মহাস্থানগড়ের পাঁচ পদ

একটি দেশ বা বিশেষ অঞ্চলের খাদ্যতালিকায় থাকা খাবার এবং তা রান্নার উপকরণ ও পদ্ধতি প্রায় সর্বত্রই একই রকমের। তবে প্রাকৃতিক খাদ্য উপাদান, খাদ্য উৎপাদন ও প্রাকৃতিক পরিবেশের ভিন্নতার কারণে অঞ্চলভেদে বিশেষ কোনো খাবার বিখ্যাত হয়ে ওঠে, যা খাদ্যাভ্যাসের ক্ষেত্রে একটি অনন্য উদাহরণ তৈরি করে।

বাংলাদেশের অনন্য স্বাদের মজাদার ও বিশিষ্ট খাবারের নাম করতে গেলেই যে নামটি অবধারিত উঠে আসে মুখে, তা হলো ‘বগুড়ার দই’। বগুড়ার দইয়ের খ্যাতি আজ দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে।

আজকের মহাস্থানগড় বাংলার প্রাচীন জনপদ ঐতিহাসিক পুণ্ড্রবর্ধন নগরী। প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনের পাশে আজ মহাস্থানগড় বিখ্যাত আউলিয়া হজরত শাহ সুলতান বলখী (র.)–এর মাজারের জন্য বিশেষভাবে খ্যাত। প্রতিদিন দেশের নানা অঞ্চল থেকে প্রচুর ধর্মপ্রাণ মানুষ ও দর্শনার্থী আসেন মহাস্থানগড়ে। মাজারের শিরনি হিসেবে প্রচলিত খাবার কটকটি তৈরি ও বিক্রির জন্য গড়ে উঠেছে অনেক দোকান। চালের গুড়ায় তৈরি মণ্ড থেকে তৈরি কিউব তেলে ভেজে, জাল করা গুড়ের রসে ভিজিয়ে তৈরি মচমচে কটকটি বগুড়ার নিজস্ব।

দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় থাকা নানা খাবারের মধ্যে যেগুলো মোটামুটি এই এলাকার নিজস্ব, নিজস্ব রীতিতে রান্না হয় এবং মানুষ অঞ্চলের ঐতিহ্য হিসেবে ভালোবেসে খান, তেমন চারটি ব্যঞ্জন ও একটি মিষ্টান্ন তৈরির উপকরণ ও প্রণালি ভোজনপ্রেমীদের জন্য তুলে ধরছি।

নারকেল কোরার সঙ্গে কষা মাংস

(শীতকালে হাঁসে প্রচুর চর্বি থাকে, খেতে মজা হয় বলে হাঁসের মাংস দিয়েও এটি রান্না করা হয়ে থাকে। তবে আমি নিউইয়র্কের গ্রোসারিগুলোতে এ সময় হাঁস না পেয়ে আমাদের অঞ্চলে বেশি প্রচলিত গরুর মাংস দিয়েই রান্না করলাম।)

দেশের নানা অঞ্চলেই এই খাবারের প্রচলন কম বেশি আছে, বগুড়ার মানুষের খুব পছন্দের একটি খাবার এটি।

প্রণালি: দুটি নারকেল ভেঙে কুরিয়ে রেখে দিই। (বাজারে আজকাল প্যাকেটে কোরানো নারকেল পাওয়া যায়)। হাড়সহ চর্বিযুক্ত এক কেজি ২৫০ গ্রাম গরুর মাংস কেটে ধুয়ে নিই।

এবার পাতিলে তেল গরম করে পরিমাণ মতো পেঁয়াজ কুচি, আদা-রসুন বাটা, পরিমাণ মতো লবণ, মরিচের গুঁড়ো, জিরা ও ধনে গুঁড়ো, সামান্য পেপরিকা (লালচে রং হওয়ার জন্যে), হলুদ, চারটি এলাচি, দারুচিনি ও তেজপাতা দিয়ে নেড়েচেড়ে একটু গরম পানি মিশিয়ে মসলা ভালো করে কষিয়ে নিই। এবার মাংস দিয়ে নাড়াচাড়া করে ঢেকে দিই। মাংস ভালো করে কষিয়ে সিদ্ধ হয়ে গেলে এবার কোরানো নারকেল দিই। ভালো করে কষাই। তিনটি আলু বোখারা ও এক টেবিল চামচ চিনি দিই স্বাদ বাড়াতে। অল্প আঁচে কিছুক্ষণ রাখি। এরপর নামিয়ে পরিবেশন ডিশে সাজিয়ে ওপরে একটু পেঁয়াজ বেরেস্তা ছড়িয়ে পরিবেশন করি। জিভে লেগে থাকার মতোই একটি ডিশ এটি।

কাঁচা কামরাঙা দিয়ে চাপিলা মাছের চচ্চড়ি

(বগুড়ায় আঞ্চলিক ভাষায় চচ্চড়িকে পুরোপুরি বলা হয়ে থাকে): যেকোনো ছোট মাছের চচ্চড়ি আলু ও বেগুন, কিংবা আলু ও করলার সঙ্গেই তেল মসলা দিয়ে একবারে মেখে অল্প আঁচে বসিয়ে দিই। ঝোল শুকিয়ে মাখো মাখো হলে নামিয়ে ফেলি। অনেকে আবার শুকনো পোড়া পোড়া খেতে পছন্দ করেন। তবে আমার সবচেয়ে পছন্দ কাঁচা কচি কামরাঙা দিয়ে চাপিলা মাছের চচ্চড়ি।

প্রণালি: ছয়টি বড় আকারের চাপিলা মাছ কেটে ধুয়ে সামান্য লবণ-হলুদ মাখিয়ে তেলে অল্প ভেজে তুলে রাখি। চারটি বড় আকারের কাঁচা কামরাঙা ফালি করে (চাকা চাকা করে) কেটে ধুয়ে রেখে দিই। একটা বড় আকারের রসুনের সব কোয়া ছিলে কুচি করে রাখি।

উপকরণ: পাতিলে সরিষা অথবা ক্যানোলা বা ভেজিটেবল তেল গরম করে পেঁয়াজ কুচি, রসুন কুচি, পরিমাণ মতো লবণ, সামান্য পরিমাণ হলুদ, পরিমাণ মতো আস্ত জিরা, অর্ধেক চা চামচ পরিমাণ মরিচের গুঁড়া দিয়ে কষে নিয়ে কামরাঙা দিয়ে নাড়াচাড়া করে একটু গরম পানি দিয়ে ঢাকা দিয়ে মাঝারি আঁচে ১০ মিনিট রাখি। এবার ভেজে রাখা মাছগুলো কামরাঙার ওপর বসিয়ে তিনটি কাঁচা মরিচ মুখের দিকে সামান্য ফেড়ে দিয়ে সামান্য গরম পানি দিয়ে ঢেকে রাখি। ঝোলটুকু শুকিয়ে মাখো মাখো হয়ে এলে আঁচ কমিয়ে তিন মিনিট রেখে নামিয়ে অল্প ধনেপাতা কুচি ছড়িয়ে ডিশে পরিবেশন করি।

‘আলু ঘাঁটি’

ভাতের সঙ্গে তরকারি হিসেবে খেতে প্রথমেই যে অনন্য স্বাদের ও মজাদার ব্যঞ্জনের কথা বলব, তার আঞ্চলিক নাম গরুর মাংস দিয়ে ‘আলু ঘাঁটি’।

অল্প চর্বিযুক্ত গরুর মাংস ও আলুর ঘন্ট এই অঞ্চলের একান্ত নিজস্ব, অত্যন্ত সুস্বাদু এক খাবার, যা ভাতের সঙ্গে ব্যঞ্জন হিসেবে খাওয়া হয়। শোল মাছ বা রুই মাছের মাথা, লেজ ও মাছের টুকরো দিয়েও আলু ঘাঁটি করা হয়ে থাকে। রান্না শেষ হয়ে আসার আগে একটু সস পাতা (বগুড়ায় বলে শলুক পাতা, এসব দেশে এর নাম ডিল) ছড়িয়ে দেওয়া হয়, মাছ আলু ঘাঁটির স্বাদ–গন্ধই বদলে যায়!

প্রণালি: গরুর মাংস দিয়ে আলু ঘাঁটি রান্নার জন্য বড় হল্যান্ড আলু (বগুড়ার লাল আঠালো হাগড়াই আলু হলে ভালো হয়, সে ক্ষেত্রে আলু বেশি নিতে হবে) ছয়টি আধা সিদ্ধের চেয়ে কিছুটা বেশি সিদ্ধ করে তুলে একটি বড় মাপের বাটি বা গামলায় রেখে খোসা ছাড়িয়ে নেব। এবার আলুগুলোকে হাতের চাপে ভেঙে চটকে নেব।

টুকরো করে কাটা এক কেজি ২৫০ গ্রাম হাড়সহ অল্প চর্বিযুক্ত গরুর মাংস ধুয়ে পানি ঝরিয়ে রেখে দিই। প্যানে পরিমাণ মতো সরিষা, সয়াবিন বা ক্যানোলা তেল গরম করে তাতে গোটা তিন মাঝারি আকারের পেঁয়াজ কুচি (শ্যালট পেঁয়াজ হলে ভালো হয়) ভেজে গাঢ় বাদামি রঙের মচমচে বেরেস্তা করে রেখে দেব।

এবার রান্নার পাতিলে মাংস কষানোর জন্য পাতিলে তেল গরম করে পরিমাণ মতো পেঁয়াজ কুচি, আদা রসুন বাটা, হলুদ-মরিচ-ধনে-জিরার গুঁড়ো, চারটি ছোট এলাচি, দারুচিনি, দু/তিনটি তেজপাতা এবং পরিমাণ মতো লবণ দিয়ে মসলাগুলো নেড়েচেড়ে, ঢাকা দিয়ে রেখে একটু পরে নেড়ে সামান্য গরম পানি দিয়ে মসলা কষিয়ে নিই। এবার কেটে ধুয়ে রাখা মাংস মিশিয়ে বেশ খানিকক্ষণ কষিয়ে দু কাপ পানি দিয়ে ঢেকে রাখব। মাংস সিদ্ধ হয়ে আসার পর, চটকে রাখা আলুর মণ্ড মিশিয়ে নাড়া দিয়ে ঢেকে রাখি। ঝোল ঘন হয়ে মাখো মাখো হয়ে এলে গোটা চারেক কাঁচা মরিচ ও ভেজে গুঁড়ো করে রাখা জিরা ওপরে পরিমাণ মতো ছড়িয়ে নেড়ে দিয়ে কিছুক্ষণ অল্প আঁচে রেখে দিই। নামিয়ে পরিবেশন ডিশে নিয়ে পেঁয়াজ বেরেস্তা ছড়িয়ে পছন্দ অনুসারে ডেকোরেটিভ করে নিই। গরম ভাতের সঙ্গে এই আলু-গোশতের ঘাঁটি সত্যিই অমৃত।

পিঠা পুলি

ডেজার্ট হিসেবে বগুড়ার দইয়ের জুড়ি মেলা ভার। তবে বগুড়ার দই তৈরির প্রক্রিয়া বাসায় করা সম্ভব নয়। বাসায় দই বসাতে কম–বেশি সবাই পারেন বিধায় আমি আপনাদের বলব খুব সহজ ও উপযোগী এবং মজার এক পিঠ তৈরির কথা। এটি বাংলাদেশের সব এলাকাতেই হয়। নারকেলের পুলি পিঠা। তবে আমি এটি বেছে নিচ্ছি দক্ষিণ ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, ফিলিপাইন ইত্যাদি অঞ্চলে স্ন্যাক্স হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয় এমপানাডা থেকে। এটি পুলি পিঠার সমগোত্রীয় জ্ঞাতি ভাই। পার্থক্য এই—ওদের এমপানাডা শতাধিক রকমের হয়। কিছুই না, ভেতরের পুরোটা কেবল বদলে দেওয়া। এভাবেই নারকেলের পুলি হয়ে যায়—বিফ এমপানাডা, শ্রিম্প এমপানাডা, কোকোনাট এমপানাডা, ভেজিটেবল এমপানাডা ইত্যাদি। আমরাও সহজেই এগুলো তৈরি করে খেতে পারি।

প্রণালি: বাজারে প্যাকেটজাত কোরানো নারকেল পাওয়া যায়। পানি ফুটিয়ে খেজুরের গুড় মিশিয়ে (চাইলে সঙ্গে চিনিও দিতে পারেন) জাল দিয়ে ঘন সিরাপ তৈরি করে কোরানো নারকেল দিয়ে কিছুক্ষণ জাল দিয়ে শুকনো আঠালো মণ্ড বানিয়ে রাখি। এবার আরেকটি পাতিলে পানিতে সামান্য লবণ দিয়ে ফুটিয়ে পরিমাণ মতো চালের গুঁড়া দিয়ে নাড়তে নাড়তে কাঁই বানাই। এবার এই চালের গুড়োর কাঁই থেকে গুটি কেটে রাখি। হাতের চেটোয় গুটিগুলো গোল ছোট রুটি বানিয়ে মাঝখানে নারকেল গুড়ের মণ্ড থেকে পরিমাণ মতো নিয়ে পুর বসিয়ে গোল রুটির দুই প্রান্ত একত্রে মিশিয়ে মুখ বন্ধ করে রেখে দিই। এভাবে বানিয়ে স্টিম করতে দিই। হয়ে গেলে গরম-গরম পরিবেশন করি। রেখে দিয়েও পরে ইচ্ছেমতো মাইক্রোওয়েভ ওভেনে গরম করে খাওয়া যেতে পারে। খেজুরের গুড়ের গন্ধে ম ম করবে। অসম্ভব মজার এই পুলি। স্টিম করার বদলে ডুবো তেলে ভেজেও খাওয়া যেতে পারে। স্প্যানিশ এমপানাডা ডিপ ফ্রায়েড করেই খাই। মজা কিন্তু কমে না! এমপানাডায় চিজ ব্যবহার করা হয়। আপনারা চাইলে চিজ দিতেও পারেন।

ছোট চিংড়ির (ইঁচা মাছ) সঙ্গে কচুর মুখীর চচ্চড়ি

বগুড়ায় গরম ভাতের সঙ্গে ব্যঞ্জন হিসেবে ভীষণ জনপ্রিয় ও সুস্বাদু আরেকটি ছোট মাছের চচ্চড়ি (পুরোপুরি) এটি। খুব সহজে ও কম সময়ে এই পদ রান্না করা যায়।

প্রণালী: কচুর মুখীর সঙ্গে ইঁচা মাছের চচ্চড়ি রান্নার খুব সহজ উপায় হচ্ছে চিংড়ির (ইঁচা) খোসা (শেল) ছাড়িয়ে এবং ভেতরের কালো সুতোর মতো শিরা বের করে ভালো করে ধুয়ে নিই।

উপকরণ: খোসা ছাড়িয়ে চাকা চাকা করে কেটে ধুয়ে রাখা কচুর মুখীকে পাতিলে নিয়ে পরিমাণমতো তেল (খাঁটি সরিষার তেলে ভালো ঘ্রাণ ও বেশি স্বাদু হবে), লবণ, কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ কুচি, কাটা রসুন ও আস্ত জিরা পরিমাণমতো নিয়ে ভালো করে মিশিয়ে দেড় কাপ গরম পানি দিয়ে নেড়েচেড়ে মাঝারি আঁচে বসিয়ে ২০ মিনিট পরে ঝোল শুকিয়ে গেলে ধনে পাতা কুচি ছড়িয়ে নামিয়ে ফেলি।

(আমি রান্না করি ভিন্ন উপায়ে। কেটে ধুয়ে রাখা কচুর মুখী পানিতে ভাঁপিয়ে নিন। পানি ঝরিয়ে রেখে দিন। রান্নার পাতিলে সরিষার তেলে একটু বেশি পরিমাণে পেঁয়াজ কুচি, কাটা রসুন, আস্ত জিরা, পরিমাণমতো লবণ, আধা চা চামচ মরিচের গুঁড়ো দিয়ে কষিয়ে নিন। এবার চিংড়ি মাছ দিয়ে নেড়েচেড়ে রেখে দিই। একটু পর আবার নেড়ে একটু পানি দিয়ে ঢেকে রাখুন। খানিক পর ভাঁপিয়ে রাখা কচুর মুখী দিন। ঢেকে ১০ মিনিট অল্প আঁচে রাখুন। কয়েকটি কাঁচা মরিচ ও অল্প পরিমাণ ধনে পাতা ছড়িয়ে একটু পরে নামিয়ে পরিবেশন করুন ভাতের সঙ্গে। অনেক দিন মনে থাকবে এর স্বাদ!)