মারটাইল বিচে
সাউথ ক্যারোলাইনার উত্তরে মারটাইল বিচ। হরে কাউন্টির প্রান্তে। প্রায় ৬০ মাইল দীর্ঘ এ বিচ পর্যটকদের কাছে খুব আকর্ষণীয়। ঝিরিঝিরি বালুকাবেলায় বেলাভূমি। ছোট ছোট ঝিনুক-শামুকের মেলা।
গত বছরের গ্রীষ্মকাল ছিল করোনার ক্রান্তিকাল। মৃত্যুর সংখ্যা গুনতে গুনতে ভয়ে আতঙ্কে সে বছর আর সমুদ্রে কেন, কোথাও যাওয়ার সাহস হয়নি। এবারও ভয়ে ভয়ে যখন ঘোষণা করা হলো, ৪ জুলাই থেকে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের জন্য সব উন্মুক্ত। তখনই আমরা মারটাইল বিচে যাওয়ার পরিকল্পনা করি। নিউইয়র্ক থেকে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার দূরে। রোড ট্রিপে রওনা হই। নিউইয়র্কের যানজট এড়াতে গভীর রাতে যাত্রা শুরু করি। বৃষ্টির পূর্বাভাস থাকলেও শুরুতে রাস্তায় বৃষ্টি পাইনি। শুক্লা তিথির চাঁদ মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছিল। রেস্ট এরিয়ায় দুই-তিন ঘণ্টা পরপর কফি বিরতি নিয়ে আমরা যাচ্ছি।
নর্থ ক্যারোলাইনা পৌঁছা মাত্রই ভোরের আলো ফুটে উঠল। ইতিমধ্যে আমরা নিউজার্সি, পেনসিলভানিয়া, ডেলাওয়ার, ভার্জিনিয়া, মেরিল্যান্ড ও ওয়াশিংটন ডিসি অঙ্গরাজ্য পাড়ি দিয়েছি। নর্থ ক্যারোলাইনার ইস্টওভার থেকে কনওয়ের দিকে রওনা দেওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ঝুম বৃষ্টি নামল। এক গাড়ি থেকে আরেক গাড়ি দেখা যায় না, এমন তুমুল বৃষ্টি। রাস্তাও প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। রাস্তা পানিতে ভেসে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে গাড়িও ভেসে যাবে পানির তোড়ে। আবার হঠাৎ বৃষ্টি থেমেও গেল। খানিকটা পথ যাওয়ার পর আবার বিদ্যুৎ চমকাল। বাজ পড়ছে। আবার বড় বড় ফোটায় বৃষ্টি।
‘গুড়ু গুড়ু ডাকে দেয়া
ফুটিছে কদম কেয়া’
রবি বাবুর কবিতায় বর্ষা দেখি যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে-প্রকৃতিতে। মিষ্টি সুবাসের সাদা গোলাপি থোকা থোকা ফুল ফুটে আছে রেস্ট এরিয়ার গাছে গাছে। পাখির কাকলি ঘোষণা দিচ্ছে সকাল হয়ে গেছে। চিজডেনিস, স্টারবাকসের কফির ঘ্রাণ আর ফুলের ঘ্রাণ আমাদের দীর্ঘ পথের ক্লান্তি দূর করে। ছাতা সব গাড়ির পেছনে রাখা। তাই কাকভেজা হয়ে নেমে হোটেলের রুমে পৌঁছালাম।
এখানকার জলবায়ু এবং ভৌগোলিক কাঠামো নিউইয়র্ক থেকে আলাদা। অনেকটা বাংলাদেশের মতো। এখানে জায়গায় জায়গায় ঝাউ আর পাম গাছের সারি। তবে পাম গাছগুলো খর্বাকৃতি।
আর্নেস্ট হেমিংওয়ের লেখা আমার ছাত্রজীবন থেকে আমার শক্তি। তাই তাঁর তিনটি বাড়ি আমার ভ্রমণের তালিকায় আছে। যদিও এখনো যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
হেমিংওয়ের ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ নামকরা বই। বইটি এত ভালো লেগেছিল যে, এখনো মাঝে মধ্যে এটি পড়ি। তার বাড়ি একবার ঘুরে আসার স্বপ্ন বুকে নিয়ে এই লেখা। যেন তাঁর আত্মার অনুসন্ধান। কারণ একটিই, যে পরিবেশে তিনি বাস করতেন সেটি যেন এই পৃথিবী ছাড়িয়ে ভিন্ন কোনো লোকে। বড় লেখকদের এমন জায়গাতেই থাকতে হয়। অপরূপ সে দৃশ্য। দুই দিকে নীল জলের সমুদ্র, মাঝখানে এক চিলতে পথ। পথের দুই ধারে লাগানো গাছের সারি। কী গাছ, নাম জানি না। নানা রকম পাখি-হাঁস ওরাও যেন বেড়াতে এসেছে। চারদিকে সমুদ্রের দুরন্ত হাওয়া আর নীল দিগন্ত।
মানুষের টিকে থাকার নিত্য-আগ্রহের কথা, সংগ্রামের কথা মহৎ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন লেখক। বৃদ্ধ জেলে সান্তিয়াগো কিংবা সেই বিশাল মারলিন মাছের প্রতি লেখকের শ্রদ্ধার কমতি নেই। মমতার কমতি নেই। জেলে, হাঙর, সাগর সবার প্রতি লেখকের দরদ সমান। ‘মানুষ ধ্বংস হতে পারে কিন্তু পরাজিত হতে পারে না’—এই বোধের ব্যাপ্তিই আমরা লক্ষ্য করি এ উপন্যাসে। কথাসাহিত্যিকেরা কথার জাদুকর। কত শক্তিশালী কথা তাঁরা সৃষ্টি করেন। ১৯৫৩ সালে এই উপন্যাসের জন্য হেমিংওয়ে পুলিৎজার পুরস্কার লাভ করেন। আর ১৯৫৪ সালে পেলেন নোবেল পুরস্কার।
হেমিংওয়ের শৈশবের গ্রীষ্মকালীন বাড়িটি আর্নেস্ট হেমিংওয়ের কুটির নামে পরিচিত। ওই বাড়িটি মিশিগানে। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের কুটির, যা উইন্ডমেয়ার নামেও পরিচিত ছিল। এটি মিশিগানের ওয়ালুন লেকে অবস্থিত। কথাসাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে উত্তর মিশিগানের পটভূমিতে একাধিক সাহিত্য রচনা করেছেন। এই কুটিরটি দ্য ডক্টর অ্যান্ড দ্য ডক্টরস ওয়াইফ, টেন ইন্ডিয়ান্স, দ্য ইন্ডিয়ান্স মুভড অ্যাওয়ে, দ্য লাস্ট গুড কান্ট্রি ও ওয়েডিং ডে গল্পে চিত্রিত হয়েছে।
আর্নেস্ট ও ম্যারি হেমিংওয়ের বাড়ি ছিল আইদাহোর কেচামে। ১৯৫৯ সালে হেমিংওয়ে ৫০ হাজার মার্কিন ডলারের বিনিময়ে বাড়িটি কিনেছিলেন। ওই বছরের নভেম্বরে হেমিংওয়ে এখানে বসবাস শুরু করেন। এই বাড়িতেই হেমিংওয়ে ১৯৬১ সালের ২ জুলাই আত্মহত্যা করেন।
করোনা অতিমারির প্রকোপে জীবন যখন ঝুঁকিতে, তখন মনে হলো সমুদ্রের জলে সব ধুয়ে মুছে আসলে ভালো লাগবে। নিউইয়র্কে আজকাল কোনি আইল্যান্ড বিচ বা জোনস বিচে গেলে পানিতে দুর্গন্ধ পাই। তাই কেন যেন পানিতে পা ভেজাতেও ভালো লাগে না। এখানে বিচের পানি টলটলে। বালিও সাদা। ঝিনুক শামুক ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে আসছে।
পানির যত কাছে যাই, পানির আছড়ে পড়ার শব্দ যেন ডাকছে আমাদের। আমরা ছাতা চেয়ার আর বালির ওপর বসা শোয়ার আয়োজন করে ছবি তুলে পানিতে নেমে পড়ি। পানিতে কয়েকবার ঢেউয়ের ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে যেতে শিখে নিই ঢেউয়ের ওপর মাথা তুলে ভাসতে আর ঢেউয়ের সঙ্গে দুলতে। এসব শিখিয়ে দেয় আমার ছেলে। বড় বড় ঢেউ আসে মাথায় অভ্রের মুকুট নিয়ে, আমরা ঢেউয়ের মাথায় দুলতে থাকি। প্রায় দুই বছর পর সমুদ্রের জলে নামা। পায়ের নিচে বালি সরিয়ে নিয়ে যায়। মনে পড়ে যায় প্রথম সমুদ্র দেখার কথা।
যুক্তরাষ্ট্রের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে এ বছর হোটেল আগে আগেই সব বুকড। এক বছর হোটেল ব্যবসা ছিল না বললেই চলে। এবার এক মাস আগে হোটেলে বুকিং দিতে হয়েছে। আসার পর দ্বিতীয় দিন সকালে দেখি ফুল বুকড সাইন ঝুলিয়ে দিয়েছে সামনের ডেস্কে।
হোটেল বুকিং দিয়ে ১০-১২ ঘণ্টা ড্রাইভ করে পৌঁছে যাই মারটাইল বিচে। লম্বা ভ্রমণে আমরা ক্লান্ত। চেক ইন করার আগেই রেস্টুরেন্টে খেয়ে নিই। ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে সমুদ্র দেখতে যাই। বালির বুকে পায়ের ছাপ এঁকে আমরা হাঁটতে থাকি পূর্ব থেকে পশ্চিমে। আবার পশ্চিম থেকে পূর্বে। যদিও জানি পায়ের ছাপগুলো ঢেউ এসে মুছে দেবে। ঢেউ মুছে দিলেও সব কী মুছতে পারে!