ভুল বিশ্বাস

ঘটক জমিলা খালা প্রতি মাসে কম করে হলেও দুটি করে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিসিএস ক্যাডার, ব্যাংকার সব ধরনের পাত্রই তাঁর কাছে আছে। সামনে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা। বাসায় বলেছি, অনার্স কমপ্লিট না করে কিছুতেই বিয়ে করছি না। যদিও এই ইচ্ছাটা আমার নয়, শিহাবের। জমিলা খালা যেকোনো প্রস্তাব এনেই আম্মুকে এমনভাবে চেপে ধরেন যে, এখনই বিয়ে না দিলে ভালো পাত্র হাতছাড়া হয়ে যাবে।

তৃতীয় বর্ষে থাকার সময় শিহাবের সঙ্গে ফেসবুকেই প্রথম পরিচয়। ওর লেখার হাত খুব ভালো। সব সময় মোটিভেশনাল বিষয় নিয়ে লেখে। তার যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে, তা হলো সে খুবই ধার্মিক। হালকা দাঁড়িতে চমৎকার লাগে শিহাবকে। আমরা যেদিন প্রথম দেখা করি, সেদিন আমার কাছে জানতে চেয়েছিল পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি কিনা। বলেছিলাম, রেগুলার না। সে আমাকে দিয়ে প্রমিজ করিয়েছিল, এখন থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে, আর হিজাব লাগিয়ে চলতে। সেই দিন থেকে আমার এক ওয়াক্ত নামাজও কাজা হয় না, আর হিজাব লাগাতে শুরু করি। যতই দরকারি কথা হোক আজান শোনার সঙ্গে সঙ্গেই সে ফোন রেখে দেয়। এই রকম প্রেমিক যার আছে, তাকে কী কারণে বিয়ে নিয়ে ভাবতে হবে!

বিয়ের প্রস্তাব আসছে দেখে শিহাবকে বহুবার বলেছি বাসায় একটা প্রস্তাব দিয়ে রাখতে। অথবা ওর আর আমার সম্পর্কের কথা বাসায় জানিয়ে রাখি, এতে শিহাব রাজি না। তাকে এ-ও বলেছি প্রস্তাব দেওয়ার পর আমি সব দেখব। শিহাবের এক কথা, আগে পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। আর এখন এই সব বাসায় জানালে খামোখা পরিবারের দুশ্চিন্তা বাড়বে। তমাকে নিয়ে নিজের পরিবার যতটা না ভাবে, শিহাব তার চেয়ে অনেক বেশি ভাবে।

সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু হঠাৎ করে কেন যেন শিহাব পাল্টাতে শুরু করল। যখনই তাকে বিয়ের কথা বলি উল্টো সে রেগে গিয়ে বলে, এখন তো আর আমাকে তোমার ভালো লাগবে না, তোমার জন্য কত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার পাত্র আসে। নাকি অন্য কোনো চক্কর চলছে তোমার? কথাগুলো শুনেই আমার কান্না চলে আসে। তার কথাগুলো যে আমাকে কতটা আঘাত করে সে কি বোঝে না। তাই সেদিন যখন আমার ফেসবুক পাসওয়ার্ড চাইল, দিয়ে দিলাম। তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরে মাফ চাইল। এ রকম আচরণ যতবার করে ততবারই মাফ চায়। আমি মাফ করে দিই। কারণ তাকে আমি মন থেকে ভালোবাসি।

তবে ছয় মাস ধরে ঘন ঘন জড়িয়ে ধরেই শেষ হয় না, আরও বেশি কিছু হয় আমাদের মধ্যে। অবশ্য প্রেমে এসব চাহিদা থাকবেই। আমার বান্ধবী লিজার প্রেমে তো ওই সব ডাল-ভাত। তবে লিজার সঙ্গে আমার পার্থক্য হচ্ছে, আমার কোনো কিছুই অবৈধ বা অধার্মিক উপায়ে নয়। আমরা হয়তো কাগজে কলমে বিয়ে করিনি কিন্তু আমাকে স্পর্শ করার আগে শিহাব ও আমি নিজেদের স্বামী-স্ত্রী রূপে গ্রহণ করি। এমনকি শিহাব তার কোনো বন্ধুর সঙ্গে যখন পরিচয় করিয়ে দেয়, তখন তার বউ বলেই পরিচয় করিয়ে দেয় আমাকে। দুনিয়ায় কেউ যদি ভুল বোঝে বুঝুক।

এত চেনা শিহাবকে দেখে সেদিনই আমি প্রথম ধাক্কাটা খাই, যেদিন আমি প্রেগন্যান্ট জানার পরও সে স্বাভাবিক ছিল, যেন কিছুই হয়নি। কী করে এত ধার্মিক হয়ে মুখের ওপর বলে দিতে পারল অ্যাবরশন করিয়ে নিতে, আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। এটা আমার প্রথম সন্তান, আর অবৈধ নয়, তবে কেন ফেলে দিতে হবে। তাই বাধ্য হয়ে আম্মুকে সব ঘটনা জানাতে হলো।

আম্মু আজ দুদিন ধরে খাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন। আব্বুও জেনেছেন ঘটনাটি। একমাত্র আব্বুই বুঝতে পেরেছেন আমাকে। তাই আব্বু নিজ থেকেই বললেন, যা হওয়ার হয়ে গেছে। পেছনে ফিরে তাকানোর সময় নেই। ছেলেকে বলো তার পরিবারের লোকজনকে সঙ্গে করে যেন প্রস্তাব নিয়ে আসে। আব্বুর কথা মনের মধ্যে আশার আলো জাগিয়েছিল। বুঝলাম আরও আগে চাইলেও এই সমস্যার সমাধান হতো। খুশিতে দৌড়ে গিয়ে শিহাবকে ফোন দিয়ে জানালাম, আম্মু-আব্বুকে তোমার কথা সব বলেছি। তাঁদের কোনো আপত্তি নেই। এখন তুমি তোমার পরিবারের লোকজনকে নিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিতে আসতে পারো নিশ্চিন্তে।

এই কথা শুনে সে আমাকে আমাকে ইংরেজিতে একটা বিশ্রী ভাষায় গালি দিল। আরও বলল, কোথা থেকে না কোথা থেকে নষ্টামি করে এসে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছ! আমি এই জারজের দায়িত্ব নেব না। অথচ সে তো ভালো করেই জানে, এই বাচ্চা তার।

আম্মু-আব্বুকে সব কথা না জানিয়ে উপায় ছিল না। কথাটি জেনেই আম্মু অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আব্বু ওই দিন বিকেলেই আমার শত বাধা উপেক্ষা করে গোপনে কোনো এক নার্সিং হোমে নিয়ে গিয়ে ডিএনসি করিয়ে আনলেন। আম্মু হাসপাতালে আমার দিকে চেয়ে কেঁদে যাচ্ছিলেন আর বারবার বলছিলেন—খোদা আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যাও, আমি আর বাঁচতে চাই না। কিন্তু আব্বু একেবারে চুপ, যেন কিছুই হয়নি। উল্টো আম্মুকে বারবার ধমক দিচ্ছেন, চুপ করো যা হওয়ার হয়ে গেছে, আগে কী করতে হবে তা নিয়ে ভাবো।

অনার্স পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশ পেয়েছে, সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছি। এর মধ্যে জমিলা খালা অনেক প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন, আম্মুর এক কথা দেশের বাইরে বিয়ে দেবেন মেয়েকে। জমিলা খালা অবাক! সেদিন পর্যন্ত আম্মু যেখানে বলেছেন, একমাত্র মেয়েকে চোখের আড়াল করতে চান না, আজ সেই আম্মুই বিদেশি পাত্রের কাছে বিয়ে দিতে প্রস্তুত। আমি জানি, আম্মু কেন এই ডিসিশন নিয়েছেন। আর খুব কম সময়ে আম্মু-আব্বু মিলে এই ডিসিশন নিয়েছেন। আম্মুর শরীর খারাপ এই বাহানায় আত্মীয়স্বজন কাউকে বলা হয়নি তেমন। কাছের কিছু মানুষজন নিয়ে রেস্টুরেন্টে এনগেজমেন্টের আয়োজন করা হয়েছে।

বিয়ে নিয়ে তমার অনেক স্বপ্ন ছিল। শিহাবের জায়গায় অন্য কোনো পুরুষকে কল্পনাও করতে পারছে না তমা। এনগেজমেন্টের রাতে রেস্টুরেন্ট থেকে বাসায় ফিরে তমার শুধু কান্না পাচ্ছিল। মনে হয়েছে, কোথাও কোনো ভুল হচ্ছে, শিহাবের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে হয়তো সব ভুল বোঝাবুঝির অবসান হবে। শিহাব একবার যদি ফোন দিয়ে আগের মতো মাফ চায়, তো এখনো সময় আছে, তমা সব ভুলে যাবে। কিন্তু শিহাব কী করে তার সঙ্গে যোগাযোগ করবে, আব্বু তো তাঁর পুরোনো সিমকার্ড নিয়ে গিয়ে নতুন সিম দিয়েছেন। আর শিহাবের পুরোনো সিমেও তো তমা কয়েকবার ফোন করে মোবাইল বন্ধ পাচ্ছে। এই সব চিন্তা করতে করতেই অপরিচিত একটা নম্বর থেকে তমার মোবাইলে ফোন আসতে লাগল। ফোন সাইলেন্স থাকায় তমা খেয়াল করেনি। আরও কয়েকবার এই নম্বর থেকে ফোন এসেছে। এই নতুন নম্বর তো দূরের কেউ জানার কথা না, তাই ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে হ্যালো শুনেই বুঝতে বাকি নেই এটা শিহাবের কণ্ঠস্বর। খুশিতে পাগলের মতো তমা বলল, তুমি ফোন দেবে আমি জানতাম, বলো কী বলতে চাও। কঠিন কণ্ঠে শিহাব বলল, বিয়ে করতে চাও ভালো কথা, আমার তাতে কিছুই যায় আসে না। আমার কাছে তোমার কিছু অন্তরঙ্গ ছবি আর ভিডিও আছে সোশ্যাল মিডিয়ায় যাওয়ার আগে আমার পাঁচ লাখ টাকা চাই। যদি পুলিশকে জানাও তোমাদেরই ইজ্জত যাবে।

তমা বুঝতে পারছে না কী বলবে, শক্ত হয়ে গেছে। বলল, আমার সঙ্গে তুমিও তো ছিলে, তোমার যাবে না? হো হো করে বিশ্রী হাসি দিয়ে শিহাব বলল, আজ পর্যন্ত পুরুষদের সঙ্গে জড়িয়ে নারীদের যত ছবি বা ভিডিও বেরিয়েছে কোথাও কি কোনো পুরুষের ইজ্জত যেতে দেখেছিলে? ইজ্জত তো তাদেরই যায়, যারা ঠিকমতো ইজ্জত তৈরিই করতে পারে না। তার চেয়ে টাকাটা রেডি রেখো।

ঠিক এই মুহূর্তে তমার ভেতর যেন আর কোনো ভয় বা দুর্বলতা কাজ করছে না। আব্বুকে গিয়ে বলল, থানায় গিয়ে এক্ষুনি ডায়েরি করতে হবে। ভয় এমন এক জিনিস, যে ভয় পায় তাকেই ভয় দেখিয়ে প্রতিপক্ষ পৈশাচিক আনন্দ পায়। তমার সবচেয়ে বড় শক্তি তার পাশে নিজের পরিবার আছে। তমার আম্মু পেছন থেকে তমার আব্বুকে বললেন, মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে, কথাটি মনে থাকলে আবারও ভেবে দেখেন থানায় যাবেন কিনা। তমার আব্বু বললেন, একটা অন্যায়কে চেপে রেখে চোরের মতো কেন জীবনযাপন করবে আমার মেয়ে। তার চেয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করে মাথা উঁচু করে চলুক আমার মেয়ে। এতে যদি দুনিয়ার সবাই সরে দাঁড়ায় তবুও আমি নিজের সন্তানকে একা বিপদের দিকে ঠেলে দেব না। যাই হোক লড়ে যাব। এটা পিতা-মাতা হিসেবে আমাদের জন্ম দেওয়ার দায় বলে বুকের মধ্যে টেনে নিলেন তমাকে। আম্মু তমার মাথায় হাত রেখে বললেন, শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত আমরা তোর পাশে আছি মা।