মানব জাতি ও আমরা বনাম তারা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ। এই জীবটি গোষ্ঠী বেঁধে সংঘবদ্ধভাবে বাস করে। কিন্তু সেই আদিম যুগ থেকেই তারা নিজেদের দুভাগে বিভক্ত করে নিয়েছে। বিভক্তিও খুব সহজ—আমি বনাম সে; অথবা আমরা বনাম তারা। ‘আমরা’ অর্থাৎ খুব আপন আর ‘তারা’ অর্থাৎ খুব পর। এই আপাতদৃষ্টিতে সহজ বিভক্তিটা আসলে খুব জটিল। এক বাক্যে বুঝিয়ে বলতে গেলে বলতে হয়—আমরা গোষ্ঠীতে যারা পড়ে তারা ঠিক আমাদের মতো; বাকিরা সবাই তারা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের মতো বলতে কী বোঝায়?

সেটা বুঝতে প্রথমে দেখতে হবে দৈনন্দিন জীবনে আমরা কীভাবে এই ভাগটা করি। ধরুন, একটি স্কুলের দুজন ছাত্রের মধ্যে একজনের বাবা সফল প্রকৌশলী আর আরেকজনের বাবা সাধারণ দিনমজুর। তো ইঞ্জিনিয়ার বাবার ছেলেকে দেখে শ্রমিক বাবার ছেলে বলল, ‘ধুর এই সব লাট সাহেবের ছেলেগুলা নিজেদের কী যে ভাবে, বাপের টাকায় খায়–দায়–ঘুমায়, আবার ভাব!’ ওদিকে প্রকৌশলী বাবার ছেলেটি বলল, ‘ধুর এই সব খ্যাত ছেলেগুলা যে নিজেদের কী ভাবে, কথাই বলতে পারে না ঠিকমতো আবার ভাব!’ আবার ধরুন, একজন তরুণ মায়ের সন্তানের জ্বর এল, তা দেখে আরেক প্রবীণ মা বললেন, ‘যেই মা বাচ্চা নিয়ে সারা দিন ঘোরে সেই বাচ্চার অসুখ তো হবেই! আমরা বাচ্চাদের কত যত্ন করতাম আর আজকালকার মেয়েরা!’ এবার একটু ২০ বছর সামনে গিয়ে দেখা গেল সেই দিনমজুরের ছেলেটি আজ একজন সফল প্রকৌশলী। তার ছেলেও আজকে স্কুলে আরেক ছেলের কাছে একই কথা শুনে এসেছে আর তার সম্পর্কেও আগের সচ্ছল ছেলেটির মতো একই কথা বলে এসেছে। এবার আবার ২০ বছর পেছনে গিয়ে দেখা গেল যে, যেই মা বাচ্চাকে এত যত্ন করতেন বলে দাবি করেন, সেই বাচ্চারও অনেক সময় স্বাভাবিক নিয়মে অসুখ–বিসুখ হয়েছে।

আরেক ধরনের ভাগ দেখা যায় যখন কোনো একটি বিষয়ে আলোচনা হয়। আর স্বাভাবিকভাবেই কেউ থাকে এর পক্ষে আর কেউ থাকে এর বিপক্ষে। তারপর এই দুই দল যৌক্তিক ও কার্যকরভাবে সেই বিষয়ে আলোচনা না করে একে ওপরের ওপর কাদা ছোড়াছুড়ি শুরু করে। একে অপরকে কদর্য ভাষায় গালাগালি শুরু করে। যা আবার মাঝে মাঝে মারামারিতে গিয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে সৃষ্টি হয় বিশৃঙ্খলা আর এর ইতিবাচক ফলাফল হয় শূন্য।

এমন আরও হাজারো উদাহরণ আছে যা দেখে বোঝা যায় যে শুধুমাত্র ভিন্নমত বা ভিন্ন পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে আমরা ঘৃণার একটি সীমাহীন চক্র তৈরি করি। যার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। আর সেই ঘৃণার একমাত্র কারণ হচ্ছে—সে আমার থেকে ভিন্ন! যদিও আমরা কমবেশি সবাই জানি, প্রতিটা মানুষকেই আল্লাহ নিজস্ব সত্তা দিয়ে তৈরি করেছেন। যার মানে আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে ভিন্ন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বৈচিত্র্যের যদি প্রয়োজন নাই থাকে, তাহলে আল্লাহ কেন এত বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছেন? উত্তরে তিনি বলেন, ‘...যদি তিনি চাইতেন, তাহলে তোমাদেরকে একই সম্প্রদায় হিসেবে সৃষ্টি করতেন, কিন্তু তিনি তোমাদের যা কিছু দিয়েছেন তা দিয়ে পরীক্ষা করতে চেয়েছেন, অতএব তোমরা সত্যের দৌড়ে শামিল হও। আল্লাহর কাছেই তোমাদের ফেরত যেতে হবে, অতঃপর তিনি তোমাদেরকে অবহিত করবেন সেই সব বিষয়ে, যেসব বিষয়ে তোমাদের মতবিরোধ ছিল।’ [কোরআন ৫: ৪৮ ] ‘...এবং তার নিদর্শনগুলোর মধ্যে রয়েছে মহাকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি, আর তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয়ই এর মধ্যে ইঙ্গিত আছে তাদের জন্য, যারা জ্ঞানী।’ [কোরআন ৩০: ২২ ]। আমি জ্ঞানী না হওয়ায় এই নিদর্শনগুলো বুঝতে বা এর প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করতে ভুল হতে পারে কিন্তু তাও একটু চেষ্টা করলাম।

লেখিকা
লেখিকা

প্রথমত, মানবিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম একটি হচ্ছে, সে একসঙ্গে সবকিছু করতে পারে না। প্রত্যেকেরই দক্ষতা ও জ্ঞানের একটি ভিন্ন শাখা আছে। একই মানুষ একই সঙ্গে আইনস্টাইন, রবীন্দ্রনাথ, রুনা লায়লা আর সাকিব আল হাসান হতে পারেন না। এই ক্ষমতা আল্লাহ দেননি কারণ এই প্রত্যেকটা জিনিসই চর্চা করে আয়ত্ত করতে হয়। আর মানুষের স্বল্প জীবদ্দশায় সবকিছুর চর্চা একসঙ্গে করা কোনোভাবেই সম্ভব না। কিন্তু যেহেতু এই সবকিছুরই প্রয়োজন আছে, তাই তিনি আলাদা আলাদা মানুষকে এই গুণগুলো দিয়ে পাঠিয়েছেন, যাতে একটি ভারসাম্য সৃষ্টি হয়। এই প্রক্রিয়ায় তিনি মানুষের মধ্যে অনেক দোষও দিয়েছেন। আবার এমন অনেক মানুষও সৃষ্টি করেছেন, যাদের বিভিন্ন গুণ থাকলেও, চর্চা বা সুযোগের অভাবে তা বিকশিত হয়নি। সবারই এই ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা আছে। দ্বিতীয়ত, ভিন্ন আদর্শের একজনের অভিজ্ঞতা আর জ্ঞান থেকে পৃথিবীকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়। যার ফলে মানুষের জ্ঞানের পরিধি বাড়ে। আবার, যখন কেউ লক্ষ্য করে যে, তার যা আছে তা সবার নেই, তখন সে হয় কৃতজ্ঞ, না হয় অহংকারী হয়। অর্থাৎ হয় সে আল্লাহর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, না হয় অনুত্তীর্ণ।

এদিকে, যখনই আমরা ভিন্ন হওয়ার অপরাধে কাউকে প্রত্যাখ্যান করি, তখনই অনিবার্যভাবেই সে রুখে দাঁড়ায়। তখন আমরা তাকে ঘৃণা করার আরও নতুন যুক্তি পাই আর আবারও একটি অফুরন্ত ঘৃণার চক্রে ঢুকে পড়ি। যেমন আমাদের দেশের ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়। যাদের প্রচলিত ভাষায় আমরা হিজড়া বলি। হিজড়াদের আমরা সামাজিকভাবে হেয় করি। তারা আর দশজনের মতো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পায় না। পরিবারের ভালোবাসা পায় না। কোনো কাজকর্মও পায় না। তাদের দোষ তারা সংখ্যাগুরু নারী বা পুরুষের কাতারে পড়ে না। তারা ভিন্ন। ফলাফল, তারা এখন ভীষণ বেপরোয়াভাবে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করে বেড়াচ্ছে। তারা হয়তো ভাবে, সবাইতো আমাদের এমনিতেই ঘৃণা করে। আমরা ভালো ব্যবহার করে কী করব। এদিকে আমরা আবার ভাবি, এরা এত খারাপ বলেই তো আমরা এদের এত ঘৃণা করি! কিন্তু যদি আমরা তাদের অপমান না করে আমাদের মতোই মানুষ ভাবতাম, তাদের স্কুলে যাওয়ার সুযোগ দিতাম, কর্মক্ষেত্রে সাধারণ ভাবে গ্রহণ করতাম, তাহলে কি এই সংকটের সৃষ্টি হতো?

অন্যদিকে, যেখানে আসলেই আমাদের কারও বিপক্ষে ভাগ হওয়া দরকার সেখানে আমরা ভীষণ উদাসীন। যখন আমরা দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার দেখি, তখন ভাবি এখানে আমি কী করতে পারি? যেমন ধরুন সৌদি আরব কর্তৃক ইয়েমেনে চলমান সংকটের চিত্র। হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, কয়েক লাখ শিশু অপুষ্টির কারণে শুধু হাড্ডি আর চামড়ায় পরিণত হয়েছে, লাখ লাখ মানুষ ঘর ছাড়া হচ্ছে। মার্কিন অস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতা আজ সৌদি আরব। আর সৌদি সরকারের আয়ের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ উৎস হচ্ছে হজ আর ওমরাহ (ফোর্বস, বিবিসি)। অর্থাৎ, নিরীহ মানুষকে অত্যাচারের জন্য কেনা অস্ত্রের অর্থে আমাদেরও কিছু অবদান আছে। শেষ বিচারের দিন আল্লাহ যদি প্রশ্ন করেন, জবাবে কী বলব হে আল্লাহ আমারতো কিছুই করার ছিল না তাই অত্যাচারীকে টাকা দিয়ে সাহায্য করেছি? এই অমানবিকতার বিরুদ্ধে কোনো ভাগ নেই কেন, কোনো আলোচনা নেই কেন?

‘নিশ্চয়ই আমরা আদমের সন্তানদের সম্মানিত করেছি...।’ [কোরআন ১৭: ৭০ ]। কোনো নির্দিষ্ট জাতি গোষ্ঠীকে নয়, হিন্দু-মুসলিম, ছেলে-মেয়ে, ধনী-গরিব, ফরসা-কালো, আওয়ামী-বিএনপি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, সাদপন্থী-শফিপন্থীকে নয়, আদমের সকল সন্তানকে।

কবি বলেন:

আকাশ আমার ঘরের ছাউনি
পৃথিবী আমার ঘর,
সারা দুনিয়ার সকল মানুষ
কেউ নয় মোর পর।

(কবি: সাবির আহমেদ চৌধুরী)

ভাগ যদি করতেই হয় সেটা মানবিকতা আর অমানবিকতার ওপর ভিত্তি করে করলে কেমন হয়?