ভোগে নয় ত্যাগেই আনন্দ
ঐতিহ্য, প্রাচুর্য, বিবেকহীনতা, বর্বরতা, অহংকার এবং প্রতিযোগিতারও ইতিহাস আছে মানবসভ্যতায়। ইতিহাস আছে যুদ্ধের। মানুষে মানুষে যুদ্ধের, জাতিতে জাতিতে, দেশে দেশে। ইতিহাসে অনেক যুদ্ধ আছে রেকর্ড রাখা শুরু করার পরের ও আগের। কোনো কোনো যুদ্ধ হয়তো পরিহার করা সম্ভব ছিল না (যদিও আমি বিশ্বাস করি না। আমার মতে, যেকোনো যুদ্ধই পরিহার করা সম্ভব !)।
আবার ইতিহাস আছে মানবতার, মানবিকতার। ইতিহাস আছে প্রাচীনতার আর যান্ত্রিক সভ্যতার। এই ইতিহাসগুলো আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে রেখে যাই। ইতিহাস লিপিবদ্ধ করাও থাকে আবার আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করে পরবর্তী জেনারেশনকে শিক্ষা দিয়ে থাকি। সভ্যতার সম্মিলিত প্রচেষ্টার কারণে আমরা মানুষ।
স্কুল বা সমাজের যেকোনো শিশুকে নিয়ে যান এবং আপনি দেখতে পাবেন আমরা জীবনে যে জ্ঞান অর্জন করি, তা অন্য মনুষ্যদের কাছ থেকে আসে। যিনি এটি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন তিনি এটি যোগ করেছেন, অবদান রেখেছেন, রেকর্ড করেছেন, ভবিষ্যতের প্রজন্মের কাছে বিতরণ করেছেন। কোনো প্রাণীই এই সত্যের সঙ্গে মেলে না। আমরা আন্তসংযোগের পণ্য। অন্যান্য প্রাণী, এমনকি উন্নত প্রজাতি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা না দিয়েই প্রজন্মের মধ্যে বেঁচে থাকে এবং মারা যায়। মানুষ এবং অন্য প্রাণীদের মধ্যে এটি অন্যতম বড় পার্থক্য। তো মানুষের ইতিহাসই শুধু সুখেরই ইতিহাস নয়। প্রতিনিয়ত পৃথিবীতে যা ঘটছে, তা তো আর লেখা হচ্ছে না। ইতিহাস হতে হলে রিমার্কেবল কিছু ঘটতে হয়। যা অন্যান্য ঘটনা থেকে হবে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ, অসাধারণ, লক্ষণীয় প্রভৃতি। দুই দুইটি বিশ্বযুদ্ধ যেমন ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে, তেমনি যান্ত্রিক সভ্যতার অগ্রগতিও ইতিহাসে স্থান পেয়েছে (যান্ত্রিক সভ্যতা বলতে বোঝাতে চেয়েছি, যা পৃথিবীটাকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে)। এবং এ থেকে শিক্ষণীয় হলো, কীভাবে কেয়ামতের দিন আমলনামায় পুরো জীবনের কর্ম দেখা সম্ভব; তার একটি নমুনা দুনিয়ায়ই বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় এখন দেখা যায়।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত দেশগুলো তাদের জনগণের সঙ্গে কীভাবে ব্যবহার করছে, তা-ও সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে একটি স্থান পাবে। আমি যেখানে আছি সেই ব্রিটেনের কথাই ধরেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে প্লেন হায়ার করে বিভিন্ন দেশে আটক পড়া নিজের নাগরিকদের দেশে নিয়ে আসছে ওরা (তাদের মধ্যে অনেকেই দ্বৈত নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও)। রিমার্কেবল শুধু এ জন্যই নয়, আরও কারণ আছে। এখানে ২৬ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে ইতিমধ্যে। সরকার যখন এই দুর্যোগকালে এই সমস্যা নিয়েই হিমশিম খাচ্ছে, তখনো দেশের জনগণের কথা ভুলে যায়নি। তারা তাদের মানুষকে কখনো পেছনে ফেলে আসে না। তারা (ব্রিটিশরা) মানুষের সেবা করে এবং মানুষের জীবনের মূল্য দেয়। এ কারণেই আমরা যারা এথনিক মাইনরিটি এ দেশে, যারা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে জীবিকার জন্য এখানে এসেছিলাম এবং পরে এই দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছি, আমরাও এ দেশকে নিজের দেশ ভাবি এখন। ১০০% মাইগ্র্যান্ট, যাঁরা ব্রিটিশ সিটিজেনশিপ নিয়েছেন, তাঁরা ব্রিটেনের উন্নতির কথা চিন্তা করেন। এই যে আমাদের প্রতি এই রাষ্ট্রের অবদানের প্রতিদানস্বরূপ বলা চলে আমরা এই দেশকে নিজের দেশ হিসেবেই গ্রহণ করেছি। এই দেশের কথা চিন্তা করি, এই দেশের উন্নয়নের কথা চিন্তা করি, দেশের মানুষের কথা চিন্তা করি।
আপনি যদি দেখেন, এই দুর্যোগে আমরা যারা বহির্বিশ্ব থেকে এ দেশে এসেছি, জাতি-ধর্মনির্বিশেষে আমরা (মুসলিমরাও) তাদের মতোই হয়ে গেছি। ভালোবাসতে শিখেছি। মানবিক হয়েছি। হিউম্যানিটি বুঝি, হিউম্যান রাইটস বুঝি। এ দেশে ১০ শতাংশ এথনিক মাইনরিটি এই করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ফ্রন্ট লাইনে আছে। ১০ শতাংশ এথনিক মাইনরিটি চিকিৎসক-নার্স মারা গেছেন ফ্রন্ট লাইনে কাজ করতে গিয়ে। অথচ এ দেশে মাইনরিটি মাত্র ২ শতাংশ, সেদিক থেকে ২ শতাংশ চিকিৎসক নার্স অথবা ভলান্টিয়ার আমাদের মধ্য থেকে ফ্রন্ট লাইনে কাজ করার কথা! এই আত্মত্যাগ ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। এই স্যাক্রিফাইস ইতিহাসেও মূল্যায়িত হবে। আর এই অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ব্রিটিশ সেকেন্ড ইন লাইন প্রিন্স, প্রিন্স চার্লস আমাদের সাউথ-ইস্ট এশিয়ান বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিকদের ভূয়সী প্রশংসা করলেন। শুধু তা-ই নয়, আমাদের আত্মীয়স্বজন অথবা আমাদের অরজিনাল দেশগুলোতে (বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা) করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউনের কবলে পড়ে দরিদ্র হয়ে যাওয়া পরিবারের লোকজনের সাহায্যে ইতিমধ্যে তিনি (প্রিন্স চার্লস) একটি ট্রাস্টের মাধ্যমে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। আমাদের মানবিক কর্মকাণ্ডের কারণে আমাদের স্বজাতির লোকেরা শুধু প্রশংসিতই হচ্ছেন না, বরং প্রতিদান হিসেবে সাহায্যও পাচ্ছেন। এটিও একটিটি ইতিহাস।
এখন আসি ইতিহাসের অন্য পৃষ্ঠে
জন্মভূমির রিমার্কেবল ইতিহাস হলো রোহিঙ্গা মুসলিমদের আশ্রয় দেওয়ার, সাহায্য দেওয়ার ইতিহাস, উদারতার ইতিহাস। এ বিষয়ে এর আগেও লিখেছি। সম্প্রতি দেখলাম মালয়েশিয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীবাহী দুটি জাহাজ ফিরিয়ে দিয়েছে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে দেবে, এই ভয়ে। সাগরে দুই মাস অনাহারে থেকে অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছে। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ তাদের আবারও জাতিসংঘের অনুরোধে আশ্রয় দিয়েছে। এখানে মালয়েশিয়া একটি মুসলিম রাষ্ট্র আবার বাংলাদেশও মুসলিম রাষ্ট্র (মেজরিটি মানুষ মুসলিম অর্থে)। কিন্তু মালয়েশিয়া রাষ্ট্রের মানুষের প্রতি এই অমানুষিক ব্যবহারও ভবিষ্যতে মানুষ স্মরণ করবে, ইতিহাস হয়ে থাকবে। কোনো অবস্থায়ই এটা সুন্দর ইতিহাস নয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মোটেই শোভনীয় নয়, শিক্ষণীয় নয়।
যুদ্ধবিগ্রহের এক ইতিহাস যেমন পৃথিবীর ইতিহাসকে কলঙ্কিত করে রেখেছে, তেমনি মানবজীবনের ক্রান্তিকালে এই করোনাভাইরাসের আক্রমণে পৃথিবী যখন আপ্লুত, তখন ব্রিটেনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এই গ্লোবাল মহামারিতে যেভাবে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, তাও ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এখানে এই ইংল্যান্ডে মানুষ মারা যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। একজন সংক্রমিত করছে অন্যজনকে এবং সংক্রমিত হওয়া মানে মৃত্যুর রিস্ক জেনেও এখানে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে এগিয়ে আসছে।
স্বেচ্ছাসেবীর কাতারে লাখ লাখ মানুষের নাম। মানুষ মানুষকে ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি নিয়ে এগিয়ে আসছে। হাজার হাজার মানুষের নাম স্বেচ্ছাসেবীর কাতারে। আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি, হৃদয় নেড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে এগিয়ে আসছে মানুষ।
আমার জন্মভূমি বাংলাদেশে অন্য আরেক ইতিহাস দেখছি, যা মোটেই কাম্য নয়, সুন্দর নয়। জন্মভূমি বাংলাদেশ থেকে খবর আসছে, করোনাভাইরাসে মারা যাওয়া মানুষকে কেউ ভয়ে দাফন কাফন করছেন না। লাশ ফেলে পালাচ্ছেন। কেউ তাঁর বৃদ্ধ মাকে জঙ্গলে ফেলে আসছেন নিজে মরে যাবেন, এই ভয়ে। চিকিৎসক পরিবারের করোনা-আক্রান্তের বাড়িতে আক্রমণ। এসব বিষয় চরম স্বার্থপরতার নামান্তর। প্রিন্স চার্লস বাংলাদেশের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। আমরা এখানে নিজেরা ভিক্ষা উঠিয়ে দেশে সাহায্য পাঠাই। দূর থেকে স্বদেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি নিয়ে এগিয়ে আসি। কিন্তু এসব খবর অত্যন্ত অস্বাভাবিক ঠেকে। আমাদের পীড়া দেয়, মর্মাহত করে। বাংলাদেশে মানুষ মৃত্যুকে ভয় করে, অন্য দেশে নয় ।
আর যা বলেছিলাম, আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা, আমাদের কর্মকাণ্ড, আমাদের বর্তমান ইতিহাস যা রেখে যাচ্ছি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, তা যেকোনো কারণে রিমার্কেবল হয়ে যাচ্ছে, ইতিহাস হচ্ছে। আর এই যে মহামারিকে ভয় পেয়ে যেভাবে ভিকটিমের সঙ্গে (জীবিত অথবা মৃত ) আচরণ করছি, তা-ও কোনো অবস্থায়ই সুখকর নয়। নিশ্চয়ই আমরা এ রকম কিছু ইতিহাস রেখে যেতে চাই না। মৃত্যুকে ভয় করতেই হবে। কিন্তু মানবসভ্যতাকে, স্বাধীনতাকে, স্বধর্মকে, স্বজাতিকে অমর করে রাখতে মৃত্যুকে জয় করতে হবে। মৃত্যুর মধ্যেই রয়েছে জীবন। যেখানে আছি (ইংল্যান্ডে) তারা যদি মৃত্যুকে ভয় করত, তবে এত এত যুদ্ধ জয় করত না, এত এত দেশ জয় করতে পারত না। এখানে এই করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ করছে, তা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। যদিও আমি মানুষের এই প্রতিশ্রুতিকে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ মনে করি না। আমি মনে করি, এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নয়। আমরা রূপক অর্থে যুদ্ধ শব্দ ব্যবহার করি।
সৃষ্টির প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত যুগে যুগে মানুষ যে রিমার্কেবল কাজগুলো করে গেছে, সেগুলোর সূত্র ধরেই আজকের এই পৃথিবী। মানুষের রেখে যাওয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অবদানের সম্মিলিত যত্নপরতা, প্রয়াস, অধ্যবসায় মিলিয়েই আজকের একবিংশ শতাব্দীর ডিজিটাল বিশ্ব। মানুষ জন্মেছে সৃষ্টির জন্য! এ বিশ্বে যা কিছু কল্যাণকর, সবই বিধাতার ইচ্ছায় মানুষই সৃষ্টি করেছে। সৃষ্টি করেছে নিজের জন্য, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। নিজেরা খেয়েদেয়ে চলে গেলে বিজ্ঞানের এই জয়যাত্রা হতো না। জগতে অন্য যে প্রাণিকুল আছে, তারা নিজেদের খাবারই শুধু জোগাড় করে। মানুষের ধর্ম ভিন্ন, তারা যেমন প্রজননের ক্ষমতা ধারণ করে, তেমনি পরবর্তী প্রজন্মের টিকে থাকার জন্য কাজ করে যায়। মানুষ বেঁচে থাকে মানুষের মধ্যে। মানুষ মানুষের জন্য জীবন দেয়। স্বগোত্রের স্বাধীনতার জন্য কিছু মানুষ মরতে প্রস্তুত হয়। এভাবেই প্রকৃতভাবে মানুষ বেঁচে থাকে অন্যদের মধ্যে। ভোগে নয়, ত্যাগেই প্রকৃত আনন্দ।
*লেখক: ব্যারিস্টার