা হারাম।
আরেক দিনের কথা, পল অ্যান্ডারসন বসে আছেন আলেপ্পোর পুরোনো বাজারের বিখ্যাত তন্তু আমদানিকারক ও কারবারি ইব্রাহিমের বাবার অফিসে। বসে বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন এবং ইব্রাহিমের সঙ্গে গল্প করছেন। এমন সময় একজন তরুণ ব্যবসায়ী এসে ঢুকলেন ইব্রাহিমের ঘরে। আগন্তুক ঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কথা বলছেন; ইব্রাহিম তাঁকে কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার কাছে সুতা আছে? আমি কিছু কিনতে চাই।’
আগন্তুক উত্তর দিলেন, ‘না।’
তারপর একটু বিরতির পর দুজন মুচকি হেসে কতক্ষণ চোখ–চাওয়াচাওয়ি করলেন; তারপর দুজনই সশব্দে হেসে উঠলেন।
আগত অতিথি চলে যাওয়ার পর, এডিনবরার পিএইডি শিক্ষার্থী জানতে চাইলেন ইব্রাহিমের কাছে, ‘এর মধ্যে কী এমন হলো যে দুজন মিলে রহস্যজনকভাবে হেসে উঠলে?’
ইব্রাহিম উত্তর দিলেন, এটা আর কিছু নয়, ব্যবসায়ীদের ভাষা, তুমি বুঝবে না। এটাকে আমরা বলি ‘কৌশলের মারপ্যাঁচ’ (টুইস্টেড ট্যাকটিক্স)।
ইব্রাহিম আরেকটু ভেঙেচুরে বোঝালেন, আমি তার কাছ থেকে তন্তু কিনতে চাইলাম, অর্থাৎ দেখতে চাইলাম, তার কাছে এবং বাজারে কী পরিমাণ তন্তু মজুত আছে। নিজের গুদামে থাকা সত্ত্বে আমাকে “না” বলে দিল। সে আমার কৌশল ধরে ফেলল, আমার কৌশলী প্রশ্নের উত্তর সে–ও কৌশলে দিয়ে গেল। কৌশলে কেউ কাউকে হারাতে পারলাম না বলেই দুজন মিলে হাসলাম। এ মিথ্যা মিথ্যা নয়, এটা প্রতারণাও নয়। এটা হালাল। একে বলতে পারো একটি নিরেট কৌতুক!
এই পর্যায়ে এসে বন্ধু পল অ্যান্ডারসনকে একটি বড় আকারের ধন্যবাদ দিতেই হয়। যত মামুলিই হোক না কেন, তিনি মানবস্বভাবের এমন কিছু বৈশিষ্ট্যকে অতি সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন, গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন, চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন এবং তাঁর রাশভারী গবেষণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে দিয়েছেন, যা কিনা সর্বজনীন!
শুধু আলেপ্পোর তন্তু কারবারি ও বস্ত্র ব্যবসায়ীই নন, দুনিয়ার তামাম বণিকদের এই একই খাসলত। ‘কথার মারপ্যাঁচ’ কিংবা ‘কৌশলের মারপ্যাঁচ’ যা–ই বলুন না কেন, ব্যবসায়ীরা যখন এগুলো বেশি বেশি এস্তেমাল করতে থাকেন, তখন তার একটি ঝুঁকি সব সময় থেকেই যায়। অর্থাৎ ‘হালাল’ খাসলত কখন গণ্ডি পেরিয়ে ‘হারামের’ কোঠায় চলে যায়, তা অনেক সময় তাঁরা বুঝতে পারেন না। এ ছাড়া পুঁজিবাদের পিতা অ্যাডাম স্মিথের না ‘মোরাল সেন্টিমেন্টস’ না ‘ওয়েলথ অব নেশনস’ কোনো কেতাবই ‘টুইস্টেড ট্যাকটিক্স’-এর বৈধতা দেয় না।
সব শেষে আরেকটি উদাহরণ দিয়েই এ রচনার ইতি টানব। এটা সিরিয়াও নয়, আলেপ্পোও নয়, ঢাকার ব্যবসাসংস্কৃতি থেকে কুড়িয়ে পাওয়া। যতই বুদ্ধিদীপ্ত ও সাফসুতরো কৌশল হোক না কেন, এটাও একধরনের প্রতারণা! ১৯৭০ দশকের শেষার্ধের কথা। ঢাকার ‘বায়তুল মোকাররম’ মার্কেটে আমার মামার একটি জুতার দোকান ছিল। ঈদুল ফিতরের ঠিক আগের রাতের ঘটনা। মামার দোকানে তাঁর এক বন্ধু এসেছেন ঈদের বাজার করতে; জুতা কিনতে। তিনি কয়েক জোড়া জুতা দেখে, পরে কয়েক কদম হেঁটে ঠিক করলেন, এক জোড়া কিনবেন। টাকা দেওয়ার সময় পকেটে হাত দিয়ে বন্ধু-খরিদ্দার মামাকে বলছেন, দোস্ত, আমি তো বাসায় ওয়ালেট ফেলে এসেছি, ঈদের পর তোর দোকান খুললেই টাকাটা দিয়ে যাব।
সেলস বয় তার স্যারের বন্ধুকে চেনে এবং সে লক্ষ করছে, তিনি ঈদের বাজারে বাকিতে জুতা কিনছেন। সে বাক্সে জুতাজোড়া ভরে দড়ি দিয়ে বেঁধে সম্মানিত ক্রেতার হাতে সযত্নে তুলে দিল। বন্ধু চলে যাওয়ার পর মামা আফসোস করে কর্মচারী ছেলেটিকে বললেন, ‘তুই যে জুতাজোড়া দিয়ে দিলি, ও তো তিন মাসেও এদিকে আর আসবে না।’
‘আশা করি, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তিনি টাকা নিয়ে ফিরে আসবেন, স্যার,’ জবাব দিল ছেলেটি।
মামা বললেন, তুই কীভাবে বুঝলি?
এবার চৌকস সেলস বয়ের উত্তর শুনে দোকানমালিক স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।
-স্যার, আমি প্যাক করার সময় দুটো জুতাই বাঁ পায়ের দিয়ে দিছি!
লেখক: অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি ও এডিটর, জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াস