মায়ের চিঠি, মেয়ের চিঠি

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

অনেক প্রত্যাশার পর অবশেষে এলো সেই দিন। জাপান থেকে চিঠি পেলাম, আমাকে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি করেছে। খুব শীঘ্রই যোগদান করতে হবে। এই চিঠি পাওয়ার পরে আমার মনের অবস্থা আগের চেয়ে একদমই উল্টো হয়ে গেল। চিঠি খানি পাওয়ার আগ পর্যন্ত ব্যাপারটা এমন ছিল যে, কেন আমার বাইরে যাওয়া হচ্ছে না, কবে যাব, কবে পিএইচডি করব, গবেষণা করব আরও অনেক কিছু। কিন্তু জিনিসটা যখন পেয়ে গেলাম তখন মন জুড়ে আরেকটা ব্যাপার জেঁকে বসল। হায় হায় আমাকে এখন যেতে হবে। বাবা-মা, স্ত্রী, সন্তান, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন, দীর্ঘদিনের বন্ধুবান্ধব সবাইকে ছেড়ে যেতে হবে। সবচেয়ে যেটা কষ্টকর ছিল আমার মাকে ছেড়ে যাওয়া।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা, তারপর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রে কিছুটা লম্বা সময়ের চাকরির সুবাদে ঢাকাতেই থেকেছি বেশ কয়েক বছর। এই দীর্ঘ সময়ে এক দুমাস পরপরই গ্রামে গিয়েছি, বাবা-মার সঙ্গে দেখা হয়েছে। তখনো মোবাইল ফোনের অতটা প্রচলন শুরু হয়নি। যখন শুরু হয়েছে আমি তখনো মোবাইল ফোন নিইনি। তাই প্রায়ই চিঠি লেখা হতো। আমার বাবা-মাও আমাকে লিখতেন, আমিও তাঁদের লিখতাম। আমার চিঠির বিষয়বস্তুতে থাকত, আমি কী করছি, কেমন আছি, আমার স্ত্রী-সন্তানরা কেমন আছে, অমুক অসুস্থ, ওর দুদিন হলো গা ব্যথা, আমার ঠান্ডা লেগেছে এসব। এসব ছিল বিয়ে করে সংসার পাতার পর। আর যখন ছাত্র ছিলাম তখন তো প্রতি চিঠিতে একটা কথা থাকতই, অত তারিখের মধ্যে এত টাকা লাগবে। সেই সব চিঠির উত্তরে আমার বাবা যা যা লিখতেন তা হলো আমরা ভালো আছি, তুমি শরীরের যত্ন নিও সেই সঙ্গে বাড়ির একটা সংক্ষিপ্ত কিন্তু পূর্ণাঙ্গ আপডেট থাকত। যেমন সব ভাইবোনেরা কে কী করছে, কে কেমন আছে, কে বাড়িতে আসল, কে গেল, কোন্‌ জমির কী অবস্থা, পুকুরে মাছের কী হলো, বাচ্চাদের কী অবস্থা, গ্রামের কোনো খবর আছে কি না এসব।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি


কিন্তু মা? তাঁর চিঠিগুলো একদম অন্যরকম ছিল। গোটা গোটা হাতে অনেক সুন্দর সংক্ষিপ্ত চিঠি। যার বিষয়বস্তু কমবেশি এই রকম ছিল। তুমি মনে হয় ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করছ না, গত মাসে দেখলাম অনেক শুকিয়ে গেছো, ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করবে, সব সময় মহান আল্লাহর ওপরে ভরসা রাখবে, ছুটি হলেই চলে এসো, মনে হয় অনেক দিন তোমাকে দেখি না, এসব।
জাপানে যাওয়ার পরেও বাবা মাকে চিঠি লিখতাম, তাঁরাও আমাকে লিখতেন। তবে ঠিক জাপানে যাওয়ার পরপরই মার কাছ থেকে একটি বিশেষ চিঠি পাই। সেই চিঠিটা অনেক লম্বা এবং অনেক আবেগপূর্ণ ছিল। তখনো আমার স্ত্রী সন্তানেরা জাপানে আসেনি। ওদের ভিসাপ্রক্রিয়া চলছিল। মার সেই চিঠির শেষের কয়েকটি লাইন আমাকে সারাক্ষণই নাড়া দেয়। তিনি লিখেছেন, তোমরা আট ভাইবোন, অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অনেক সীমাবদ্ধতার কারণে তোমাদের সকল ইচ্ছে বা চাওয়াকে পূরণ করতে পারি নাই, কিন্তু তোমরা তোমাদের সন্তানদের জীবনের সব প্রত্যাশাকে পূর্ণ করে আমাদের সেই সব অপারগতাকে ভুলে যেও। দোয়া এবং বিশ্বাস করি আল্লাহ তোমাদের সেই সমর্থ দেবেন।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

হায় এই না হলে মা। আসলে আমরা আট ভাইবোন হলেও আমাদের জীবনের কোনো ইচ্ছে, স্বাদ-আহ্লাদকেই আমার বাবা-মা অপূর্ণ রাখেননি। মার ওই চিঠির এই কথাগুলোর মর্মার্থ আমি বুঝি, এখন হয়তো আরেকটু বেশিই বুঝি। কোনো বাবা-মাই তাদের সন্তানের জন্য কিছু করে তৃপ্ত হন না। আরও অনেক বেশি কিছু করার অতৃপ্তি থেকেই যায়। ঠিক যেদিন মার কাছ থেকে ওই চিঠিটা পাই, একই দিন আমার মেয়ের কাছ থেকেও একটা চিঠি পাই। গোটা গোটা অক্ষরে আমার পাঁচ বছর বয়সী মেয়ের আমাকে লেখা প্রথম চিঠি। মেয়ের চিঠিটা ছিল এই রকম। বাবা, তুমি কখন আসবা? আমার খেলনা কি কিনছ নাকি? আনাস অনেক কান্নাকাটি করে। নানু ভাই প্রতিদিন স্কুল থেকে আমাকে আনার পথে আইসক্রিম কিনে দেয়। তুমি কিন্তু তাড়াতাড়ি আসবা। ইতি, তোমার মাসাবা।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি


আমার মাকে এখন আমি যখন ফোন করি, কথা হয়। ঠিক আগের মতোই। আগের ওই কথাগুলোই তিনি বারবার বলেন। এত যে অসুস্থ, নিজে ব্যথায় কুকড়িয়ে আছেন সেসব নিয়ে কোনো কথা নাই। শুধু আমি কেমন আছি, আমার স্ত্রী-সন্তানেরা কেমন আছে এসব। মার হাতের লেখা চিঠিগুলো খুব মিস করি। দোষ আমারই। আমিও তো চিঠি লিখিনি অনেক দিন। কেন লিখিনি? ফোনে কথা হয় তাই। ভাইবোনদের সঙ্গে প্রায় দিনই ফেইস বুকে আপডেট দেওয়া নেওয়া হয় তাই। আমি হয়তো এই আধুনিকতায় মেনে নিয়েছি নিজেকে। আমার চারপাশকে। কিন্তু আমার মা? আমার মা কী তৃপ্ত? আমার মা কী এই ফোনকল আর ফেইস বুকে খবর আদান প্রদানের চেয়ে আমার চিঠি পেলেই বেশি খুশি হবেন না? আসলে চিঠিতে শুধু যে এক টুকরো কাগজ থাকে তাই না, থাকে মায়া মমতা জড়ানো স্নেহের পরশ, হাতের স্পর্শ, নরম ছোঁয়া, আদর অনেক কিছু। চিঠির প্রতিটি অক্ষরে মিশে থাকে প্রেরকের হাতের তথা হৃদয়ের কোমল স্পর্শ। যদি তাই না হবে তাহলে কেন আমি আজ থেকে ১২ বছর আগের আমার মায়ের হাতের লেখা সেই চিঠি খানি আমার বুকের কাছে রেখে দিয়েছি? এই বারো বছরে আমি কী একটা ইমেইল অথবা ফেইস বুক মেসেজকে ওভাবে যত্ন করে রেখেছি? বারবার পড়েছি? কষ্ট হচ্ছে এই ভেবে যে আমি আমার বাবা মাকে সেই আনন্দ থেকে বঞ্চিত করেছি। সেই যুগের (আমাদের ধারণায়) এই দুজন মানুষকে আধুনিকতার নাম করে, ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে, শুধুমাত্র দায়িত্ব পালন করে যাওয়ার মতো করে ফোন আর মেসেজ দিয়ে আমি তাদেরকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছি। এই অধিকার আমার নেই। হয়তো আমার সন্তানদের কাছ থেকে আমি হাতে লেখা চিঠি আশা করব না, তারা লিখবেও না, আমার কাছ থেকেও আশা করবে না। তাদের সঙ্গে আমার প্রতিনিয়তই ফোন, মেসেজ আদান প্রদান হচ্ছে। কিন্তু আমার বাবা মাকে আমার হাতে চিঠি লেখা উচিত। আসুন, আসছে মা দিবসে আমরা সবাই আমাদের মাকে নিজের হাতে চিঠি লিখে আমাদের অন্তরাত্মার এমন একটি বহমান ঐতিহ্যকে আবার একটু ঝালাই করে নেই।