
মাটির থালা। গ্রামেগঞ্জে সবার ঘরে ঘরে ছিল নিত্য ব্যবহারের অংশ। যার রং কড়া লাল, না হয় কালচে রঙের। দুবছর আগে দেশে বেড়াতে গিয়ে আড়ং থেকে শখ করে মাটির থালা নিয়ে আসি আমেরিকায়। বছর তিন যাবৎ নিয়মিত মাটির থালাতে আহার করছি প্রতিদিন ও প্রতিবেলা। মাটির থালায় খাবার নিয়ে বসলে পুরোনো দিনের অনেক স্মৃতি এসে ভিড় করে আপনা-আপনি। ভালোই লাগে সেই সময়টুকু। ব্যতিক্রমী পরিবেশনার সঙ্গে ফেলে আসা সোনালি দিনগুলোর উষ্ণ ছোঁয়া। কেউ কেউ বলেন, মাটির থালায় আহার করা স্বাস্থ্য ও শরীর দুটোর জন্য নাকি ভালো ও উপকারী।
গেল বছর বাংলাদেশে বেড়াতে গিয়ে এক স্বজনের বাসায় দাওয়াত খেতে গেলাম। টেবিল ভর্তি সব খাবারদাবার পরিবেশন করা হয়েছে সুদৃশ্য এবং নান্দনিক মাটির তৈরি থালা বাটি আর বড় আকারের মাটির তৈরি থালায়। দেখেই মনটি খুশিতে ভরে গেল। মেহমানদের জন্য মেজবান মাটির তৈরি পুরো ডিনার সেট ব্যবহার করছেন। শুধু থালা নয়, মাটির তৈরি জলপাত্র, তরকারির বাটিসহ সবকিছু টেবিলে সাজিয়েছেন সুন্দর করে। মনে মনে স্বপ্ন ছিল, মাটির তৈরি ডিনার সেটে আয়েশ করে মজাদার ডিনার সারব। সুযোগে তা সেরে নিলাম। পারিবারিক এই অনুষ্ঠানের আয়োজনে ভালো–মন্দ খাবারের মেন্যুতে যা সাধারণত থাকে, তার সবই ছিল। পাশাপাশি কিছু খাবার ছিল পশ্চিমা কাজিনের তালিকাভুক্ত। সেসব খাবারও পরিবেশন করা হলো মাটির তৈরি নানা আকারের বাসনপত্রে। শখ পুরো হলো বলে মনে মনে বেশ খুশিই হলাম। ভাবছি এখন থেকে দেশে গেলে দাওয়াত পেলে আগেই অনুরোধ রাখব, দেশি খাবার যেন মাটির তৈরি থালা বাসনে পরিবেশিত হয়।
মাটির থালা খুব কাছ থেকে আগেও দেখেছি। নিজের গ্রামের বাড়িতে। স্থানীয় ভাষায় থালাকে সবাই ডাকতেন ‘হানখ’। ধানের গোলার ভেতরে এক পাশে অসংখ্য মাটির তৈরি থালা বাসন থাক থাক করে মজুত রাখো হতো বাড়ির যেকোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানে ব্যবহারের জন্য। বিশেষ করে বার্ষিক শিরনির সময় মাটির থালার প্রয়োজন হতো বেশি। যেকোনো উৎসবের দিনি ধানের গোলা থেকে মাটির ওই থালাগুলো কাজের লোকজন বাইরে উঠানে এনে রাখত। প্রতি বছর প্রয়াত দাদা–দাদিসহ অন্যান্য মুরব্বির স্মরণে ঘটা করে আয়োজন করা হয় বার্ষিক শিরনির। ১০/১২টি বড় বড় গরু জবাই করে আয়োজন করা শিরনীতে আশপাশের গ্রামগুলোর প্রতি পরিবারকে সম্মানের সঙ্গে দাওয়াতের করা হতো। পাশের গ্রামের সবাইকে দাওয়াতের পাশাপাশি অন্য গ্রামের বয়স্ক মুরব্বিদের শিরনিতে দাওয়াত দেওয়ার রেওয়াজ ছিল অনেক পুরোনো। শিরনির সার্বিক আয়োজনে থাকতেন গ্রামের পঞ্চায়েত। আগে থেকে ঠিক করা শিরনির দু/চার দিন আগে গ্রামের পঞ্চায়েতকে বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে এনে সব আয়োজন সমজিয়ে দেওয়া হতো তাঁদের হাতে। শিরনির সব উপকরণ কেনা থেকে বাবুর্চি ঠিক করা। খাবারের আইটেম কী কী হবে—তার সবই নির্ধারণ করতেন পঞ্চায়েতের মুরব্বিরা। আয়োজক পরিবার এবার চলে আসলেন অতিথির কাতারে। পঞ্চায়েত কর্তৃক ঠিক করা মেন্যুতে কমপক্ষে ৪ জাতের সালুন থাকত। বিশেষ আইটেম ছিল গরুর হাড়ের মাংস দিয়ে বড় বড় মিষ্টি লাউ সহকারে সবজি তরকারি। সঙ্গে থাকত বেশি করে ঝাল দিয়ে মাংস ভুনা, ঘন করে মসুরির ডাল, সঙ্গে গরুর চার পাকে টুকরো টুকরো করে কেটে শুধু হাড় দিয়ে টক স্বাদের এক পদ, সিলেটী ভাষায় যার নাম সাতকড়ার খাট্টা।
সবজি, মাংস আর ডালসহ খাট্টার পর সব শেষে আসত সবার খুবই পছন্দের বিশেষ পদ যাকে ভাটি অঞ্চলে ডাকা হতো শাষণী। কয়েকটি উপাদেয় উপকরণের মিশ্রণে তৈরি হতো শাষনী। তিসির গুঁড়োর সঙ্গে তেঁতুলের টকের পাতলা মিশ্রণকে ছাঁকনিতে ছেঁকে নেওয়া হতো। আর সেই হালকা বাদামি রঙের মিশ্রণকে খাঁটি সরিষার তেলে বেশি করে রসুন যোগ করে দেওয়া হতো বিশেষ ফোড়ন। ফোড়ন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ত টক মিষ্টির এক মনকাড়া সুবাস। খেতে দারুণ লাগত। সাদা সুগন্ধি ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে মসলাদার খাবার খেতে তুলনাহীন স্বাদ পাওয়া যেত। টক মিষ্টি স্বাদের অতুলনীয় শাষণির ছোঁয়া ছিল লা জওয়াব। সব শেষে পানদানভর্তি দেশি ঝাঁজাল পান ও টুকরো করে কাটা পচা সুপারি।
শিরনি খাওয়াতে বসার আগেই নিজ মাটির থালা কলতলায় না–হয় হাওরের পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করে সারি হয়ে বসে পড়তে হতো উঠানে পেতে রাখা লম্বা লম্বা বাঁশের ওপর। বাইরে থেকে আসা মেহমানদের জন্য বাংলো ঘরের লম্বা লম্বা কালো চৌকিতে দস্থরখাঁ বিছিয়ে খাবারের আয়োজন হতো। সেখানে মেয়ে জামাই কিংবা বেয়াইরা মেহমান হয়ে এলে, তাঁদের খাওয়ানো হতো কাচের প্লেটে। বাদ বাকিরা বসতেন বাইরে উঠানে বিছানো চাটাইর ওপরে সারি করে রাখা বড় বড় বাঁশের ওপর। গ্রামের ধনী–গরিব সবার বসার আয়োজন একদম সমান। কোনো উঁচু–নিচু কিংবা কোনো ভেদাভেদ নেই। ছোট বেলায় আমাদের বাইরে বসতে দেওয়া হতো না। তাই লুকিয়ে বড়দের চোখ এড়িয়ে চাটাইর ওপর বাঁশে বসে শিরনি খেতে চাইতাম। কখনো পারতাম, কখনো না। একবার নয়া বাড়ির বড় চাচার সঙ্গে বসে পড়ি। কেউ কেউ তুলে দিতে চেয়েছিল। বড় চাচার পাশে বসা দেখে সাহস করে কেউই পাশেই আসেনি।
খুশিতে দৌড়ে গিয়ে মাটির হানখ (থালা) হাওরের পানিতে ধুয়ে নিয়ে এসে চাচার পাশে বসে গেলাম। হঠাৎ পেছনে ফিরে দেখি সদ্য আমেরিকা ফেরত আমাদের ছোট চাচা ফজলুল বারী। নতুন বাড়ির চাচার বিরাট দেহের আড়ালে নিজেকে লুকাতে চাইছি। ঠিক সেই সময় বড় চাচার চোখে পড়ে গেলেন প্রবাসী চাচা।
হাঁক দিয়ে বলছেন, ঘোরাঘুরি করছ কেন? যাও থালা নিয়ে এসে লাইনে বসে পড়। নয়া বাড়ির চাচার ওই হায়দরী আওয়াজের ডাক শুনে প্রবাসী ছোট চাচা নিমেষে হাওয়া। আমাকে আর পায় কে? লাল রঙের মাটির থালায় রাতা ধানের চালের সঙ্গে সব জাতের তরকারি মাখিয়ে মজা করে পেট পুরে শখের শিরনি খাওয়া শেষ করলাম। সব শেষে মাটির থালায় নিলাম বিখ্যাত শাষণী। থালার গলা পর্যন্ত ভর্তি করে নেওয়া তিসি ও চালের গুঁড়ার টক মিষ্টি স্বাদের টলটলে রসের অতুলনীয় স্বাদ আজও খুঁজে ফিরি গ্রামের বাড়ির বড় বাংলোর উঠানে। সুনামগঞ্জের হাওর এলাকার দক্ষিণ অঞ্চলের সেরা ধনী পরিবারের পরিবারের সব প্রবীণ আর নবীনের মাঝে ছিল মাটির প্রতি ভালোবাসা ও সখ্য। যা আমি নিজের মাঝে কখনো কখনো টের পাই। লোক দেখানো কৃত্রিমতার লেবাসে নিজেকে বড় করিনি। মাটির মানুষের সঙ্গে মিশে চলার পরিবেশে বড় হয়েছি বলেই মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হই আজও প্রতি নিয়ত। সহজ জীবনযাপন আজও মোর বিলাসিতা।
মানুষকে কতটুকু ভালোবাসতে শিখেছি, তা পরিমাপ না করতে পারলেও মানবতাকে ঘৃণা না করার শিক্ষা পেয়েছি নিজ পূর্বসুরীর কাছ থেকে। আর তাই হোক আমার বেঁচে থাকার প্রেরণা। তাই বুঝি এই বিদেশ বিভুঁইয়ে জীবনে যখন মাটির থালায় খেতে বসি, তখন নিজেকে আবিষ্কার করি, আমি যেন আমার ছোট্ট গ্রাম লাউগাঙ্গের পাড়ের গ্রামে চলে গেছি। এই অনুভব আমাকে কষ্ট দেয় না, বরং আনন্দ দেয়। স্মরণ করিয়ে দেয় মাটি আর মা আমার মননে, আমার হৃদয়ে কতটুকুন সম্মান আর ভালোবাসা নিয়ে শক্ত অবস্থানে আজও চির জাগরুক। আজকাল নানা সামাজিক দায়বদ্ধতায় আত্মীয়–স্বজনের সঙ্গে দেখা সাক্ষাতের সময় সুযোগ দুটো ক্রমশ সীমিত হয়ে আসছে। এত সব সীমিত জীবনযাপনের মাঝে এখনো নিজ হাতে পছন্দের দু/চার জাতের মাছ আর শাক সবজির বাজার যেমন সারতে পারছি। তেমনি পছন্দের জোড়া ব্যঞ্জন শখের কেনা মাটির থালায় নিয়ে মহানন্দে সীমাহীন সুখে প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছি আপন উদরপূর্তি। এ সুখ আমি কোথায় রাখি?