মানবকল্যাণে প্রয়োজন ভালোবাসা

চরম অবক্ষয়ের চিত্র জীবন্ত হয়ে আছে আমাদের সমাজ জীবনে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাঙ্গন, অফিস-আদালত থেকে শুরু করে দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এ অবক্ষয় বিদ্যমান। এ অবক্ষয় ধীরে ধীরে প্রভাবিত করছে সমাজকে, কলুষিত করছে মানুষের মন-মানসিকতাকে। সন্ত্রাস, হত্যা, নারী নির্যাতন, ছিনতাই, ধর্ষণ, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, অপহরণ, অ্যাসিড নিক্ষেপ, ভীতি প্রদর্শন এখন আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা, সিলেট ও বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম এখন অপহরণের কেন্দ্রস্থল হিসেবে পরিগণিত। দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে আজ নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের জীবন প্রদীপ নিভে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। চতুর্দিকে অরাজক পরিস্থিতি শান্তিপ্রিয় মানুষগুলোর জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। আমরা এখন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, মানবিকতার পরিবর্তে পশুত্বের চর্চা হচ্ছ। উদ্বেগাকুল সচেতন নাগরিকদের মনে আজ প্রশ্ন, কত দিন চলবে এ অরাজকতা?

এহেন পরিস্থিতির মধ্যেও কিছু মানুষ স্বস্তিতে থাকতে চায়, কিছু মানুষ শান্তিতে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু এই শান্তিকে বিনষ্ট করে দিচ্ছে সমাজের কোন্দলপ্রিয় কিছু মানুষ। এদের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে পরিষ্কার বোঝা যায়, এর মূলত ঝগড়াটে। ঝগড়ার মাধ্যমে এরা অন্যকে অপদস্থ করে নিজেরা লাভবান হতে চায়। এসব কোন্দলপ্রিয় লোকের অনেক বদস্বভাব রয়েছে এবং এসব বদস্বভাব ও অসততার মাধ্যমে এরা সমাজ তথা পরিবারে কোন্দল সৃষ্টি করে। যেমন এরা কোন কিছু না বোঝে বা তদন্ত না করে যখন-তখন মিথ্যা কথা বলে।

আবু হুরাইয়া (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন; একজন লোকের জন্য মিথ্যা বলা যথেষ্ট হবে এভাবে যে, সে যা শুনল তা লোককে বলে বেড়াল (মুসলিম, মিশকাত)।’ এ হাদিসটি ব্যাখ্যা করলে আমরা বুঝতে পারি, কেউ যদি কোন কথা শোনার পর সেটি সত্য কিনা যাচাই না করে অন্য লোককে বলে, তাহলে তার বলা কথাগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা হবে। এ জন্য প্রত্যেক মানুষের উচিত, যেকোনো বিষয়েই সত্য-মিথ্যা তদন্ত করে কথা বলা। কারণ অন্য একটি হাদিসে মহানবী (স.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই শয়তান কোন ব্যক্তির রূপধারণ করে কোন সম্প্রদায়ের কাছে আসে, অতঃপর সে তাদের সামনে কিছু মিথ্যা কথা বর্ণনা করে, তারপর তারা সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। অতঃপর তাদের মধ্যে থেকে এক ব্যক্তি বলে, আমি একজন লোককে এ কথা বর্ণনা করতে শুনেছি, কিন্তু আমি তার নাম জানি না তবে তার চেহারা চিনি (মুসলিম, মিশকাত)।’

এভাবে শয়তান মানুষের রূপে এসে মিথ্যা রটায় এবং ঝগড়া বাঁধিয়ে দেয়। তাই কোন কথা শোনা মাত্র বলা ও মিথ্যা বলা উভয়ই সমান এবং এ জন্য কানপাতলা লোকদের সাবধান হওয়া উচিত নতুবা শয়তানের প্রতারণায় পড়ে তাদের অনুতপ্ত হতে হবে। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে অপ্রিয় লোক হচ্ছে ঝগড়াটে ব্যক্তি (বোখারি, মুসলিম, মিশকাত)।’ এ হাদিস থেকে আমরা বুঝতে পারি, আল্লাহ ভক্ত লোকেরা কোনো দিন পাষাণ হৃদয়ের এবং কোন্দলপ্রিয় হতে পারে না। তারা শান্তিপ্রিয় হবে এবং প্রয়োজনবোধে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে তাদের কিছুটা নমনীয়ও হতে হবে। যেমন একটি হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি হক পথে থেকেও শান্তি রক্ষার জন্য তর্ক-বিতর্ক ও ঝগড়া ত্যাগ করে, তার জন্য জান্নাতের মাঝখানে ঘর বাধা হয় (তিরমিজি, শারহুম সুন্নাহ।’ অতএব কোন মুসলমানই যেন ঝগড়াটে হয়ে আল্লাহ ও তার বান্দাদের অপ্রিয় না হয়, বরং সে যেন সর্বদা খোশমেজাজ ও হাসিমুখে থাকে। যেমন একটি হাদিসে হজরত আবু যর (রা.)-কে আমাদের প্রিয় রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘তুমি কোন ভালো জিনিসকে কখনো তুচ্ছ ভেবো না, যদিও তা তোমার কোন ভাইয়ের সঙ্গে হাসিমুখে সাক্ষাৎও হয় (মুসলিম, মিশকাত)।’

কোন্দল প্রিয় লোকদের মধ্যে সবচেয়ে জঘন্যতম চরিত্র হলো দুমুখো ব্যক্তি। হজরত আম্মার (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘দুনিয়াতে যে ব্যক্তির দুটি মুখ থাকবে, কিয়ামতের দিন তার আগুনের দুটি জিহ্বা হবে (আবু দাউদ)।’ এ হাদিস দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয়, পৃথিবীতে যারা দুমুখো চাল চালিয়ে সমাজের মধ্যে ভাঙনের সৃষ্টি করে, সেসব মুনাফিক কিয়ামতের দিনে আগুনের জিহ্বা দ্বারা নিজকেই ধ্বংস করবে। তাই আর এক বর্ণনায় রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘তোমরা কিয়ামতের দিন দুমুখো লোককে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে দুষ্কৃতপরায়ণদের মধ্যে পাবে। সে এদের কাছে আসে এক মুখে এবং ওদের কাছে যায় অন্যমুখে (বুখারি, মুসলিম)।’ এরূপে দুমুখো চরিত্রের লোকেরা একজনের কথা আরেকজনকে লাগিয়ে চলে সমাজের মধ্যে ভাঙনের সৃষ্টি করে। চুগোলখোরের পরিণতি সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘বিরূপ সমালোচনাকারী ও একের কথা অন্যকে লাগিয়ে সমাজ কলুষিতকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত)।’

কোন্দলপ্রিয় লোকদের আরেকটি জঘন্যতম স্বভাব হচ্ছে পরনিন্দা করা। এরা পরনিন্দা করে আপনজনদের শত্রু বানিয়ে নিজেদের বন্ধুরূপে প্রমাণ করার অভিনয় করে, যদিওবা এমন বন্ধুত্ব বা সম্পর্ক কোনো দিনই স্থায়িত্ব লাভ করে না। হজরত আবু সায়িদ ও জাবের (রা.) হতে বর্ণিত, তাঁরা দুজন বলেছেন, ‘গিবত বা পরনিন্দা ব্যভিচারের চেয়েও জঘন্য অপরাধ কেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ব্যভিচার করে, তারপর সে আল্লাহর কাছে তওবা করে, আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন। কিন্তু পরনিন্দাকারীর ক্ষমা ততক্ষণ হয় না, যতক্ষণ নিন্দিত ব্যক্তিটি তাকে ক্ষমা করে না দেয়।’ একদা রাসুলুল্লাহ (স.) সাহাবায়ে কিরামদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা জান গিবত কি? তাঁরা বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (স.) ভালো জানেন। তখন তিনি বলেন, তোমার ভাই সম্পর্কে এমন কিছু আলোচনা করা যা শুনলে সে অপছন্দ করবে। সাহাবায়ে কেরামদের একজন প্রশ্ন করলেন, আমি আমার ভাই সম্পর্কে যা বলছি তা যদি সত্যি হয়ে থাকে? রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, ‘তুমি যা বললে তা যদি তার মধ্যে থাকে, তাহলেও তুমি তার গিবত করলে। আর তা যদি তার মধ্যে না থাকে, তাহলে তুমি তার নামে মিথ্যা অপবাদ দিলে (মুসলিম ও আবু দাউদ)।’

কোন্দলপ্রিয় জঘন্য চরিত্রের লোকদের কাছ থেকে শান্তিকামী মানুষ পরিত্রাণ পেতে চায়। শান্তিপ্রিয় মানুষের মনের ইচ্ছেটি মনীষী এন হেনরি বলছেন এভাবে, ‘শান্তি এমনি মূল্যবান মণিমানিক্য বিশেষ যে, একমাত্র সত্য ছাড়া আমি সবকিছু এর পরিবর্তে দিয়ে দিতে পারি।’ আজ নৈতিক অবক্ষয়ের চরম সন্ধিক্ষণে শান্তিকামী মানুষ দুদিনের দুনিয়ায় কিছুটা শান্তিতে জীবনযাপন করতে তৃষ্ণার্ত চাতকের মত ছটফট করছে। লর্ড পামার স্টোনের ভাষায়, ‘শান্তির জন্য তখনই মানুষ চিৎকার করে যখন কোথাও শান্তি থাকে না বা শান্তি খুঁজে পায় না।’ সমাজের কোন্দলপ্রিয় বা ঝগড়াটে লোকগুলো অন্যান্য পরিবারের ব্যক্তিগত বিষয়গুলোর ওপর হস্তক্ষেপ করার প্রয়াস চালায়। কারও পরিবারে কোন ধরনের গন্ডগোল হলে, ভাইয়ে-ভাইয়ে পরষ্পরের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি বা ঝগড়া হলে, কোন ভাই তার কৃত অপরাধের জন্য শাস্তি ভোগ করলে, অপরাধী ভাইটি এসব কোন্দলপ্রিয় লোকদের সান্নিধ্যে এলে—এরা সহযোগিতা দিতে তৎপর হয়ে উঠে। এদের উদ্দেশ্য আসলে কোন উপকার নয়, শান্তিপ্রিয় ভদ্র পরিবারকে নাজেহাল বা অপদস্থ করা। এসব কোন্দলপ্রিয় বা ঝগড়াটে লোকদের অনেকেই নিজেদের সমাজসেবক হিসেবে পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করে।

একটু ভালোভাবে অনুসন্ধান চালালে দেখা যাবে, এসব কোন্দলপ্রিয় লোককে ভদ্রসমাজের কেউ দুচোখে দেখতে পারে না। এদের মূল পরিচয় এরা ঝগড়াটে, কোন্দলপ্রিয়। এরা নিজেদের পরিবারকে বাজারে পরিণত করেছে, তাই অন্যের পরিবারকেও বাজারে পরিণত করার প্রয়াস চালায়। মনীষী ক্রিস্টোফারের ভাষায়, ‘যারা ঝগড়াটে তারা নাক দিয়ে শুঁকে শুঁকে ঝগড়ার গন্ধ নেয়।’ সমাজে এসব ঘৃণিত লোকদের সম্পর্কে টমাস হুড বলছেন, ‘কলহপ্রিয়তা এক ধরনের মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।’ এসব কোন্দলপ্রিয় লোক অনেক সময় এলাকায় কোন ঘটনায় বিচারকের আসন অলংকৃত করতে চাইলে শান্তিকামী, শিক্ষিত, ভদ্রলোকেরা তা কোন অবস্থাতেই মেনে নেয় না। শান্তিপ্রিয় লোকদের বক্তব্য একটাই—এসব কোন্দলপ্রিয় লোক প্রতিদিন এত অন্যায়, অবিচার, অপকর্ম করছে আগে এদের বিচার হওয়া দরকার, প্রতিদিন কত অভিযোগ এদের সম্পর্কে শুনি, আগে এদের শাস্তি হওয়া উচিত। এরা আবার কি করে অন্যের বিচার করবে? বিচারককে অবশ্যই সৎ, সৎ কর্মপরায়ণ, সত্যবাদী, সৎ চরিত্রবান ও নিরপেক্ষ হতে হবে। কোন্দলপ্রিয় লোকগুলো যখন বুঝতে পারে এলাকার ভদ্র, শান্ত ও শিক্ষিত পরিবারগুলো কোনো দিন তাদের বিচার মেনে নেবে না, তখন তারা ভদ্র ও শিক্ষিত পরিবারটির বিপথগামী সদস্যকে সুমন্ত্রণা দান করে। আমি নিশ্চিত জানি প্রতিটি এলাকায় শান্তিকে বিনষ্টকরী এসব কোন্দলপ্রিয় মানুষকে শান্তিকামী মানুষ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। তারা টমাস গ্রের এ বাণীটিকেই যেন প্রাধান্য দেওয়ার চেষ্টা করে। তিনি বলছেন, ‘ঝগড়ার পথ হতে সরে থাকাই সম্মান রক্ষার প্রকৃষ্ট পন্থা, মূর্খরাই সাধারণত বিবাদ তালাশ করে।’

সমাজসেবক পদবির এসব কোন্দলপ্রিয় বা ঝগড়াটে লোক থেকে শান্তিকামীরা নিরাপদ অবস্থানে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে। তারা হজরত সোলায়মান (আ.)-এর বাণীটিকে অনুসরণ করতে চায়। তিনি বলেছেন, ‘ঝগড়া চরমে পৌঁছার আগেই ক্ষান্ত হও।’ মনীষী ইমারসনের বাণীটিও তাদের অজানা নয় তাই ঝগড়া থেকে তারা সরে থাকতে চায়। ইমারসন বলছেন, ‘যখন আমরা ঝগড়া করি, তখন ক্রোধে অন্ধ হয়ে যাই।’ তাই ভদ্র, শিক্ষিত, শান্তিকামীরা সব সময় তাদের মনটাকে, হৃদয়টাকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে। আর, গুইটারম্যানের ভাষায়, ‘একমাত্র মনের শান্তিই পারে জীবনকে পরিপূর্ণ করে তুলতে।’ মনীষী ওয়াল্ট হুইটম্যান আমাদের জানিয়ে দিচ্ছেন, ‘শান্তির প্রকাশ সব সময়েই সুন্দর ও সহজ হয়।’ আমাদের আশার বাণী শোনাচ্ছেন মনীষী কার্ভেন্টিস এ কথাটি বলে, ‘যার গৃহে শান্তি বজায় থাকে বিধাতা তাকে ভালোবাসেন।’ মনীষী গোল্ডস্মিথ তার অভিজ্ঞতা থেকেই বলেছেন, ‘গৃহের শান্তি স্বর্গের শান্তির চেয়ে কম নয়।’

কোন্দলপ্রিয় বা ঝগড়াটে লোকদের চরিত্র, তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমার লেখার শেষ প্রান্তে বলতে চাই, কোন্দলপ্রিয় বা ঝগড়াটে অথবা অশান্তিকারী যেই হোক না কেন তার কর্মের প্রতিফল সে পাবেই। আমাদের ধর্ম আমাকে তাই বলে এবং আমি তা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। মনীষী স্যামুয়েল দানিয়েল বলছেন, ‘কর্মফল প্রত্যেককেই ভোগ করতে হবে।’ আরেকজন মনীষী কার্লাইল বলছেন এভাবে, ‘অনেক মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক, এর জন্য ভাগ্য দায়ী নয়, দায়ী তার কর্মফল।’

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।