মায়ের কাছে মেয়ের চিঠি

‘মা’, খামের ওপর লেখা দেখে এতক্ষণে বুঝে গেছো কার চিঠি হতে পারে? কি, খুব অবাক লাগছে? ভাবছো সত্যি, নাকি স্বপ্ন! তাই না মা? তোমায় লেখা আমার এ চিঠি বাস্তবের দুনিয়া থেকে, কোনো অবাস্তবের দুনিয়া থেকে নয়। আজ তোমায় কিছুতেই লিখে উঠতে পারছি না। কেন জানি বার বার চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে আসছে। আর নোনাজল গড়িয়ে এসে চিঠিটাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে বলো তো ? তুমি তো জানো যে, আমি এতটা ইমোশনাল নই। আমার ওটা কখনোই ভালো লাগত না। আমি জানি মা, তুমি এখনো ভাবছো এ আমি, নাকি তোমার মেয়ের কোনো প্রেতাত্মার চিঠি। তবে, এবার বলছি মন দিয়ে শোনো।
সেদিনের যে বাস দুর্ঘটনার কথা শুনেছো, সেদিন আমি এই হতভাগা ছাড়া আর কোন যাত্রী বেঁচে ছিল না, মা। তোমার ভালোবাসার জোরে যম আমায় সেদিন নিতে পারেনি। এটুকু বেশ বুঝেছি। তা না হলে সেদিনের সেই দুর্ঘটনায় কেনই বা শুধু আমি বেঁচে রইলাম? আমার বেঁচে থাকার খবরটা কাউকে না জানাতে আমিই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে নিষেধ করি। কিন্তু পুরো পৃথিবীর কাছ থেকে লুকোতে পারলেও তোমার কাছ থেকে কিছুতেই লুকোতে পারলাম না। আমি জানি যে, অন্তত একজন এই পৃথিবীতে আছেন, যিনি নিভৃতে আমাকে ভেবে যাচ্ছেন। আমার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন, তিনি আর কেউ নন, সে তুমি—আমার মা।
এত ভেব না আমায় নিয়ে মা, এখনো ভাবছো বেঁচে আছি কি না? তুমি নিশ্চিন্ত হও, আমি বেঁচে আছি। তোমাকে নিশ্চিন্ত করব বলেই তো আজ আমার এ প্রয়াস। আমি জানি, আমার জন্য আজ তোমার বুকের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা। কষ্ট পেও না, মা। সুখ নামক জিনিসটাই আমার কাছে একটা অলীক বস্তু। আর সুখ কেউ কাউকে দিতে পারে না, যতক্ষণ না নিজে নিজেকে সুখ দেওয়া যায়। ভেবো না, একটা জীবন আর কতই বা দীর্ঘ হতে পারে? তবে আমি তোমাদের মেয়ে হয়ে তোমাদের সুখী করতে চেয়েছিলাম, তা–ও পারলাম না। কারণ, আমি সুখী করতে চেয়েছিলাম তোমাদের আর তোমরা সুখী করতে চেয়েছিলে ঘুণে ধরা সমাজটাকে। কিন্তু তোমরা এটা কখনো ভেবে দেখনি যে এই ঘুণে ধরা সমাজটা শুধু তোমার সাফল্যটুকুই ফোকাস করবে। তোমার সুসময়ে পাশে থাকবে কিন্তু তোমার দুর্দিনে তুমি তাকে পাবে না।
এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও এই সমাজটাকে আমার বড় পক্ষপাতদুষ্ট মনে হয়। এর গোড়াটা ঠিক একই রকম রয়ে গেছে। বদলেছে শুধু প্রকাশভঙ্গিতে। পৃথিবীতে কত আর্শ্চয ঘটনাই না প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। প্রতিনিয়ত প্রযুক্তিতে পরিবর্তন আসছে। শুধু পরিবর্তন আসেনি এই একটা জায়গাটাতে—নারী-পুরুষের বৈষম্যতে। সেটা এখনো রয়ে গেছে অন্যভাবে, অন্যরূপে৷
হয়তো আমার সঙ্গে অনেকেই একমত হবেন না। তাতে আমার কিচ্ছুটি যায়–আসে না, মা। এতদিনে যা যা আমি করে এসেছি, আজ আমার মনে হয় সবটিই অপচয়। জীবনের অপচয়, সময়ের অপচয়, অনেক অনেক কিছুর অপচয়। তাই আজ আর কোনো অপচয় আমি করতে চাই না, মা। বিশ্বাস করো ঘর–সংসার করে আমি শুধুই তোমাদের সুখী করতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, তাহলে তোমরা অন্তত সুখী হবে। কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারলাম না। আমায় ক্ষমা করে দিও মা।

ধীরে ধীরে আমি অনুধাবন করলাম যে, এই আমিই আমার কাছে বড় অচেনা হতে লাগলাম। এ এক অন্য আমিকে আবিষ্কার করলাম। ঠিক তখনই আমার চৈতন্যোদয় হলো, ব্যক্তিত্বের এত অপচয়, এত অপমান, মনুষ্যত্বের এত অবমাননা, এ আর আমি বইতে পারব না। এক জীবনে পৃথিবীকে দেওয়ার মতো অনেক কিছুই আছে। স্রষ্টা কেবল একটি মাত্র কাজ করার জন্য কাউকে পৃথিবীতে পাঠায়নি। ‘স্বামী’ নামক একটি বস্তুর সঙ্গে ঘর-সংসার করার জন্যই শুধু একটি মেয়ের জন্ম কখনো হতে পারে না। এত সুন্দর পৃথিবীতে, এত সুন্দর জীবন দিয়ে স্রষ্টা আমাদের পাঠিয়েছেন, শুধুই কি বিয়ে নামক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে শত কিছুর পরও মুখ বুজে সহ্য করে পরিশেষে মৃত্যুবরণ—এ–ও কি কখনো জীবনের কোনো মানে হতে পারে?
হয়তো পারতাম, দিনের পর দিন তোমাদের সামনে সুখে থাকার অভিনয় করে যেতে, কিন্তু এত বড় মিথ্যে দিনের পর দিন করা যায় না। একদিন না একদিন সেটা ঠিকই প্রকাশ পেয়ে যেত। সত্যিটা অন্তত তোমাকে আমি কখনোই লুকোতে পারতাম না । সত্যিটা মেনে নাও। এ সুন্দর ভুবনে কত সুন্দর সুন্দর সৃষ্টিই না আছে। হয়তো আমরা সবটা জানিও না । স্রষ্টার এ সুন্দর সৃষ্টিকে উপভোগ করে স্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানাতে গেলেও এক জীবনে শেষ হওয়ার নয়।
জানো তো, আমার খুব ইচ্ছে করে এক তুড়িতেই পৃথিবীটাকে বদলে দিতে । ভেদাভেদের এ পৃথিবী আর কতদিন? কতদিন আর এভাবে চলতে পারে? একটা বড় পরিবর্তন দরকার মা। মনুষ্য জীবনের বড় অপচয় ঘটে চলছে। বিশেষ করে নারী জীবনের। হয়তো ভাবছো, নারীবাদী হয়ে গেলাম কি না? মা জানো, ওটার অনেকেই সমালোচনা করে। অনেকেই ধর্মের দোহাই দিয়ে সেই সব নারীর মুখ বন্ধ করতে চায়। দমিয়ে রাখতে চায় সেই সব নারীকে বিশেষ করে যারা নারীদের পক্ষে কথা বলেন।

দিনের পর দিন এই সমাজ অলিখিতভাবে আমাদের নারীদের যেসব নিয়মের বুলি পালনে বাধ্য করেছে, তার সবটাই এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সৃষ্টি। কিন্তু আর বোধ হয় বেশি দেরি নেই, ধীরে ধীরে হলেও জোর করে চাপানো প্রথাগুলো ভাঙতে শুরু করেছে। হয়তো সমতার পৃথিবী একদিন নিশ্চয়ই আসবে। কী বলো মা? আসবে তো? আমায় নিয়ে আর ভেবো না মা। এতদিন একটা মিথ্যে শৃঙ্খলে বন্দী ছিলাম। আজ আমি মুক্ত। আজ প্রাণভরে শ্বাস নিতে পারি।
এই প্রাণভরে শ্বাস নেওয়ার বড় প্রয়োজন ছিল আমার জন্য। এ রকম জীবিত থেকেও যে কত নারী মৃত, তার কটা খবর আমরা রাখি, বলো মা? যাকে বলে জীবন্মৃত। জীবনের এ অপচয় ঘোচাতে হবে মা। তুমি দুহাত ভরে দোয়া করো যেন আমার বাকি জীবনে এই ঘুণে ধরা সমাজটার জন্য কিছু একটা করতে পারি। কোনো নারী জীবনের যেন আর কোনো অপচয় না ঘটে। আমি জানি, এ কাজটা অতটা সহজ নয়। শুধু তুমি আমার পাশে থেকো সব সময়। আমায় নিয়ে একটুও ভেবো না মা। এই তো বেশ আছি আমি নিজেকে নিয়ে। এবার বিদায় নেওয়ার পালা। তুমি ভালো থেকো মা। যেখানেই থাকো, ভেবো, একই আকাশ আমিও দেখছি ।
ইলমা আফরিন সিলভিয়া
প্রিটোরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা