মায়ের শঙ্কা এবং বিয়ে
বেড়ানোর শখ ছিল প্রচুর। পড়াশোনা করতে উত্তরের শহর সুনামগঞ্জ থেকে চলে যাই দেশের দক্ষিণ সীমানায় বন্দর নগরী চট্টগ্রামে। ছাত্রাবাসে জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে যারা পড়তে আসত, তাদের অনেককে আপন করে চলে যেতাম বন্ধুদের গ্রামের বাড়ি। কলেজের সাপ্তাহিক ছুটিতে। পড়াশোনা শেষ করার আগেই মাথায় ছিল ব্যবসা করব চট্টগ্রামে।
এ ছাড়া পারিবারিক ব্যবসা ছিল চট্টগ্রামভিত্তিক। ব্যবসার কারণে প্রতি সপ্তাহে কেউ না কেউ আসতেন চট্টগ্রামে। জিয়াউর রহমানের শাসনের প্রথম দিকে দেশে এল যাত্রীবাহী বিলাসবহুল জাহাজ হিজবুল বাহার। সরকার থেকে বলা হলো, দ্বিতীয় মুসলিম প্রধান দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনগণ যেন বেশি করে হজব্রতপালনে সৌদি আরব যেতে পারেন। তাদের জন্য সুলভে হজ পালনের প্রয়োজনে কেনা যাত্রীবাহী জাহাজকে হজের মৌসুমের পর প্রথমে পাঠানো হলো প্রমোদ ভ্রমণে সিঙ্গাপুর আর পেনাং বন্দরে।
সেই সময়ের চট্টগ্রাম অঞ্চলের অন্যতম ধনী প্রয়াত হাজি ইসমাইল অ্যান্ড কোম্পানি পেল কাটারিং কন্ট্রাক্ট। যাত্রীদের জন্য ভাসমান ক্যানটিনে খাবার পরিবেশনের দায়িত্ব। হাজি সাহেবের বড় ছেলে আমার প্রিয় বন্ধু। বুদ্ধি বের করে তিন বন্ধুর নাম লেখালাম স্টাফের তালিকায়। শর্ত ছিল, কাটারিং কোম্পানির স্টাফদের পোশাক পরতে হবে। সবকিছুতে রাজি। যেতেই হবে জাহাজের বিলাস ভ্রমণে। ভ্রমণে গিয়ে অনেক যাত্রী দেশে আনলেন ভিসিআর। ক্যাসেট ঢুকিয়ে দেশি–বিদেশি ছবি দেখা যেতো ২৪ ইঞ্চি মাপের টিভিতে। এমন আরও অনেক ভ্রমণের গল্প আছে কয়েক ডজন।
এসবের মধ্যে বিশেষ গল্প মাত্র ১ হাজার ২০০ টাকায় রিটার্ন টিকিটে থাই এয়ারওয়েজে চড়ে থাইল্যান্ড ভ্রমণ। বর্তমানের ছবির মত সুন্দর সাজানো শহর ব্যাংকক ছিল কালো গাড়ি থেকে বের হওয়া ধোঁয়ার শহর। ৫০ সিসি মোটরসাইকেল দিয়ে কম বয়সী ছেলেরা যাত্রী বহন করতে। নাম ছিল টুক টুক। অনেক খোঁজাখুঁজি করে বের করা হয়, বর্মিজ মুসলিম মালিক চালিত হালাল মাছ–মাংস দিয়ে ভাতের দোকান। আরও কত গল্প ছিল নানা জায়গায় বেড়ানোর। নিজের রোজগারের টাকায় না কুলালে মায়ের কাছে আবদার করে জোগাড় করা টাকা দিয়ে মেটানো হতো ভ্রমণের বাড়তি খরচ। মা টাকা দিতেন ঠিকই। জিজ্ঞেস করতেন অনেক কিছু। ভয় করতেন, বিদেশি কাউকে না আবার বিয়ে করে নিয়ে এসে ওনার সামনে দাঁড় করিয়ে বলি, মা দেখত তোমার বউ মাকে পছন্দ হয়েছে কিনা! এত সবের পরও সেই ভয় কিনা একদিন চেপে বসল মায়ের ভেতরে। আব্বা মাসে একবার যেতেন চট্টগ্রাম। থাকতেন শহরের ব্যস্ত চৌরাস্তা তিন পুলের মাথায় সফিনা হোটেলে।
প্রিয় বন্ধুকে আব্বার কথা বলতেই, সে নিজে হোটেলে গিয়ে দাওয়াত দিয়ে এল আব্বাকে। চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী পরিবার হলো প্রিয় বন্ধুর পরিবার। কর্তারা তিন ভাই মিলে বিরাট একান্নবর্তী পরিবার। বন্ধুর বাবা আয়োজন করলেন বিরাট খানাপিনার। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের প্রথা মেনে পরিবারের সব ছোট–বড় মেয়েরা এসে আব্বাকে খুবই তমিজ ও শ্রদ্ধার সঙ্গে পায়ে ধরে সালাম করে গেলেন। আব্বাও খুব মজা পেলেন দাওয়াতে গিয়ে। অনেকক্ষণ গল্প হল।
পরের শীতে শাহজালালের মাজারে আসার দাওয়াত করে এলেন আব্বা। বন্ধুদের পারিবারিক মাজদা গাড়ি দিয়ে আব্বাকে হাজি সাব পৌঁছে দিলেন হোটেল সফিনায়। আমি তখন থাকি টেরি বাজার হোটেল আরজুতে। দুদিন পর বাসা থেকে মায়ের ফোন। জরুরি কারণে রাতের ট্রেন ধরে যেতে হবে সুনামগঞ্জ। কাতারপ্রবাসী বড় ভাই (সদ্যপ্রয়াত) এসেছেন দেশে দেড় মাসের ছুটিতে। বাসায় পৌঁছে দেখি মায়ের মুখে হাসি নেই। শুধু আমার পেছনে ঘুর ঘুর করেন। পেয়ে গেলেন আমাকে একা সকালের নাশতার টেবিলে। আমার দুহাত চেপে বলতে শুরু করলেন, শুনো, আমি তোমার জন্য পাত্রী ঠিক করে ফেলেছি। ভালো বংশের মেয়ে। পড়াশোনা আছে। পরিবার খানদানি। পারলে আজ–কাল তুমি সিলেট যাও। আমার এক মামা অর্থাৎ তোমার নানার একটি মাইক্রোবাস নাকি আমাদের শহরের কেউ একজন ভাড়া করে টাকা–পয়সা দেয়নি। তাই তোমাকে যেতে বলেছেন। আমার মামাকে নিয়ে মেয়েও দেখে আসবে।
কী বলব, তখনো বুঝতে পারছি না। হঠাৎ খপ করে আমার হাত চেপে ধরে মা বলতে লাগলেন, বাবারে আমি চাই না, তুমি সিলেটের বাইরে কোথাও বিয়ে করো। তোমার আব্বা বলেছেন, চিটাগংয়ের কোনো বড় ব্যবসায়ী নাকি তোমার বাবাকে খুবই আদর যত্ন করেছেন। ওনার বাসায় অনেক সুন্দর সুন্দর মেয়েদের তোমার বাবা দেখে এসেছেন। আমি হাসব না কাঁদব। ওরা সবাই কেউ আমার বন্ধুর আপন কিংবা চাচাতো বোন। যারা আমাকে বড় ভাইয়ের মতো দেখে। বুঝতে পারলাম, বাসায় আসার জরুরি তলবের আসল কারণ। মায়ের হাত ধরে বললাম, ‘আম্মা তুমি কি মেয়ে দেখে এসেছ?’ উত্তরে বললেন, ‘দেখে এসেছি। মামুর শালী। বাবা, ফুরি (মেয়ে) দেখতে মাশআল্লাহ সুন্দর আর নরম–শরম (শান্ত)। না করিও না বাবা। আম্মা দোয়া করব তোমাদের জন্য।’
পরের ইতিহাস একেবারে জলের ন্যায় সাদা টলটলে। মায়ের মামার শালী, সম্পর্কে যাকে নানি বলে ডাকার কথা তাকেই ৩৪ বছর ধরে ডাকছি, কই গো কই গেলে? পারলে এদিকে একবার এসো!