মানুষ পৃথিবীর ফুসফুস ধ্বংস করছে, করোনা করছে মানুষের ফুসফুস

করোনাভাইরাস
প্রতীকী ছবি

প্রকৃতির ভয়াল, রুদ্র রোষ মনে হয় করোনাভাইরাস রূপে পৃথিবীতে নেমে এসেছে। মানবজাতির বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ শুরু করেছে কোনো ঘোষণা ছাড়াই। পূর্বপ্রস্তুতির কোনো সুযোগ দেয়নি সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ নামধারী মানবজাতিকে। অনেকটা যেন অতর্কিতেই  হামলা করেছে করোনাভাইরাস। আর এই ‌অঘোষিত আক্রমণে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত সমগ্র দুনিয়া! হতবিহ্বল, দিশেহারা মানুষ করণীয় ঠাওরে উঠতে গলদঘর্ম হচ্ছে। স্থবির হয়ে পড়েছে সারা বিশ্বের অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি—সবকিছু।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে সাত দশকের বেশি আগে। যেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ রূপে উত্থান হয়েছে করোনাভাইরাসের। কাঁপিয়ে দিচ্ছে মহাশক্তিধর বাঘা বাঘা সব রাষ্ট্রকে।

২০১৯–এর ডিসেম্বরের শেষ ভাগে চীনের উহান প্রদেশ থেকে যার উৎপত্তি এবং মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই প্রায় পুরো ইউরোপকে কবজায় নিয়ে মার্চের মধ্যেই দখল নিয়ে ফেলল বর্তমান দুনিয়ার একমাত্র পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও। এরপর চলতে থাকল করোনাভাইরাসের সাম্রাজ্য বিস্তার এবং এপ্রিলের মাঝামাঝি দখল নিয়ে ফেলল গোটা দুনিয়ার।

বর্ষ পরিক্রমায় এক ডিসেম্বর গত হয়ে আরেক ডিসেম্বর আগত প্রায়। কিন্তু এক বছর পার হলেও করোনাভাইরাসের দাপট একটুও কমেনি। কেবল ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকায় সামান্য স্তিমিত হয়ে এসেছিল। কিন্তু ভারত ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিলসহ আরও কয়েকটি দেশে করোনা সংক্রমণের বিস্তার বেড়েছে ভীতিজনকভাবে। শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে সারা দুনিয়ায় এবং স্তিমিত হয়ে আসা উত্তর আমেরিকা, ইউরোপের দেশগুলোসহ সারা বিশ্বেই আবার বিপুল বিক্রমে কঠিন থাবা বসিয়েছে করোনা! ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের উন্নত, অনুন্নত সব দেশই তাদের এলোমেলো হয়ে যাওয়া অর্থনীতি সামান্য গুছিয়ে আনার চেষ্টা শুরু করতে না করতেই আবার লকডাউনে যেতে বাধ্য হয়েছে। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি থেকেই ব্যাপকভাবে বাড়তে শুরু করেছে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা। সবার মতোই ভীত, সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছি আমরাও। সুইজারল্যান্ডের মতো স্বল্প জনসংখ্যার দেশেও করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে হু হু করে, সেই সঙ্গে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা।

করোনা সংক্রমণের প্রথম ধাক্কার সময় নিউইয়র্ক শহরে ছিলাম। নিউইয়র্ক ছিল যেন এক মৃত্যুপুরী! প্রতিদিন প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি মুহূর্ত কাটত ভয় আর শঙ্কার মধ্যে। প্রতিদিন করোনায় আক্রান্ত হাজারো মানুষের মৃত্যুসংবাদ, হাজারো শোকার্ত মানুষের আহাজারির খবর শুনতে হতো সব সময়। বাবা মারা গেছেন করোনায়, করোনায় আক্রান্ত মা ধুঁকছেন মৃত্যুশয্যায়, দিশেহারা অবোধ শিশুর শেষ আশ্রয় হয়েছে রাষ্ট্রীয় আশ্রয়কেন্দ্রে—এমন সব হৃদয়ভাঙা, হাহাকার ভরা খবর শুনতে শুনতে মনে হতো নিজেরাই অসুস্থ হয়ে পড়ছি।

নিউইয়র্ক শহরের ম্যানহাটান এলাকায় থাকতাম আমরা। নিউইয়র্কের সবচেয়ে ব্যস্ততম এলাকা। বিশ্বের বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত নিউইয়র্ক শহর। যে শহর দিন-রাত কখনো ঘুমায় না। সদা চাঞ্চল্যে ভরা। সারা দিন সারা রাত হরেক রকম গাড়ির ছুটে চলার বিরামহীন আওয়াজ, পুলিশের গাড়ির তীব্র হুইসেল, অ্যাম্বুলেন্সের সতর্কসংকেত দিয়ে রাস্তা পার হওয়ার শব্দ, গাড়ির আওয়াজে ম্যানহাটানের মানুষ হয়তোবা স্বস্তিতে ঘুমাতে পারে না কখনোই। সেই নগরী যেন পরিণত হয়েছিল এক ভুতুড়ে নগরীতে।

গাড়ির তীব্র গতিতে ছুটে চলার শব্দ, পুলিশের গাড়ির কানে তালা লাগানো হুইসেল—সব যেন থেমে গিয়েছিল করোনাভাইরাসের ভয় জাগানো আস্ফালনে! অ্যাম্বুলেন্সগুলোই যেন কেবল কোনো সতর্কসংকেত ছাড়া নীরবে বিরামহীনভাবে করোনায় আক্রান্ত অসুস্থ মানুষকে হাসপাতালে বা নিরাময় কেন্দ্রে পৌঁছে দিয়েছে অথবা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে মৃত মানুষদের দেহ দাফনের জন্য কবরস্থানে রেখে এসেছে। শেষ পর্যন্ত কবরস্থানে স্থান সংকুলানের অভাবে অসংখ্য মৃতদেহের দাফন ছাড়াই গণকবরে স্থান হয়েছে। শুধু নিউইয়র্ক নয়, ইতালিসহ পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রের এই অসহায় অবস্থা সারা দুনিয়ার মানুষকে আতঙ্কিত হয়ে দেখতে হয়েছে।

করোনাভাইরাস
প্রতীকী ছবি: রয়টার্স

করোনায় আক্রান্ত বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে সন্তান অথবা নিজ সন্তানকে পিতা-মাতার জঙ্গলে ফেলে আসার নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন সংবাদ উঠে এসেছে সংবাদপত্রের পাতায়।

করোনায় মৃত আপনজনদের শেষকৃত্যে অংশগ্রহণেও ভীত আর দ্বিধান্বিত হয়েছে মানুষ। চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান, পুলিশসহ অসংখ্য সেবাদানকারী মানুষকে করোনায় আক্রান্ত রোগীকে সেবা দিতে গিয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে। করোনার সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন বহু গণমাধ্যমকর্মী।

করোনাভাইরাসের প্রথম ধাক্কাতেই বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষের জীবনে নেমে এসছিল বেকারত্বের কঠিন অভিশাপ। সেই ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই নতুন করে নেমে এসেছে বেকারত্বের বোঝা। মানুষের রুটি-রুজির পথ উন্মুক্ত হওয়ার আগেই আবার রুদ্ধ হয়ে গেছে।

বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানী আর গবেষকেরা এই প্রাণঘাতী রোগের প্রতিষেধক তৈরির জন্য গলদঘর্ম হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু এখন পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি গবেষকদের চেষ্টা। তবে অনেকটাই এগিয়ে গেছেন। বিশ্বের লক্ষ কোটি মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে—কবে গণমাধ্যমে শুনবে করোনাভাইরাস প্রতিরোধের সফল ওষুধটি মানব শরীরে প্রয়োগের খবর।

কিন্তু পৃথিবীতে কেন আসে বারবার করোনাভাইরাসের মতো ভয়ংকর কিংবা এ ধরনের ভাইরাসের আক্রমণ? এবারের করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল ছিল নাকি চীনের উহান প্রদেশের একটি মাংসের বাজার, যেখানে বিভিন্ন ধরনের বন্য পশুপাখির মাংস বেচাকেনা হয়। আবার এ ধারণাও প্রচলিত যে বাদুর থেকে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি।

কোনটি সঠিক, সেটা নিশ্চিত করে এখন পর্যন্ত কেউই বলতে পারছে না।

গৃহপালিত বা খামারে পালিত পশুপাখি খেতে খেতে মানুষের বোধ হয় অরুচি ধরে গেছে, তাই এখন বনের পশু-পাখির দিকে নজর পড়েছে। আর তাই সমুদ্রের তিমি থেকে শুরু করে সাপ, ব্যাঙ, হাঙর, কুমির—কেউই রক্ষা পাচ্ছে না মানুষ নামের সর্বভুক প্রাণীটির হাত থেকে। এসব অবোধ প্রাণীকে তাদের নিজস্ব আবাসস্থল থেকে উচ্ছেদ করে, তাদের ন্যায্য অধিকারকে হরণ করে সর্বগ্রাসী ক্ষুধা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মানুষ। মানুষের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না বনজঙ্গল, পাহাড়, নদী, সমুদ্র, আকাশ-বাতাস—কোনো কিছুই। স্বস্তিতে থাকতে পারছে না পরিবেশ, প্রকৃতি। মানুষের হাতে ধ্বংস হচ্ছে পৃথিবীর ফুসফুস খ্যাত আমাজন। তবে কি করোনাভাইরাস প্রকৃতির প্রতিশোধ! মানুষ ধ্বংস করছে পৃথিবীর ফুসফুস আর করোনা ধ্বংস করছে মানুষের ফুসফুস!

করোনাভাইরাস
প্রতীকী ছবি

আন্তর্জাতিক ফেডারেশন অব রেডক্রস অ্যান্ড রেড় ক্রিসেন্ট (আইএফআরসি) জলবায়ু পরিবর্তনকে কোভিডের চেয়ে বড় হুমকি বলে উল্লেখ করেছে। সংস্থাটি জানিয়েছে, ১৯৬০–এর দশকের পর থেকে বিশ্বে যে শতাধিক বিপর্যয় ঘটেছে, তার বেশির ভাগ ছিল জলবায়ু–সম্পর্কিত। আইএফআরসি আরও বলেছে, মহামারির ভয়াবহ সংক্রমণের মতো জলবায়ু পরিবর্তন কোনো বিরতি দেবে না। সংস্থাটি বলছে, কোভিড-১৯–এর চেয়েও ভয়াবহ বৈশ্বিক উষ্ণতা। সংস্থাটির জেনারেল সেক্রেটারি জাগান শাপাগেইন হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘করোনার ভ্যাকসিন তৈরিতে আশার কথা শোনা যাচ্ছে। দুর্ভাগ্যক্রমে জলবায়ু পরিবর্তনের কোনো ভ্যাকসিন নেই।’(সূত্র: প্রথম আলো, ১৭ নভেম্বর ২০২০)

করোনাভাইরাস আরও একটি বিষয় বিশ্বের চিন্তাশীল মানুষকে ভাবিত করেছে, আর তা হলো বিশ্বব্যাপী মহাশক্তিধর দেশগুলোর অবহেলিত স্বাস্থ্য খাত। উন্নত, অনুন্নত সব দেশই তাদের তথাকথিত প্রতিরক্ষা খাতে অর্থাৎ মানবসভ্যতাকে ধ্বংস করার জন্য বিলিয়ন, বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতে এসব দেশের বরাদ্দের অপ্রতুলতা লজ্জাজনক। মানুষের জীবন রক্ষায় নয়, ধ্বংসেই যেন এদের আগ্রহ বেশি। অস্ত্র প্রতিযোগিতার নিষ্ঠুর নেশায় যেন উন্মাদ হয়ে গেছে সারা পৃথিবী!

যে মানুষ নিজের ক্ষমতার দম্ভে বিভোর! সমুদ্রে, মহাসমুদ্রে ‌অন্তরীক্ষে, ভূতলে যার অবাধ বিচরণ, জ্ঞানে–বিজ্ঞানে তথ্যে–প্রযুক্তিতে যে মানুষ আজ নিজের অভাবনীয় সাফল্যে যেন নিজেই বিস্ময়াভিভূত, সেই অসীম ক্ষমতাধর মানুষকে, তার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতাকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিতেই যেন বারবার বিভিন্ন ধরনের ভাইরাসে প্রকম্পিত হয় পৃথিবী।

করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকেই যখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ‘লকডাউনে’ যেতে বাধ্য হয়েছে, বাংলাদেশসহ পৃথিবীব্যাপী বায়ুমণ্ডলের দূষণ কমে গেছে উল্লেখযোগ্য হারে।

সংবাদপত্রের মাধ্যমে আমরা জেনেছি, কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত ছেয়ে গেছে মর্নিং গ্লোরি ফুলের লতায়, কুয়াকাটা আর কক্সবাজার সমুদ্রে দেখা গেছে গোলাপি ডলফিন, কুয়াকাটার গঙ্গামতীর চরে দেখা গেছে ঝাঁকে ঝাঁকে লাল কাঁকড়া, ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন ব্যস্ততম শহরের সড়কে শুয়ে, বসে অলস সময় পার করতে দেখা গেছে হিংস্র বন্য প্রাণীদের।

কাজেই অন্য গ্রহে পাড়ি জমানোর উদ্ভট চিন্তা থেকে সরে এসে মানুষের সীমাহীন লোভ আর উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই আমাদের এই সবুজ শ্যামলিমা বসুন্ধরাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি আরও হাজার হাজার বছর, যেখানে আমাদের উত্তর বংশধরেরা আমাদেরকে ‌‌অভিসম্পাত না করে শান্তিতে আর স্বস্তিতে জীবন কাটাতে পারবে। আর তখনই হয়তো করোনাভাইরাসের মতো অতিমারি আমাদের সুন্দর আর স্বপ্নের মতো পৃথিবীটাকে ওলটপালট করে দিতে আসবে না বারবার। সেই শুভবুদ্ধি বিধাতার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, বুদ্ধিমান মানবজাতির মনে যত শিগগির উদয় হয় ততই মঙ্গল!

সব শেষে কিশোর কবি সুকান্তের সেই অমর কবিতা সবার মনে অনুরণিত হোক:
‘চলে যাব—তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি—
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’


*লেখক: আইনজীবী, সাবেক উপপরিচালক, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি