মনের আয়নায় জীবন

চলতে চলতে জীবন থেমে যায়। টানাহেঁচড়া করে চালিয়ে নিতে হয়। ঠিক এখানকার স্রোতে স্থবির হওয়া জীবনের মতো। ফ্রাস্টেশনের ভুক্তভোগী অনেককে স্বেচ্ছায় খাঁচায় নয়, অনিচ্ছায় ঢুকতে হয় এর রাহুগ্রাসে। চাইলেও মুক্তি নেই। অফুরন্ত প্রাচুর্য থাকলেও ভালোবাসার পূর্ণতা বা স্বাদ গ্রহণ করার সৌভাগ্য হয় কয়জনের। আমরা কি নিজের বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি যে, আমরা সেই ব্যক্তি যে পরিপূর্ণ সুখী। হয়তো কেউ না আমরা জীবনের হিসাব কষি যখন দেখি হিসাবে গরমিল হচ্ছে। তখন আমাদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। আমরা পৃথিবী নামক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে চলে যাই। সব ওলট পালট হয়ে যায়। কিছু ভালো লাগে না, কিন্তু কেন! কারণ আমরা জীবনে যা চাই তা পাই না। পেলেও ভুল করে পাই অথবা আমরা কখনো নিচের দিকে তাকাই না এবং তাঁদের অবস্থা দেখে বলি না, আলহামদুলিল্লাহ, আমিতো ভালোই আছি।
ঘুমের ঘোরে স্বপ্নের মধ্যে রাতে দেখা আর বাস্তবে তুষারশুভ্র পরি রূপে তোমার সকালের আগমন আমার চোখকে বিশ্বাস করাতে পারিনি। চোখ দুটো রগড়াতে রগড়াতে যখন তোমাকে দেখলাম, আমার খুশি দেখে কে! সূর্যকন্যা সিনেমার সেই নায়কের মতো। তোমাকে তো একটা নাম ধরে ডাকতে হবে। বলো তো কি নাম দেওয়া যায় তোমায়? থাক নামটা না হয় তোমার আর আমার মধ্যে গোপন রয়ে গেল। আচ্ছা তোমার আগমন ত্বরিত এবং প্রস্থান এত তাড়াতাড়ি হয় কেন? তুমি কি লজ্জাবতী যে মরমে মরে যাও। ভাবো এই বুঝি কেউ আমার সঙ্গে তোমার গোপন অভিসার ধরে ফেলল ভয় পেয়ো না। আরেকটু বসো আমি তোমার কোনো ক্ষতি হতে দেব না প্রতিজ্ঞা করছি। তোমার জন্ম কোথায়, মৃত্যুই বা কবে হবে কিছুই জানি না। কিন্তু একটা জিনিস আমি খুব ভালোভাবে বুঝেছি তোমার রূপের কোনো জুড়ি নেই। সেটা দেখে ছুঁয়ে জহুরির মতো বুঝে নিয়েছি। আচ্ছা বলতো প্রশান্ত মহাসাগর আর তোমার মধ্যে সম্পর্ক কী আমাকে বলবে কি? ক্যালিফোর্নিয়ায় ওকে আমি ঠিকই ঠকিয়েছি কিন্তু তুমি আমাকে ভালোবেসেছো, আমার দ্বারে এসেছ অতিথিকে কি ঠকানো যায়?
সেদিন স্নো ঝরছিল অঝোর ঝরে কাক ডাকা প্রভাত থেকে। তার নব আগমনে আমার অন্তর নৈবেদ্য!
জানুয়ারির প্রচণ্ড শীত সঙ্গে স্নো। প্রাণ হাঁপিয়ে উঠল। ব্যবসা ভালো না। ভাবছি tropical weather Miami Beach থেকে ঘুরে আসলে মন্দ হয় না। যে চিন্তা সেই কাজ, Frontier Airline-এ winter sale চলছিল। নিউইয়র্ক-মিয়ামি। আমায় পায় কে। সঙ্গে সঙ্গে টিকিট কেটে ফেললাম। ৩১ জানুয়ারি ১২টা ৩০ মিনিটের ফ্লাইট ধরলাম। ১৫টা ৪৫ মিনিটে মিয়ামি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমানের চাকা মাটির সঙ্গে গা মেলাল। একটিমাত্র হ্যান্ডব্যাগ থাকায় সরাসরি গেট দিয়ে বের হয়ে এলাম। তাপমাত্রা ৯২ ডিগ্রি ফারেনহাইট। যে গরম বোধ হচ্ছে কোট খুলে টি শার্ট পরে উবারে চড়লাম হোটেলের উদ্দেশে। রাস্তার দুই পাশে নারিকেল আর পাম গাছের সমারোহ। ঝিরঝির বাতাস। আমি জানালা নিচে নামিয়ে প্রাণভরে উচ্ছল হাওয়ার স্বাদ টানতে লাগলাম। ফুরফুরে মনে রবীন্দ্রসংগীতের ‘পাগলা হাওয়া’ গানের কলি বের হয়ে আসতে চাচ্ছিল। স্প্যানিশ ড্রাইভার আবার মাইন্ড করে কিনা এই ভেবে আর গুনগুন করে গাওয়া হলো না। চালক হোটেলের গাড়ি বারান্দায় আমায় নামিয়ে দিল। রিসেপশন থেকে চাবি নিয়ে রুমে ঢুকলাম।

সুন্দর হিলটনের রুম। কুইন সাইজ বেড। উইন্ডো কারটেন সরালে আটলান্টিক মহাসাগরের গর্জন শোনা যায়। যখনই আমি বিচে যাই সব সময় বিচ ফ্রন্ট রুম চাই যাতে সাগরের বিশালতা ও গভীরতা উপলব্ধি করা যায়। পৃথিবীর তিন ভাগ জল, এক ভাগ স্থল। সাগরের নীল পানি না দেখলে তা বোঝা যায় না। আমি শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়ে একটা লম্বা ঘুম দিলাম। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত দশটা। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। আমি কলিন্স স্ট্রিট ধরে হাঁটতে লাগলাম হালাল খাবারের সন্ধানে। পেলাম না। অগত্যা সাবওয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। জ্যামাইকান নারী এডেল কাউন্টারে দাঁড়ানো। আলাপে জানলাম। আমি মুসলিম বলায় এডেল আমায় mixed veggies sandwich বানিয়ে ছুড়িটা ধুয়ে কেটে দিল। আমি পেটভরে খেলাম। খাবারের দাম নিউইয়র্কের চেয়ে অনেক বেশি, কাউন্টারে পয়সা দিতে গিয়ে বোঝা গেল।
রুমে এসে আমি ঘুমের জন্য আয় ঘুম আয়, ছোটকালে মা আমার জন্য ডাকতেন, অনুকরণে ফিসফিস করে ডাকতে লাগলাম। সকাল নয়টার ফ্রি ব্রেকফাস্ট ধরলাম। পেটপুরে খেয়ে নিলাম। বিচে এলাম। আজ সারা দিন এখানে কাটাব। বিচবেড ভাড়া করে সান লোশন মেখে চিৎ হয়ে শুয়ে রইলাম। গাঙচিলের কিচিরমিচির আওয়াজ আর সমুদ্রের গর্জনে আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন। আমার কল্পনায় তখন সাগরের অপর পাড় কিউবার হাভানা। কিউবার নেতা কাস্ত্রো কিছুদিন আগে মারা গেলেন। কী দুর্দান্ত প্রতাপে আমেরিকাকে পরোয়া না করে কিউবা শাসন করে গেলেন।
পাশের নারীর ডাকে উঠে বসলাম, আলাপ জমাতে চায়। নাম মারিয়া। পেরুর মেয়ে। ছুটিতে এসেছে মিয়ামি। আমি বাঙালি শুনে খুব খুশি। মারিয়া পেরুতে বাঙালির সঙ্গে কাজ করেছে। খুব ভালো ছিল জানাল। সে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। দুপুরে পাশের লাবামবা স্প্যানিশ রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ সারলাম দুজনে। এ খাবারগুলো খুবই সুস্বাদু হয় ও কার্বোহাইড্রেট তত বেশি নেই। পোর্টওভেলো মাশরুম, সিফুড এনজেল পাস্তা ও কফি খেলাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। আমি ওকে নিয়ে টুরিস্ট শপিং স্পটে টুকিটাকি কেনাকাটা করলাম। রাতের খাবারের যাওয়ার আগে হাঁটতে হাঁটতে মারিয়া আমার এক হাত মুঠোবন্দী করে ফেলল। আমি শিহরণে কম্পিত। স্বল্প সময়ে আমাকে বাজিয়ে নিয়েছে আমি লোকটা মন্দ নই।
ডিনার শেষে মারিয়া আমায় অনেকটা জোর করে ওবারে ওর হোটেলে নিয়ে এল। সুন্দর রুম পরিপাটি। আমায় জিজ্ঞেস করল আমি ড্রিংক চাই কিনা। আমি সোডা নিলাম। সে মিউজিক ছাড়ল। বাইরে সমুদ্রের গর্জন। ভেতরে আমরা দুজন নরনারী। মারিয়ার পীত বর্ণের শরীর। সোনালি চুল। ওকে গ্রিক দেবীর মতো লাগছিল। ওর শরীর থেকে কোনো অজানা পারফিউমের ঘ্রাণ আসছিল। আমি ওর সমতল জমির ওপর বেড়ে ওঠা উঁচু পর্বত দুটো দেখতে লাগলাম। ওর তুলতুলে নরম দেহটা বিছানায় শায়িত। স্বর্গের অপ্সরার কল্পনার বাস্তব রূপ আমায় স্বাগত জানাতে চায়। ওর মুখাবয়ব ফ্যাকাশে। ঠোঁটের রং রক্তাভো হতে লাগল। ও কাঁপছে। পাশের টেবিলের ওপর রাখা কফিমেকার থেকে টিপটপ শব্দে কফির শেষ ফোঁটাগুলো কফি জারের মধ্যে পড়ার শব্দ আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করতে লাগল। আমি চরম তৃপ্তির স্বাদে সুখের হাসি হাসলাম! পাশের সমুদ্রের গর্জন যেন হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল মারিয়ার মধ্যে। এর প্রতিধ্বনির বাস্তব রূপ আমি যেন দেখতে পেলাম!

দ্বিতীয় দিন ট্যুর বাসে মারিয়াসহ মিয়ামি ঘুরলাম। লিটল হাভানা দেখার শখ আমার অনেক দিনের। সেদিন তা পূর্ণ হলো। ট্যুর গাইড আর মারিয়া স্প্যানিশ জানায় ইতিহাস ভালো বোঝা গেল। কীভাবে অল্প কয়েকজন তরুণ মিলে শক্তিশালী কাস্ত্রোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ঘুরে দেখলাম ঐতিহাসিক ওই জায়গা। খেলাম প্রসিদ্ধ আইসক্রিম ও ধুমপান করলাম হাভানা সিগার। আসার পথে বাস থামলে ফ্রিডম টাওয়ার ঘুরে দেখলাম। পরে নিয়ে গেল আমেরিকান এয়ারলাইনস এরিনাতে। যেখানে মিয়ামি হিট বাস্কেট বল খেলে। তারপর বিচে পড়ে রইলাম। সাগরের উথালপাতাল ঢেউ তীরে এসে উপচে পড়ছে। সাগরের বিশালত্বের মাঝে নিজের ছোট্ট জীবনের হিসাব মেলাতে লাগলাম। মারিয়ার কথায় বাস্তবে এলাম। ক্ষুধা পেয়েছে খেতে হবে না? পাস্তা আর সালাদ দিয়ে লাঞ্চ সারলাম। মারিয়া বাকি সময়টা আমার পাশেই রইল। হাসি খুশিতে ভরে রইল আমাদের দিনটি! সমুদ্রের পাশে থেকে খুব কাছে থেকে দেখলে ওর বিশালত্বের কাছে নিজের জমে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সমস্যাগুলো বুদ্বুদের মতো এমনিতেই মিলিয়ে যায়। এই যে অমোঘ ভালো লাগা, আমি তার নাম কি দেব, ভেবে কূল পাচ্ছি না।
পরদিন দুপুর ১২টায় আমার ফ্লাইট। আমি ১০টায় হোটেল ছাড়লাম। মারিয়ার মন খুব খারাপ। বিদায়ের প্রাক্কালে ও আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। আমায় আর ছাড়তে চায় না। মনের মিল হয়ে গেলে, একজন অপরকে ভালো লাগলে, ছাড়া কঠিন। এর জন্য ধনী–গরিবের প্রভেদ কোনো ব্যাপার নয়। দরকার ভালোবাসার জন্য সুন্দর দুটি মন। পথের বন্ধু পথেই বিদায়...। আমি নিউইয়র্ক ফিরে এলাম পুরোনো সেই একঘেয়েমির জীবনে। মারিয়ার কথা মাঝে মাঝে মনে হয়। ওর ফোন নম্বরের কার্ডটা মাঝে মাঝে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখি। কখনো ফোন করা হয়ে ওঠে না। ভাবি করে কী হবে! কী আর করা চলার নাম জীবন, চলছি...!