মাস্ক ও টিকা নেওয়ার বিকল্প নেই

আমরা এক অদ্ভুত পৃথিবীতে আছি। বিশ্বাস ও বিজ্ঞানের টানাপোড়েন মানব ইতিহাসেরই অংশ। কিন্তু বর্তমানে তা চরম পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। ক্ষমতার রাজনীতি ধর্মকে কলুষিত করেছে যুগে যুগে। একই প্রভাবের রাহুগ্রাস এবার বিজ্ঞানের দিকে অগ্রসরমাণ। ভয় হচ্ছে, সচেতন প্রতিরোধ গড়ে না তুললে এক সময় বিজ্ঞানও রাজনীতির পুতুল নাচের অংশ হয়ে উঠবে।

জ্ঞান বিজ্ঞানের সিঁড়ি বেয়ে বিত্ত আর বৈভবের অর্জন মানব সমাজকে আধুনিক ও সভ্য করেছে। তাল মিলিয়ে একই সঙ্গে আমাদের সামাজিক মনস্তত্ত্বেরও পরিবর্তন হয়েছে প্রচুর। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো হিসেবে দেখি না আমরা আর। আমাদের চোখে এখন রঙিন চশমা আঁটা, যে রং দেখতে চাই সেই চশমাটা ব্যবহার করি। সঙ্গে যোগ হয়েছে বিশ্বায়নের কর্কট রোগ। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় নিয়ে আমাদের সমাজবিদদের ভাবতে হবে এখনই। নইলে রক্ষা নেই। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় মানবজাতির সমষ্টিগত আচরণ ইতিহাসের একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়, এতে আমার সন্দেহ নেই। শুধু একটাই সন্দেহ, বস্তুনিষ্ঠ সেই ইতিহাস লেখার মতো সততা অবশিষ্ট থাকবে কিনা। যাকে আমরা বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ, সবচেয়ে উন্নত দেশ, সবচেয়ে সভ্য দেশ বলে চিহ্নিত করি, সেই দেশের উপাত্ত নিয়েই কথা হোক। আমি নিজে স্বাস্থ্যকর্মী, তাই আমার ঘরের কথাই বলি।

ওয়াশিংটন পোস্টের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উল্লেখিত সেন্টার ফর মেডিকেয়ার অ্যান্ড মেডিকেইড সার্ভিসেসের ডেটা অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের হাসপাতালগুলোর নার্সদের মধ্যে ৩৮ শতাংশের বেশি করোনার টিকা নেননি (১১ জুলাই পর্যন্ত সংগৃহীত উপাত্ত)। আমার হাসপাতালে এই সংখ্যা আরও বেশি। তাঁরা ইচ্ছাকৃতভাবেই টিকা নেননি। আমার আইসিইউর নার্স কিংবা রেসপেরটরি থেরাপিস্ট-যারা সরাসরি করোনা রোগীর সেবা দিচ্ছেন নিবিড় সান্নিধ্যে, যাদের চোখের সামনে প্রতিদিন রোগীর মৃত্যু হচ্ছে, তাঁরা কেন নিজেদের প্রতিরক্ষায় যত্নবান হবেন না? একটাই কারণ, কোনো না কোনো ভাবে তাঁরা টিকা বিরুদ্ধ শিবিরের যুক্তিকে গ্রহণযোগ্য মনে করেছেন। আমার কাছে এই মনস্তত্ত্বটিই বর্তমান সভ্যতার সবচেয়ে বড় সংকট বলে মনে হয়। একে হালকা করে দেখার কোনো কারণ নেই।

আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (এএমএ), আমেরিকান নার্সিং অ্যাসোসিয়েশনসহ (এএনএ) আরও ৫৪টি চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সংগঠন হাসপাতাল ও নার্সিং হোমের স্বাস্থ্যকর্মীদের টিকা নেওয়া বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করেছে। কিন্তু রাষ্ট্রের তরফ থেকে সাড়া নেই এখনো। কেন? বিজ্ঞানের চেয়ে রাজনৈতিক বিবেচনাই প্রধান, এ কারণে। কোনো কোনো হাসপাতাল নিজস্ব উদ্যোগে আলাদাভাবে করতে চাইলেও এর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দেওয়া হয়েছে। ফ্লোরিডার এক স্কুলে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হলে গভর্নর নিজ ক্ষমতাবলে তা বাতিল করেন। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, এটা ব্যক্তি স্বাধীনতার বিষয়। আমি মৃত্যু দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। আমাদের আইসিইউতে বিশ্বমানের চিকিৎসা দেওয়া হয়, যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ আইসিইউতে একমোর (ইসিএমও) ব্যবস্থা নেই, আমাদের তাও আছে। কিন্তু সংকটাপন্ন কোভিড রোগীদের মৃত্যুর মিছিল থামছে না। ডেলটা ধরনের প্রকোপ শুরু হওয়ার পর থেকে দেখছি, অপেক্ষাকৃত কম বয়সী রোগী আসছে ভেন্টিলেটরে, অনেক সময় দূরের হাসপাতাল থেকে হেলিকপ্টারে করে আসছে। গত মাসে যাদের হারিয়েছি তাঁদের সর্বোচ্চ বয়স ৪৮ আর সর্বকনিষ্ঠ ২১। এঁদের কারওরই টিকা নেওয়া ছিল না।

এসব বলার উদ্দেশ্য হলো, অত্যাধুনিক চিকিৎসা দিয়েও করোক্রান্ত মারাত্মক রোগীকে বাঁচানোর নিশ্চয়তা নেই। অতএব প্রতিরোধই এর একমাত্র কার্যকরী প্রতিষেধক। মাস্ক ব্যবহার করা আর টিকা নেওয়া—এর বিকল্প নেই, আমার মতে এবং আমার মতো শত সহস্র স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের মতে। কিন্তু তাতে কী আসে যায়? ব্যক্তি স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত আর স্মার্টফোনে আচ্ছন্ন অত্যাধুনিক এই সমাজের সামাজিক মনস্তত্ত্বকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে আমাদের মতো চুনোপুঁটিরা তো নস্যি।

লেখক: ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, টেনেসির নর্থ নক্সভিল হাসপাতাল এবং টার্কি ক্রিক হাসপাতালের আইসিউ ডিরেক্টর