মায়ের মুখের মধুর হাসি

মাকে কখনো মুখ ফুটে বলতে পারিনি, মা আমি তোমাকে কত ভালোবাসি। এটা অনেক বাঙালি ছেলেমেয়েদের পক্ষে অনেক সময় বলা হয়ে ওঠে না। সবার মতো আমারও তেমন। আসলে মায়ের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা ছোটবেলা থেকেই কম ছিল।
আমরা চার ভাইবোনের মাঝে আমি সবার বড়। আর আমি ছিলাম আমার বাবার আহ্লাদী। মা একটু বকাঝকা করলে অপেক্ষায় থাকতাম কখন বাবা আসবে আর বাবাকে দিয়ে মাকে বকা খাওয়াব। বাবা যতক্ষণ না মাকে বকবেন ততক্ষণ আমার শান্তি নাই। কত দিন যে মায়ের ওপর রাগ করে ভাত খাইনি, কিন্তু সেই মা আবার জোর করে ভাত খাওয়াতেন। সব সময় রাগ করলে বলতেন, খেয়ে দেয়ে রাগ করে বসে থাক।
ছোটবেলা থেকেই দেখতাম মায়ের কঠোর পরিশ্রম, কি যে অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন আমাদের জন্য। খুব ভোরে উঠে রান্না করে বাবা অফিসে গেলে আমাকে নিয়ে স্কুলে যাওয়া। তারপর আবার আমাকে নিয়ে এসে ভাইকে অন্য স্কুলে দিয়ে আসা। আমার ছিল মর্নিং শিফট, ভাইয়ের ডে শিফট স্কুল। তারপর আবার দুপরে এসে রান্না, এর মাঝে আছে আমাদের খাওয়া নিয়ে বায়না। একেকজনের জন্য একেক রকমের পছন্দের রান্না করা। তারপর নিজের খাওয়া হলো কি হলো না আবার বিকেলে শিশু একাডেমিতে আমাদের নিয়ে যাওয়া। এর মাঝে আত্মীয়স্বজন তো ছিলই। আমার মা সাহায্যকারী কাউকেই রাখতেন না, সব কাজ নিজের হাতে সামলাতেন। রাতে এসে পড়াতে বসানো। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত আমাদের কোনো গৃহ শিক্ষক ছিল না। মা পড়াতেন আমাদের। তখন আসলে মায়ের কষ্টটা এত উপলব্ধি করতে পারিনি। এমনকি যখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখনো মনে হতো না। মনে হতো মা তো এমনই।
আমার অন্যান্য ভাইবোন থেকে আমার আবার মেজাজ খুব গরম। আমি মেজাজ গরম করলে মায়ের একটাই কথা, দুর্গা রণমূর্তি ধরছে। সেটা শুনলে আরও রাগ করতাম। আজ মায়ের মর্ম বুঝতে পারছি। এখন রাগ করে একবেলা না খেলেও কেউ আসে না মায়ের মতো রাগ ভাঙাতে। বলে না, খেয়েদেয়ে রাগ করে বসে থাক।
বিয়ের পর বুঝতে পারি মা যে আমার কি ছিল। মা এটা কীভাবে করব, ওইটা কীভাবে করব। আর দেশের বাইরে আসার পর আমার নতুন সংসারের প্রতিটা পদক্ষেপে মাকে ফোন করে পরামর্শ নেওয়া। আজ আমার মা অসুস্থ হলেও, কিন্তু তাকে চোখের দেখা দেখতে পারছি না একটু গিয়ে, কত দিন দেখি না মাকে।
আজ নিজে মা হয়েছি। এখন বুঝি মা হওয়ার মজা। আমার এক বছরের মেয়েটি যখন মা মা বলে আধো আধো বোলে ডাকে, কি যে শান্তির পরশ বয়ে যায় মনের ওপর দিয়ে। একমাত্র যারা মা হয়েছেন তারাই বুঝবেন। আবার যখন খেতে চায় না, দুষ্টুমি বায়না করে তখন নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে। কত যে জ্বালিয়েছি মাকে। এখন এসব মনে পড়লে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারি না। অজান্তে মনে হয়ে যায় মায়ের সঙ্গে করা খারাপ আচরণগুলো। কয়েক দিন আগে পালিত হলো মা দিবস। আমার মাকে জানাতে চাই, মাগো মা তোমার এই মেয়েকে তুমি ক্ষমা করে দাও। তোমার প্রতি কত ভালোবাসা জমা হয়ে আছে এই অন্তরে তা যদি বোঝাতে পারতাম। তোমার মেয়েকে তুমি সাহস দাও এই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার।
ভালো থেকো মা সব সময়। তোমার মুখের হাসি যেন সব সময় অটুট থাকে। হাজার ফুলের সাথি হয়ে, ছায়া হয়ে তুমি তোমার মেয়ের পাশে পাশে থাকবে সারাক্ষণ।
যদিও এটি মা দিবসের লেখা, কিন্তু আমার কাছে বছরের প্রতিটি দিনই মা দিবস। পৃথিবীর সব মায়েদের জানাই অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।