ভুল ধরাধরি

আবুল মিঞা কোনো দিন নকল করে পরীক্ষা দেননি। তিনি নকল করা পছন্দ করেন না। তাই আবুল মিঞা নিজের মনমতো করে বানিয়ে, সুন্দর করে সাজিয়ে লিখতে পছন্দ করেন। দুঃখের বিষয়, তিনি গণিত পরীক্ষায় অঙ্কগুলো নিজের মনমতো বানিয়ে, সাজিয়ে লিখতে গিয়ে দু–দুবার মেট্রিক ফেল করেছেন। তিনি গাইড বা বই দেখে দেখে মুখস্থ করে হুবহু একই রকম লেখাকেও নকল মনে করেন। তাই তিনি কোনো কিছুই মুখস্থ করে হুবহু একই রকম লিখতেন না। লিখতেন তা থেকে ধারণা নিয়ে, নিজের মনমতো বানিয়ে।

যা হোক, আবুল মিঞার বর্তমানের কথা বলি। আবুল মিঞার বয়স হবে এখন প্রায় চল্লিশ। কোনো কিছু ভুল লেখা দেখলে বা শুনলে তার মাথা গরম হয়ে যায়।

ব্যাকরণগতভাবে সঠিক হলেও যদি তার মনে হয় যে এ লেখায় ভুল আছে। লেখাগুলো পরিবর্তন না করা পর্যন্ত তার মাথা ঠিক থাকে না। তার মাথা ঠিক থাকে না ওই সময় পর্যন্ত, যে সময় পর্যন্ত ভুল লেখা বা কথাগুলো ঠিক না করবেন। আবুল মিঞা চা পান করার জন্য চায়ের দোকানের দিকে এলেন। চায়ের দোকানে গিয়ে দেখতে পেলেন টাঙানো এক কাগজের মধ্যে লেখা আছে, ‘এখানে খাঁটি গরুর দুধের চা পাওয়া যায়।’

আবুল মিঞা লেখাটি পড়তে দেরি, কাগজটি ছিঁড়তে দেরি হলো না। চায়ের দোকানদার আবুল মিঞার দিকে হা করে চেয়ে রইল। আবুল মিঞা কোনো কিছু না বলেই, কম্পিউটারের দোকানে এসে, ‘এখানে গরুর খাঁটি দুধের চা পাওয়া যায়’ টাইপ করে লেখে নিয়ে, দোকানে এসে টাঙিয়ে দিলেন। চায়ের দোকানদার ভেবে দেখলেন, কাগজে এখন যেটা লেখা আছে, আসলে এটাই সঠিক।

আবুল মিঞা চায়ের অর্ডার দিলেন। চা দেয়া হলো। তিনি চা পান করার জন্য চায়ের কাপটা মুখের নিকটে নিলেন, ঠিক এই সময় আবুল মিঞা শুনতে পেলেন।

হাট, হাট, হাট। বিরাট গরু-ছাগলের হাট। তা–ও সেই মাইকিং করছে এলাকার এক মাস্টার!

আবুল মিঞা এই কথাটি শুনতে দেরি, মাথাটা গরম হতে দেরি হলো না। আবুল মিঞা চায়ের কাপটা হাতে নিয়েই দোকান থেকে বের হয়ে মাস্টার সাহেবকে মাইকিং করা থামিয়ে, তার কথাতে ভুল আছে বললেন এবং কিছু জ্ঞান দিলেন।
মাস্টার সাহেব রাগান্বিত হয়ে বললেন—
: আমি মাস্টার মানুষ, আমাকে জ্ঞান দিবেন না।
: আপনাকে জ্ঞান দিচ্ছি না, আপনি মাস্টার মানুষ হয়ে ভুল কথা বলেন কেন?
: এই কথাটি ভুল না, ব্যাকরণগতভাবে সঠিক আছে।
: না, সঠিক নেই। আগে ভাষা তারপর ব্যাকরণ। ভাষার আগে তো ব্যাকরণ আসেনি। আপনি যে ব্যাকরণ দিয়ে সঠিক মনে করছেন, সে ব্যাকরণে হয়তো ভুল আছে। আপনি একটু বিবেক খাটান, তাহলে বুঝতে পারবেন আপনার এই কথায় ভুল আছে কি না?
আপনি এভাবে বলেন, ‘হাট, হাট, হাট। গরু-ছাগলের বেচাকেনার বিরাট হাট।’ গরু-ছাগল তো বিরাট হয় না, বিরাট হয় হাট।

গরু-ছাগলের পর, বেচাকেনা শব্দটিও যোগ করতে হবে। কারণ, হাটে হয় বেচাকেনা। বিক্রেতা বেচে ক্রেতা কেনে। তাহলে গরু-ছাগলের হাট বলেন কী করে?আপনার কথায় বোঝা যায়, মানুষও গরু-ছাগল। কেননা মানুষ তো হাটে আসে, হাটে থাকে। আর আপনে যে স্কুলের মাস্টার, সে স্কুলের নামটাও ভুল আছে, ‘মুন্সিগঞ্জ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়।’ স্কুলের নামটা এমন হলে কেমন হয়? ‘মুন্সিগঞ্জ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়।’ তাহলে তো কোনো ভুল থাকে না।

: আপনি বেশি বুঝেন দেখেই তো দু–দুবার মেট্রিক ফেল করছেন।
: আমি মেট্রিক ফেল করেছি তাতে কী হয়েছে? আপনার মতো ভুল কথা তো বলিনি, নকল করে তো পাস করিনি।

: আমি ভুল বলিনি। নকল করে পাসও করিনি। আমি আপনাকে ব্যাকরণগতভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছি। এসব কথাও কোনো ভুল নেই।

বিরাট গরু-ছাগলের হাট কথাটিতে, গরু-ছাগলের হাট শব্দটি বহুপদী বিশেষ্য হিসেবে গ্রহণ করা যায় কি না? যদি গ্রহণ করা যায়, তাহলে তো কোনো সমস্যা হয় না।

তবে বিরাট শব্দটি গরু-ছাগলের আগে বসাতেই হবে। কারণ বিশেষণ বিশেষ্যের পূর্বে বসে। আর এতে করে গরু-ছাগলগুলো বিরাট মানে বড় হয়ে যাবে না। আর বেচা-কেনা শব্দটি যোগ কেনো করব? হাটে যে বেচাকেনা হয় সবাই জানে, তাহলে তো বেচাকেনা বলার দরকার নেই। ‘মুন্সীগঞ্জ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়।’

আসলে কি বালিকা উচ্চ? না, বিদ্যালয় উচ্চ। এখানেও কোনো ভুল নেই।
: দাদা রে আদা পড়া শিখাইয়েন না, ভুল আছে। আপনে একটু দুচোখ বুজে ভেবে দেখেন।

আপনি এভাবে বললে সমস্যা কোন জায়গায়?
আপনি এভাবেই বলেন, ‘মুন্সিগঞ্জ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়।’
‘হাট, হাট, হাট। গরু ছাগলের বেচাকেনার বিরাট হাট।’
এ সময়ে চায়ের দোকানদার বললেন—
: তর্কাতর্কি বাদ দেন আবুল ভাই, চা খাইয়া লন।
চা ঠান্ডা অইয়া যাইতাছে।

আবুল মিঞা এই কথাটি শুনেও রাগান্বিত হয়ে বললেন—
: আরে! চা তো খাওয়া যায় না, পান করা যায়।
এভাবেই চলতে থাকে আবুল মিঞার ভুল ধরাধরি।
*লেখক: শেখ সজীব আহমেদ, মালদ্বীপ প্রবাসী