মহামারিতে প্রিয়তমার কাছে চিঠি
প্রিয়তমা, পৃথিবীর মানুষ আজ কেউ ভালো নেই! কীভাবে জিজ্ঞাসা করি, তুমি কেমন আছ? এ মহামারিতে তোমাকে ভালোমন্দ জিজ্ঞাসা করা মানে স্বার্থপরতা। আমি চাই পৃথিবীর সব মানুষ সুস্থ ও সুন্দর জীবন যাপন করুক সব সময়। আমরা সবাই মানুষ। মানুষ জন্ম হোক আমাদের আসল পরিচয়। জাতিভেদ, বর্ণবৈষম্যের অন্ধকার ঘুচে গিয়ে জেগে উঠুক শান্তিময় বন্ধুত্বপূর্ণ পৃথিবী।
কোভিড-১৯ মহামারিতে বিশ্বের সব ডাক্তার, নার্স, সাংবাদিক এবং স্বেচ্ছাসেবীদের মানবিকতা কখনো ভুলে যাওয়ার নয়। তারা আমাদের বাস্তব জীবনের নায়ক। তাদের মানবিকতা বেঁচে থাকুক যুগ যুগান্তর।
দুঃসময়ে আমার মনের কথাগুলো তোমাকে জানাতে এই চিঠির আত্মপ্রকাশ। বর্তমান সময়ে মানুষ চিঠি লিখতে ভুলেই গিয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি গিলে খেয়েছে মানুষের চিঠি লেখার মনোভাব। ডাকঘরগুলো কালের সাক্ষী। ডাকঘরে প্রেরকের উপস্থিতি খুব কমই দেখায় যায়। কোথাও কোথাও লতাপাতা এবং মরিচায় ডাকবাক্সের আসল সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া যায় না।
প্রিয়তমা, বলতে পারো সময় কেন এত দ্রুত পার হয়ে যায়? বর্তমানকে গ্রাস করতে কেন এত জোরালোভাবে এগিয়ে আসে আগামী? মনের ভূখণ্ডে শৈশবের স্মৃতি এসে জ্বালিয়ে দেয় সুখানুভূতি? একটি চিঠির অপেক্ষায় মানুষের দিন, মাস এমনকি বছরও পার হয়ে যেত। আর এখন সেকেন্ডের মধ্যে সবকিছু আদান–প্রদান হয়ে যায়।
পৃথিবী আধুনিক হয়েছে বহু গুণ। কিন্তু, কমে গেছে চিঠির প্রতীক্ষায় মানুষের সেই আকর্ষণ বোধ। ডাকপিয়নের জন্য কেউ আর পথ চেয়ে থাকে না। তবে প্রাগৈতিহাসিক যুগে পাথরে, দেয়ালে এবং চামড়ায় লেখা হতো চিঠি। সেই সব চিঠি আজ ইতিহাস।
প্রিয়তমা, এ আধুনিক যুগে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে মনের আয়নায় শুধুই তোমার মুখচ্ছবি ভেসে ওঠে। ধীরে ধীরে তুমি আমার হৃদয়ের মধ্যে এতটা মজবুত স্থায়ী বসত গড়েছ বুঝতে পারিনি। এই বন্দিজীবনে আমি খুব একা হয়ে গেছি, খুব একা! দীর্ঘ বন্দিজীবনে আমি জনমানবশূন্য একটি দ্বীপে বসবাস করছি। মনে হয়, এই দ্বীপের সীমানায় আমি ছাড়া আর কেউ নেই। উঁচুনিচু দালানগুলো প্রাকৃতিক নিদর্শন স্বরূপ যুগ যুগ ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
দ্বীপটি ভুতুড়ে দ্বীপে পরিণত হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারি এই ছোট্ট দ্বীপের সুশীল পরিবেশে বিষাক্ত বাতাস ছড়িয়ে দিয়েছে। অপশক্তির আঘাতে মৃত্যু হয়েছে অনেক মানুষের। মানুষের চোখের পাতার স্বপ্ন হারিয়ে গেছে। কোথাও আর তেমন কোনো প্রাণ খুঁজে পাই না। সব যেন মৃত লাশ। ভবিষ্যৎ নিয়ে কারোর কোনো চিন্তা নেই, চেতনা নেই। চারদিকে শুধুই হাহাকার। এই পৃথিবীতে আসলে কেউ কারোর নয়। আমরা শূন্যের ওপর ভেসে থাকা ফানুস।
তোমাকে প্রতিমুহূর্ত স্মরণ করি প্রিয়তমা। আমার জন্য তুমি অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছ। তোমার সুন্দর সময় বিসর্জন দিয়েছ। গোপনে কেঁদে কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছ অনেক...। ভালোবাসা মানুষকে এতটাই অন্ধবিশ্বাসী করে দেয়, সেটা তোমার ত্যাগী দিনগুলোর হিসাব কষলে বোঝা যায়। তোমার কাছে আমি ঋণী হয়ে গেলাম। আমৃত্যু ঋণী। তোমার সুন্দর সময় নষ্ট করার অপরাধে আমি নীরবে পুড়ছি দাবানলের মতো।
প্রিয়তমা, তোমার ভালোবাসার পরশ পাওয়ার আশায় তীর্থের কাকের মতো প্রতীক্ষায় থাকি প্রতিক্ষণ। তোমাকে নিয়ে আমি রঙিন জীবনের সুখ দেখতে পেয়েছি। আমি সেই সুখের ভেলায় অহর্নিশ ভাসতে চাই।
তুমি বিশ্বাস করো, আমি আজন্মকাল ভালোবাসার ভীষণ কাঙাল। আমার হৃদয়ের সব ভালোবাসা তোমার জন্য। আমিও জেনে গেছি আমার জন্য তোমার মনে গোপনে সীমাহীন টান। তোমার ভালোবাসার শিকলে শক্তভাবে আমার হৃদয় বেঁধেছি।
কোভিড-১৯ আমাদের জীবন তছনছ করে দিয়েছে। যখন সুন্দর জীবনের আশায় স্বপ্ন গড়ি, তখন আবার সামনে এসে দাঁড়ায় কোভিড-১৯–এর ভয়াবহতা। বহু মানুষের হৃদয়ের পরিকল্পনা পুড়ে পুড়ে ছাই হয়েছে। আমরা এখন বুকে সাহস রেখে বেঁচে থাকার চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন দেখার ভিত্তি তৈরি করা ছাড়া আর কীই–বা করতে পারি।
আমি দীর্ঘদিন বাঁচতে চাই, প্রিয়তমা। তোমার পাশে দাঁড়িয়ে পূর্ণিমা রাতে তোমার নিরেট ছায়া দেখতে চাই। তোমার মসৃণ কপালের মধ্যখানে চাঁদের টিপ পরিয়ে দিয়ে ইতিহাসে আমি হবো শ্রেষ্ঠ প্রেমিক। স্বপ্ন মানুষকে বেঁচে থাকার প্রেরণা দেয়। তুমি পাশে থাকলে আমার অগোছালো জীবনটা হয়ে ওঠে পরিপাটি। সতেজতায় ভরে ওঠে চারপাশ। ফুলের সুগন্ধিতে প্রফুল্ল হয়ে ওঠে আমার মনের বাগান।
প্রিয়তমা, দীর্ঘদিনের দূরত্ব একে অপরকে না দেখলে এত বেশি শূন্যতা অনুভূত হয়, সেটা আমার কখনো জানা ছিল না। তোমার আমার ভালোবাসা অনন্ত, অক্ষয়। তোমার কোলে মাথা রেখে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করতে চাই। আমার এই ছোট্ট দাবি তুমি ফিরিয়ে দিয়ো না।
বিশ্ববাসী আজ বাঁচার জন্য গৃহবন্দী হয়ে নীরবে চিৎকার করছে। মানুষের সঙ্গে বাতাসের সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। প্রতিমুহূর্ত নিশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে যায়! আমরা সবাই বাতাসভরা বেলুনের মতো উড়ছি। বাতাস বেরিয়ে গেলে মাটিতেই খুঁজে নিতে হবে অস্তিত্ব। ক্ষণিকের জীবনে আমরা সবাই একা। তারপরও কিছু সময় ভালোবাসার জালে বন্দী হয়ে সংসারজীবন সাজাই।
প্রিয়তমা, তোমার এলোমেলো শাড়ি পরা দৃশ্য আমার চোখের সামনে বারবার ভেসে ওঠে। তুমি সবকিছুতে এতটা কাঁচা, ভেবে ভেবে আমি একাকী হাসি। কী অদ্ভুত! এলোমেলো কাজেও অনেক সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে। তোমার মসৃণ মুখাবয়বের দিকে তাকিয়ে বারবার আমার ভাগ্যকে সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠ উপহার ভেবে গর্ববোধ করি। প্রিয় মানুষের এলোমেলো কাজের ভেতর এতটা সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে তোমাকে না দেখলে সেটা বুঝতেই পারতাম না।
কোভিড-১৯ আমাদের ভালোবাসাকে হত্যা করেছে কিছুকাল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তোমার কপালের বাঁকা টিপ সোজা করার দৃশ্য দেখতে ইচ্ছা হয় খুব। তুমি যেভাবেই সাজগোজ করো, সেভাবেই সুন্দরের আভা উঁকি দেয়। তোমাকে এলোমেলো ভাবে দেখে দারুণ তৃষ্ণা মেটে আমার। তুমি নাহয় এলোমেলোই থেকো সব সময়। আজ থেকে তোমার নাম এলোমেলো পাগলি।
প্রিয়তমার সঙ্গে আমার বহু এসএমএস আদান–প্রদান হয়। আমরা দুজনে অনেক কথা লিখি মনের মাধুরী মিশিয়ে। সাহস জোগানো কথাগুলো পড়ে আমার প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসে। বারবার মন প্রিয়তমার কাছে ছুটে যেতে চায়। দূর প্রবাসের বন্দিজীবন আর ভালো লাগে না। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছি প্রতিটা সেকেন্ডে।
তবে, আমি ফিরে আসব প্রিয়তমা। সারাক্ষণ মুক্ত হাওয়া, পাখির কূজন, প্রকৃতির নিবিড় আলিঙ্গন আমাকে ডাকে। উদাম পায়ে শিশিরভেজা সকালে আমরা দুজন দূর্বাঘাসের ওপর হাঁটব। অথবা আমাদের ব্যস্ত শহরে চলন্ত রিকশায় বসে নানান রকম মানুষ দেখব। মাঝেমধ্যে গালগল্পে হাসতে হাসতে একে অপরের গায়ে ঢলে পড়ব। তোমার ডান হাত আমার বাঁ হাতে তালুবন্দী রেখে পৃথিবীর শক্ত প্রেমিকযুগলের ইতিহাস রচনা করব।
প্রিয়তমা, এক মুহূর্ত আমাকে মনে না পরলে পৃথিবীতে কি যেন নেই মনে হয় তোমার? অথবা মন নেই, আবেগ নেই, ভালোবাসা নেই, শুধুই যন্ত্রণাময় একটি পাথরের পৃথিবী মনে হয় তোমার? যদি, মনে শূন্যতা অনুভব করো, তবে সেটাই হলো ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা অমর। তোমাকে না দেখে আমি একাকী শূন্য হৃদয়ে মরুভূমিতে বসবাস করি।
প্রিয়তমা, চিরন্তন রাতের তারা সাক্ষী রেখে বলছি; বেঁচে আমি ফিরবই। তুমি রান্না করা শিখে নিয়ো। প্রিয় ব্যক্তিকে নিজ হাতে রান্না করে খাওয়ানোই অনেক আনন্দ। তুমি কি এখন শাড়ি পরতে পারো? তোমার জন্য আমি ইউটিউব দেখে শাড়ি পরা শিখেছি। তোমাকে নিজের হাতে শাড়ি পরিয়ে দেব। কপালের বাঁকা টিপ সোজা করে দেব। আমার বিশ্বাসী হাতে তোমার হাত রেখো। এই হাত দুর্দিনে ভালোবাসা দিয়ে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরতে জানে। কখনো ছলনা জানে না।
পৃথিবীতে বারবার অন্ধকার সময় আসবে। কখনো ভিতু হবে না। অন্ধকার ভেদ করে আলোর দিকে অগ্রসর হওয়ার আত্মপ্রত্যয় জাগ্রত করবে। তারপর দেখবে তোমার চারপাশে জেগে উঠেছে উজ্জ্বলতা। তুমি আমার কাছে সাজানো পরিপাটি জীবন চেয়েছ। আমি ফিরে এসে তোমাকে নিয়ে সেই সুখের জীবন সাজাব।
সময়ের কাছে পরাজয়ে আমার মৃত্যু হলে; করোনাকালে লেখা আমার এই চিঠি একদিন হয়তো ইতিহাস হবে। সেই ইতিহাসে আমাদের ভালোবাসা অমর হয়ে থাকবে। চিঠিটি যত্নে রেখো প্রিয়তমা। আমৃত্যু তোমার ডান পাশে দাঁড়ানোর জায়গাটুকু আমার জন্য রেখো। তোমার ভালোবাসার বিশ্বস্ততায় মারণাস্ত্রের সামনে যেকোনো সময় বুকভরা সাহস নিয়ে দাঁড়াতে প্রস্তুত।
পরিশেষে, আমি প্রবাস থেকে বলছি, তোমার অনামিকা ধরার অধিকার সঞ্চয় করা একান্ত প্রেমিক পুরুষ।