ভুবনডাঙা থেকে শান্তি নিকেতন

এক
স্মৃতির শহর কলকাতা!
কাঠমান্ডু থেকে আমরা উড়ে এলাম কলকাতা, দমদম এয়ারপোর্টে। কলকাতায় আমি আগেও এসেছি। এই শহরকে ঘিরে আমার অনেক স্মৃতি!
দমদম থেকে ট্যাক্সি ধরে হাওড়া। হাওড়া নেমেই ভিখিরিদের জটলা। মনে পড়ল নীরার কথা!
‘নীরা, তুমি নিরন্নকে মুষ্টিভিক্ষা দিলে এইমাত্র
আমাকে দেবে না?
শ্মশানে ঘুমিয়ে থাকি, ছাই-ভস্ম খাই, গায়ে মাখি
নদী-সহবাসে কাটে দিন
এই নদী গৌতম বুদ্ধকে দেখেছিল
পরবর্তী বারুদের আস্তরণও গায়ে মেখেছিল
এই নদী তুমি!’
সকালের হালকা রোদে হাওড়া ব্রিজ ধরে বেরিয়ে যাচ্ছে শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে। পেছনে কলকাতা শহর। আবারও মনে পড়ল নীরার কথা!
‘এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
আমি কি এ হাতে আর কোনো দিন
পাপ করতে পারি?
এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে, ভালোবাসি—
এই ওষ্ঠে আর কোনো মিথ্যে কি মানায়?
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে পড়ে ভীষণ জরুরি
কথাটাই বলা হয়নি
লঘু মরালীর মতো নারীটিকে নিয়ে যাবে বিদেশি বাতাস
আকস্মিক ভূমিকম্পে ভেঙে যাবে সবগুলো সিঁড়ি
থমকে দাঁড়িয়ে আমি নীরার চোখের দিকে...
ভালোবাসা এক তীব্র অঙ্গীকার, যেন মায়াপাশ
সত্যবদ্ধ অভিমান—চোখ জ্বালা করে ওঠে,
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে, ভালোবাসি—
এই ওষ্ঠে আর কোনো মিথ্যে কি মানায়?’
স্মৃতির শহর কলকাতা! জব চার্নকের শহর কলকাতা!
সুনীলের শহর।
নীরার শহর।
আর জ্যোতি বসুর শহর এই কলকাতা! গঙ্গার ধারে, ইডেন গার্ডেনে আর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে কত ঘুরেছি। চষে বেড়িয়েছি শেক্সপিয়ার সরণি থেকে রবীন্দ্র সরণি। আড্ডা মেরেছি নিউমার্কেটে। ঘুরে বেড়িয়েছি নতুন শহর সল্টলেক সিটি। সেই গল্প আরেক দিন করব। আজ আমরা যাব রবি ঠাকুরের শান্তিনিকেতনে। সেই উদ্দেশ্যেই হাওড়া থেকে চেপে বসলাম শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে। যাব বোলপুর। দূরত্ব প্রায় ১৪০ কিলোমিটার।
শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস হাওড়া ছেড়েছে সকাল ১০টা ১০ মিনিটে। সাড়ে ১১টা নাগাদ পৌঁছালে বর্ধমান। এই বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মেছিলেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল। আসানসোলের একটি চা-রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজও করেছিলেন কিছুদিন। বর্ধমানে ট্রেন থামল ১০ মিনিট। মাটির ভাঁড়ে করে চা আনল দোকানিরা ট্রেনের জানালায়। ওই চা অমৃতের মতো!
ট্রেন থেকে নেমে গেলেন অনেকেই। নতুন করে উঠলেন দুজন। গেরুয়া পোশাক, গলায় মালা, হাতে দোতারা। ওঁরা বাউল! ট্রেন ছাড়ল বোলপুরের দিকে। ট্রেনের ঝিক ঝিক শব্দ ছাপিয়ে কানে আসছে লালন শাহের গান:
‘আসবার কালে কী জাত ছিলে
এসে তুমি কী জাত নিলে
কী জাত হবে যাবার কালে
সে কথা ভেবে বলো না
জাত গেল, জাত গেল বলে
একি আজব কারখানা!
ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল, চামার, মুচি
একজলে সব হয় গো শুচি
দেখে শুনে হয় না রুচি
জমে তো কাউকে ছাড়বে না
জাত গেল জাত গেল বলে...’
মা বসেছেন জানালার পাশে। তাঁর দৃষ্টি উদাস! উদাস হলো আমারও মন। জানালা দিয়ে আমি তাকিয়ে আছি বাইরে। পথ-প্রান্তর আর দুপাশের জনপদকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চলেছে শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস। মনে পড়ল বহুদিন আগে একবার গিয়েছিলাম লালনের আখড়ায়। লালন উৎসবে। ওখানে এক লালন-প্রেমিককে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি হিন্দু না মুসলমান?
লালন-প্রেমিক নিরুত্তর!
আমি আবারও জিজ্ঞেস করলাম, আপনি হিন্দু না মুসলমান?
লালন-প্রেমিক নিরুত্তর!
তৃতীয়বার আবার জিজ্ঞেস করলাম, আপনি হিন্দু না মুসলমান?
লালন-প্রেমিক এবার উত্তর দিলেন। তিনি বললেন, ‘আমি না মুসলিম, না হিন্দু। না ধনী, না গরিব। সবই এক। মণি থেইক্যা হয় রতি। রতি থেকে মতি। মতি থেকে মানুষ। মণি, রতি, মতি ও মানুষ। এই একটাই পথ!’
ট্রেন যখন বোলপুরে এসে থামল, তখন বেলা ১টা ২০। বোলপুর থেকে শান্তিনিকেতনের দূরত্ব দুই কিলোমিটার। আমরা যে ট্যুরিস্ট লজে উঠব বলে মনস্থির করেছি, ওটার দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার। রিকশা নিয়ে আমরা এগোলাম ট্যুরিস্ট লজের দিকে।
যাওয়ার পথে একটি তোরণ চোখে পড়ল। ওখানে বড় বড় করে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাণী:
‘আমাদের শান্তিনিকেতন সে যে সব হতে আপন
তার আকাশ ভরা কোলে মোদের হৃদয় দোলে
মোরা বারে বারে দেখি তারে
নিত্যই নূতন!’
ট্যুরিস্ট লজে লাঞ্চ সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিলাম। তারপর ধীরে ধীরে পা বাড়ালাম শান্তিনিকেতনে। আমরা যখন শান্তিনিকেতনের ক্যাম্পাসে ঢুকছি, ততক্ষণে প্রায় চারটা বেজে গেছে।
দুই
ভুবনডাঙা থেকে শান্তিনিকেতন!
যাঁরা শান্তিনিকেতনে বেড়াতে আসেন, সবাই চলে যান মূল ক্যাম্পাসে, আমরা মূল ক্যাম্পাসে না গিয়ে চলে এলাম ছাতিমতলায়। কেন? কারণ, এই ছাতিমতলাতেই শান্তিনিকেতন শুরু। শান্তিনিকেতনের বীজটা এখানেই বপিত হয়েছিল!
আদিতে শান্তিনিকেতনের নাম ছিল ভুবনডাঙা। জমিদার ভুবন সিংহের নামানুসারে এই নাম। এই সিংহ পরিবারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিল। একবার তিনি নিমন্ত্রণ রক্ষায় সেখানে গেলে ভুবনডাঙায় রাত হয়ে যায়। দৈবক্রমে সেদিন ছিল জ্যোৎস্নারাত। মাঠের মধ্যে ছিল কতগুলো ছাতিমগাছ। অপূর্ব সেই দৃশ্য। এই নৈসর্গিক দৃশ্যে অভিভূত হয়ে তিনি ভুবনডাঙার প্রেমে পড়ে যান। ১৮৬৩ সালের ৩১ মার্চ তিনি কুড়ি বিঘা জমি পাঁচ টাকায় পাট্টা নিলেন জমিদার ভুবন সিংহের কাছ থেকে। ছাতিমতলাতেই তিনি গড়ে তোলেন এক আশ্রম। পাশে একটি বাড়ি, যার নাম ‘শান্তিনিকেতন’! কালের প্রবাহে ভুবনডাঙা থেকে এলাকাটির নাম হয়ে যায় শান্তিনিকেতন!
অর্থ, বিত্ত, যশ, প্রতিপত্তি কোনোটারই কমতি ছিল না মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের। অথচ সময় পেলেই তিনি সুদূর কলকাতা থেকে ছুটে আসতেন অখ্যাত ভুবনডাঙায়। নিরিবিলিতে ছাতিমতলায় বসে ধ্যান করতেন। এখানে এলে তিনি আত্মার শান্তি পেতেন। পরবর্তী সময়ে বাবার হাত ধরে ১২ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ প্রথম বেড়াতে আসেন শান্তিনিকেতনে। বাবার মতো তিনিও ভালোবাসতে শুরু করেন লাল মাটির এই ভূমি ও তার চারপাশের সবুজ নির্জনতাকে।
১৮৮৮ সালের ৮ মার্চ দেবেন্দ্রনাথ ট্রাস্টি চুক্তির মাধ্যমে শান্তিনিকেতনকে সবার জন্য উন্মুক্ত করেন। এরপর এখানেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০১ সালে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যদিও এর উদ্যোক্তা ছিলেন বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই বিদ্যালয়ের প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে ছিলেন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় আর ছাত্র হিসেবে ছিলেন গৌরগোবিন্দ গুপ্ত, প্রেমকুমার গুপ্ত, অশোককুমার গুপ্ত, সুধীরচন্দ্র, গিরিন ভট্টাচার্য, যোগানন্দ মিত্র, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরবর্তী সময়ে কালের পরিক্রমায় এখানে ১৯২১ সালে বিখ্যাত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
ছাতিমতলায় রয়েছে একটি সুন্দর বেদি। বেদির ওপরেই ঝুঁকে আছে ছাতিমগাছ। মূল বেদির পাশেই রয়েছে কারুকার্যখচিত আরেকটি বেদি। সেখানে বড় বড় হরফে লেখা:
‘তিনি
আমার প্রাণের আরাম
মনের আনন্দ
আত্মার শান্তি।’
ছাতিমতলায় কোনো কোলাহল নেই, আছে নিরবচ্ছিন্ন
পরবর্তী অংশ ৩৯ এর পাতায়
নীরবতা আর শান্তি!
পুরো এলাকাটিতে প্রচুর গাছগাছালি।
গাছের মধ্যে ‘সপ্ত পার্নি’ নামে একটি গাছের আধিক্য
দেখলাম। পরে জেনেছি, প্রতিবছর বিশ্বভারতীর নতুন স্নাতকদের এই গাছের পাঁচটি পাতাসহ একটি ডাল উপহার হিসেবে দেওয়ার রীতি ছিল। ছাতিমতলায় আমরা কিছু সময় কাটালাম। তারপর সেখান থেকে আমরা চলে এলাম শান্তিনিকেতন ভবনে।
শান্তিনিকেতন ভবন।
এটি আশ্রমের সবচেয়ে পুরোনো বাড়ি। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬৪ সালে এই বাড়িটি তৈরি করিয়েছিলেন। এটি দালানবাড়ি। প্রথমে একতলা বাড়ি ছিল। পরে দোতলা হয়। বাড়ির উপরিভাগে খোদাই করা আছে: ‘সত্যাত্ম প্রাণারামং মন আনন্দং’!
এটি উপনিষদের একটি উক্তি। তিনি নিজে বাড়ির একতলায় ধ্যানে বসতেন। তাঁর অনুগামীরাও এখানে এসে থেকেছেন। কৈশোরে বাবার সঙ্গে হিমালয়ে যাওয়ার পথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে কিছুদিন বাস করেন। ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয় স্থাপনের সময়ও রবীন্দ্রনাথ কিছুকাল সপরিবার এই বাড়িতে বাস করেছিলেন। পরে আর কখনো তিনি এটিকে বসতবাড়ি হিসেবে ব্যবহার করেননি। এখন বাড়িটির সামনে রামকিঙ্কর বেজ নির্মিত একটি বিমূর্ত ভাস্কর্য রয়েছে।
আমাদের স্থানীয় গাইড সুদীপ বাবু জানালেন, দেবেন্দ্রনাথ তিনটি স্ট্রাকচারে বাড়িটি তৈরি করেছিলেন। ভবনটি একেক দিক থেকে দেখলে একেক রকম মনে হবে। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, সত্যিই তো। একদিক থেকে দেখলে মনে হচ্ছে মন্দির, অন্যদিক থেকে দেখলে মসজিদ, আরেক দিক থেকে দেখলে গির্জা। কেউ কেউ অবশ্য বলেন, বাড়িটি পাঁচটা ধর্মের স্ট্রাকচারে করা।
শান্তিনিকেতন ভবন থেকে হাঁটতে হাঁটতেই আমরা এসে দাঁড়ালাম উপাসনাগৃহ বা ব্রাহ্ম মন্দিরের সামনে।
১৮৯২ সালে এই মন্দিরের উদ্বোধন করা হয়। এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র দিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এটি কাচের তৈরি সুন্দর ছিমছাম একটি ঘর। জীবদ্দশায় এখানে প্রার্থনা করতেন রবীন্দ্রনাথের বাবা এবং রবীন্দ্রনাথ নিজেও। প্রার্থনাঘরে এখনো নিয়মিত প্রার্থনা হয়। প্রতি বুধবার ‘সংগীত ভবন’-এর ছাত্রছাত্রীরা এখানে সমবেত প্রার্থনাসংগীত করেন।
স্মৃতিবিজড়িত এই সব জিনিস দেখতে দেখতে এতই বিভোর ছিলাম কখন যে সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে, তা খেয়ালই করিনি! হাঁটতে হাঁটতেই ফিরে এলাম আমাদের ট্যুরিস্ট লজে।
কাল আবার যাব মূল ক্যাম্পাসে!
তিন
মূল ক্যাম্পাসে!
উত্তরায়ণ থেকে কিছু দূর এগিয়েই কলাভবন আর্ট গ্যালারি। ১৯৮১ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই ভবনের উদ্বোধন করেন। কলাভবনে রয়েছে হোস্টেল, যার নাম ‘ব্ল্যাক হাউস’। আর্ট গ্যালারির উল্টো দিকেই নাট্যমঞ্চ ‘নাট্যঘর’। ব্ল্যাক হাউসের পেছনে ‘সংগীত ভবন’। এই সংগীত ভবনে সংগীতের ওপরে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন বাংলাদেশের অনেক গুণী শিল্পী।
সংগীত ভবন পেরিয়ে আমরা এলাম ‘রবীন্দ্র ভবন’। এখানে করা হয়েছে রবীন্দ্র জাদুঘর। এই জাদুঘরে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র, স্বহস্তে আঁকা শিল্পকর্ম, দেশ-বিদেশ থেকে পাওয়া সম্মানের দলিল-দস্তাবেজ। এখানে আরও রয়েছে রবীন্দ্রনাথের কাপড়চোপড়, জুতা ও আরও কিছু ব্যক্তিগত ব্যবহার্য জিনিস।
রবীন্দ্র ভবন থেকে আমরা এলাম ‘আম্রকুঞ্জে’। এখানেই বিশ্বভারতীর বার্ষিক সমাবর্তন অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন নোবেল পুরস্কার পেলেন, তখন এই আম্রকুঞ্জেই কবিকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। শান্তিনিকেতনের এই আম্রকুঞ্জেই গান্ধীজি ও রবীন্দ্রনাথকে দেখা যেত গল্পে মেতে উঠতে!
এরপর আমরা দেখলাম আরও দুটি ইমারত। একটির নাম ‘চায়না ভবন’, অপরটি ‘নিপ্পন ভবন’। চায়না ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। মাইলস্টোনে লেখা—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩৭ সালের এপ্রিলে এই ভবন উদ্বোধন করেন। আবারও মনে পড়ল, পাখি উড়ে যায় পালক পড়ে থাকে। শান্তিনিকেতনের সর্বত্রই রবীন্দ্রনাথের ঝরা পালক!
চিয়াং কাইসেক ছিলেন বিশ্বভারতীয় অধ্যাপক। তিনি ও তাঁর স্ত্রী তান ইয়ান ‘চায়না ভবন’ নির্মাণে বিস্তর সহায়তা করেন। চিয়াং কাইসেক ও তান ইয়ান দুজনে মিলে এই ভবনের লাইব্রেরির জন্য প্রায় ২৪ হাজার পুস্তক উপহার হিসেবে দেন। পরবর্তী সময়ে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই এই লাইব্রেরিতে ৩৪ হাজার বই উপহার হিসেবে পাঠান। এই ভবনে চীনা সাহিত্যের ওপর উচ্চতর গবেষণা হয়ে থাকে।
১৯৫৪ সালে বিশ্বভারতীতে জাপানি বিভাগ খোলা হয়। আর ১৯৯৪ সালে ‘নিপ্পন ভবন’ উদ্বোধন করা হয়। যাঁর নিরলস প্রচেষ্টায় বিশ্বভারতীর ‘নিপ্পন ভবন’
প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তিনি হচ্ছেন অধ্যাপক কাজুও আজুমা। অধ্যাপক কাজুও আজুমার আরেকটি কীর্তি রয়েছে। তিনি জাপানি ভাষায় ১২ খণ্ডে রবীন্দ্ররচনাবলির সম্পাদনার কাজটিও করেছেন। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও জাপান সরকার তাঁকে যথাক্রমে দেশিকোত্তম, রবীন্দ্র পুরস্কার ও পার্পল রিবন (কোক্কা কুনশোউ) পদক দিয়ে সম্মান জানিয়েছে।
ক্যাম্পাস শান্ত হয়ে এসেছে, সূর্য ডুবি ডুবি করছে। আমরা ফিরে এলাম ট্যুরিস্ট লজে। নাওয়া-খাওয়া শেষে এবার বিশ্রামের পালা।
চার
যে ভাস্কর্যে ফুটে উঠেছে মা ও শিশু!
শান্তিনিকেতন ভবনের সামনে রয়েছে একটি ভাস্কর্য। পাথরের মূর্তি। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এই মূর্তিকে আপনি যে দিক থেকেই দেখেন না কেন, কিছুই বুঝতে পারবেন না। মনে হবে নিরেট একটি প্রস্তরখণ্ড! বুঝবেন কখন? একেবারে ভরদুপুরে!
দুপুরের যে রোদ সোজা আমাদের মাথায় এসে পড়ে, সে রোদের ছায়ায় দেখা যাবে এই মূর্তির মাহাত্ম্য। বেলা যখন ১২টা থেকে ১টা, সূর্য যখন মাথার ওপরে, তখন সূর্য থেকে মূর্তির ওপরে পড়া রোদের ছায়ায় দেখা যাবে ‘একটা মা তার সন্তান কোলে দাঁড়িয়ে আছে’!
প্রথমবার আমি যখন মূর্তিটি দেখেছি, তখন ছিল বিকেলবেলা। কিছুই বুঝিনি! মনে মনে ভাবলাম, এই মূর্তিটি সযত্নে এখানে রাখার মানে কী? পরে যখন দুপুরের আলোয় দেখলাম, আমি বিস্ময়ে অভিভূত! অপার বিস্ময়ে আমি ভাস্কর্যের দিকে তাকিয়ে আছি! আমার সেই বিস্ময় কিছুটা হলেও ছুঁয়ে গেল আমার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া ছেলেটিকে! ছেলেটি থামল।
আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘দাদা, ঢাকা থেকে এসেছেন বুঝি?’
আমি বললাম, ‘কীভাবে বুঝলেন, দাদা?’
ছেলেটি বলল, ‘তা বোঝা যায়। কিছুটা ভাষা, আর কিছুটা ভাব-ভঙ্গি দেখে!’
‘আপনি এখানকার ছাত্র?’ জিজ্ঞেস করি আমি।
ছেলেটি বলল, ‘আপনি বুঝলেন কী করে?’
আমি বললাম, ‘তা বোঝা যায়। কিছুটা ভাষা, আর কিছুটা ভাব-ভঙ্গি দেখে!’
ওর উত্তর ওকেই ফেরত দিলাম।
ছেলেটা সমঝদার। সামান্য হেসে বলল, ‘আমি অভিজিৎ রায়। ফাইন আর্টস, ফাইনাল ইয়ার।’
অভিজিৎ রায়ই আমাকে জানালেন, ‘মা ও শিশু’কে নিয়ে গড়া ওই ভাস্কর্য ভারতীয় সাঁওতাল ভাস্কর রামকিঙ্কর বেজ-এর তৈরি। রামকিঙ্কর ছিলেন প্রথম ভারতীয় শিল্পী, যিনি আধুনিক পাশ্চাত্য শিল্প অধ্যয়ন করে সেই শৈলী নিজের ভাস্কর্যে প্রয়োগ করেন। তাঁকে ভারতীয় শিল্পে আধুনিকতার জনক ও অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী মনে করা হয়।
তৎক্ষণাৎ আমার মনে পড়ল পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিক সমরেশ বসুর কথা। সমরেশ বসু ভাস্কর রামকিঙ্কর বেজের ওপর একটি অসমাপ্ত উপন্যাস লিখেছিলেন। উপন্যাসটির নাম দেখি নাই ফিরে! ১৯৮৮-এর ১২ মার্চ যখন সমরেশ বসু মারা যান, তখনো তাঁর লেখার টেবিলে ১০ বছরের অমানুষিক শ্রমের অসমাপ্ত ফসল শিল্পী রামকিঙ্কর বেজের জীবনী অবলম্বনে উপন্যাস দেখি নাই ফিরে।
শিল্পী রামকিঙ্কর বেজ এই শতাব্দীর এক বিস্ময়। আরও বিস্ময়কর তাঁর জীবন। যে জীবন অনিঃশেষ সংগ্রাম, সাধনা ও সাফল্যের। যে জীবন নিন্দা, বিতর্ক আর অস্বস্তির। বিশ্বাসে অটল, জীবনবোধে অবিচল, নাটকীয়তায় উদ্বেল সেই বহুবর্ণ জীবনকেই চিত্রিত করতে চেয়েছেন সমরেশ বসু এই উপন্যাসে।
বাকি অংশ ৩৯ এর পাতায়
দুর্লভ এই প্রয়াস। বাস্তব কোনো শিল্পীকে নিয়ে উপন্যাস রচনার দৃষ্টান্ত বিশ্বসাহিত্যেই হাতে গোনা, বাংলায় নজিরবিহীন। লেখকের আকস্মিক প্রয়াণে অসমাপ্ত থেকে গেল এই কীর্তি। তবু কালের নৈকট্য ও উপাদান-বিরলতার প্রতিবন্ধকতাকে যেভাবে জয় করেছেন সমরেশ বসু, ১০ বছরের বেশি কাল ধরে অক্লান্ত শ্রমে-নিষ্ঠায় যেভাবে জড়ো করেছেন সমূহ সাক্ষ্য-বিবরণ-দলিল, সর্বোপরি এই জীবনকাহিনির মধ্য দিয়ে যেভাবে মেলে ধরেছেন নিজেরও সংগ্রাম-সাধনার, যন্ত্রণা-লাঞ্ছনার এক অপরূপ প্রতিচ্ছবি—তা যেমন নতুনতর, তেমনই মহিমান্বিত এক মাত্রা যুক্ত করেছে এই উপন্যাসে। উপন্যাসটি পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমার।
শান্তিনিকেতনের কলাভবন স্থাপিত হয় ১৯১৯ সালে। তার পরপরই রবীন্দ্রনাথ কলাভবনের দায়িত্ব দেন শিল্পাচার্য নন্দলাল বসুকে। ১৯২৫-এ বাঁকুড়ার যোগীপাড়া থেকে ম্যাট্রিক না দিয়েই প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে শান্তিনিকেতন চলে এলেন রামকিঙ্কর। পেছনে পড়ে রইল বাঁকুড়ায় তাঁর বাল্যস্মৃতির গাঁ-ঘর, দারিদ্র্যে দীর্ণ পরিবার-পরিজন আর কাদামাটির কুমোরপাড়া!
শান্তিনিকেতনের কলাভবনে তাঁর কাজের নমুনা দেখে শিল্পাচার্য নন্দলাল প্রথম দিনই বললেন, ‘তুমি সবই জানো, আবার এখানে কেন?’
একটু ভেবে তারপর আবারও বললেন, ‘আচ্ছা, দু-তিন বছর থাকো তো।’
থেকে গেলেন রামকিঙ্কর। নাগাড়ে সাড়ে পাঁচ দশক শান্তিনিকেতনে কাটিয়ে
মৃত্যুর কিছুদিন আগে এক সাক্ষাৎকারে রামকিঙ্কর বলেছিলেন, ‘সেই দু-তিন বছর আমার এখনো শেষ হলো না!’ রামকিঙ্কর আরও বললেন, ‘কানে বাজছে মাস্টারমশাই নন্দলালের কথা। রাতের স্বপ্নগুলোকে মনে রেখো কিঙ্কর। ভুলে যেয়ো না। তেমন হলে, স্বপ্ন ভেঙে গেলে, উঠে স্বপ্নের কথা লিখে রাখবে। কোনো স্বপ্নই ভুলে যেয়ো না। স্বপ্নে ছবি আসে কিঙ্কর, প্রতিমা আসে। তুমি স্বপ্ন আঁকবে!’
বিশ্বভারতীর প্রাক্তনী সাগরময় ঘোষ লিখেছেন সেই কথালাপ, ‘রবীন্দ্রনাথ রামকিঙ্করকে ডেকে বললেন, শোন, কাছে আয়। তুই তোর মূর্তি আর ভাস্কর্য দিয়ে আমাদের সবখানে ভরে দে। একটা শেষ করবি আর সামনে এগিয়ে যাবি—আরও সামনে।’
এরপর আর কখনো ফিরে দেখেননি রামকিঙ্কর। হাওয়ার উজানে এগিয়েছেন তিনি। আর এগোতে গিয়েই নিয়ত তাঁকে দুঃখ-দহনে পুড়তে হয়েছে!
একবার দিল্লি যাওয়ার পথে এক আদিবাসী রমণীর যৌবনের দুর্মর আহ্বানের কাছে নতজানু হয়ে তাঁর সঙ্গে নেমে গেলেন অজানা স্টেশনে। হারিয়ে গেলেন যেন। খবর নেই বহুকাল! হঠাৎ নাম-ঠিকানাহীন টেলিগ্রাম এসে পৌঁছায় শান্তিনিকেতনে! তাতে রামকিঙ্কর জানালেন, ‘I lost myself, search myself’!
আহা! এ যেন জীবন জানতেই হারিয়ে যাওয়া এক জীবন পথিকের টেলিগ্রাম!
রামকিঙ্করের একটি ভাস্কর্য নিয়ে শান্তিনিকেতনে তুলকালাম। তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। শেষ বিকেলের আলো এসে খেলা করছে জাফরি ছুঁয়ে লাল মেঝেতে। সেই নরম আলোয় কোনার্ক বাড়ির বারান্দায় একলা বসে লিখছিলেন কবি। তখনই কিঙ্কর এলেন।
রবির প্রশ্ন, ‘কার মূর্তি গড়েছ, কিঙ্কর?’
‘আমি ওটাকে জ্ঞান দিয়ে বুঝতে পারিনে! স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে ওই মূর্তি আমার কাছে এসেছিল।’
‘সেই মূর্তির মধ্যে কি কোনো প্রাণী আছে?’ কবির পাল্টা প্রশ্ন!
‘আছে। অথচ যেন নেই!’
মুখ না ঘুরিয়ে রবীন্দ্রনাথ কথা বলছিলেন ওঁর সঙ্গে। ফের জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি যেন একটি মেয়ের মূর্তি দেখেছি, মুখ নামানো।’
কিঙ্কর মিতস্বরে বললেন, ‘হয়তো সে কাউকে চুমো খেতেই মুখ নামিয়েছে।’
রবি ঠাকুরের সামনে চুমু খাওয়ার কথাটা বলে ফেলে খুব অস্বস্তি হলো কিঙ্করের। গলা শুকিয়ে কাঠ।
গ্রীষ্মের ছুটি চলছিল শান্তিনিকেতনে, কিন্তু বাড়ি যাননি রামকিঙ্কর। তাঁর দিনমান কাটছিল নিভৃত শালবন, রোদরাঙা সুনসান গোয়ালপাড়ার মেঠো আলপথ, মেথরপল্লির কল-কল্লোলে রংতুলি-ক্যানভাস নিয়ে।
মহার্ঘ সব রাত পেরিয়ে যায় অন্ধকারে, স্পর্শের নির্মাণে। আশ্রমে খোলা আকাশের নিচে, কংক্রিটের ঢালাইয়ে তেমন নির্মাণ দেখেই কিঙ্করের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে গুজবে মুখর শান্তিনিকেতন। এক ভোরে নিজে সেই ভাস্কর্য দেখে এলেন রবীন্দ্রনাথ।
কবির ডাক পেয়েই কিঙ্করের মনে হয়েছিল, এই বুঝি তাঁকে শান্তিনিকেতন ছেড়ে যেতে হবে!
রবীন্দ্রনাথ এবার ফিরে তাকালেন অন্যমনস্ক কিঙ্করের দিকে। বললেন, ‘একটি পাখি কি উড়ে যেতে চায় আকাশে? পাখা তার যেন সেই রকম তুলে দিয়েছে।’
কিঙ্করের চোখের পাতা ভিজে এল। তিনি মুখ তুললেন না। খুব আস্তে কেবল বললেন, ‘একটি মেয়ে পাখি হয়তো তার বুকের নিচেই আছে!...’
কবি আর কিঙ্করের কথায় কথায় একসময় বিকেল ফুরিয়ে সন্ধে নামল। আকাশে সন্ধ্যাতারা। দূরের হাওয়ায় ভেসে আসছে এসরাজি পকড়। ছড় টেনে কেউ একমনে বাজিয়ে চলেছে কবির বাহারে গাঁথা ধামার, ‘এত আনন্দধ্বনি উঠিল কোথায়’। এরপরও কথা এগিয়েছিল দুজনের। দুই শিল্পীর।
কী কথা?
কেউ তা জানে না!
এরপর আর কখনো ফিরে দেখেননি কিঙ্কর। হাওয়ার উজানে এগিয়েছেন তিনি। আর এগোতে গিয়েই নিয়ত তাঁকে দুঃখ-দহনে পুড়তে হয়েছে!
অভিজিৎ রায়ের সঙ্গে বসেছিলাম বকুলবীথিতে। কাঁধের ফ্লাস্কে রাখা চা খেতে খেতে আলাপ হলো কতশত!
অভিজিৎ বললেন, ‘ষাটের দশকের মাঝামাঝি কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বন্ধু সমীর সেনগুপ্তকে নিয়ে এক বাসন্তিক বিকেলে হাজির হলেন শান্তিনিকেতনে।
রিকশা থামল অনিবার্যভাবে বাংলা মদের দোকান ‘আকর্ষণী’তে। রিকশায় উঠল দু বোতল বাংলা। গন্তব্য রতনপল্লি, রামকিঙ্করের ডেরা।
‘কিঙ্করদা, ও কিঙ্করদা...’
শক্তির হেঁড়ে গলায় হাঁক শুনে লুঙ্গি বাঁধতে বাঁধতে বাইরে এলেন রামকিঙ্কর। মুখে সেই চিরচেনা হাসি।
‘আরে কবি এসেচিস—আয়, আয়, কিছু এনেচিস তো হাতে করে?’
এর পরের আসরের বর্ণনা দিতে সমীর লিখেছেন, ‘শুয়োরপোড়া এল, ফুরিয়ে গেল, একটি রিকশাওয়ালা ধরে আরও দুটো বোতল আনানো হলো, সঙ্গে ছোলাভাজা, সে দুটোও ফুরিয়ে গেল। আবারও দুটো আনানো হলো বেশি পয়সা দিয়ে, তখন রাত দশটা বেজে গেছে। তারপর আর আমার কিছু মনে নেই। শুধু মনে আছে, অফুরন্ত বাংলা মদ, অফুরন্ত বিড়ি, অফুরন্ত কথা, স্খলিত গলায় অফুরন্ত রবীন্দ্রনাথের গান!’
ঢের রাতে ঘুম ভেঙেছিল সমীরের। অন্ধকার ঘরের ভেতর থেকে কোনোমতে চৌকাঠ পেরিয়ে দেখলেন, রামকিঙ্কর একটা টুলের ওপর বসে রয়েছেন। ওপর থেকে একটা লন্ঠন ঝুলছে। লুঙ্গিটা কোমর থেকে যে খুলে পড়েছে, কিঙ্করের সে খেয়াল নেই! সম্পূর্ণ নগ্ন! আর তাঁর সামনে একটা অসমাপ্ত মাটির ভাস্কর্য। স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রয়েছেন কিঙ্কর!
কাজের স্বীকৃতি হিসেবে রামকিঙ্কর বেজ বিশ্বভারতীর ‘দেশিকোত্তম’, রবীন্দ্রভারতী কর্তৃক ডিলিট ও ভারতের রাষ্ট্রীয় খেতাব ‘পদ্মভূষণ’ লাভ করেছেন। দেশে-বিদেশে তাঁর অনেক একক ও যৌথ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভারতীয় শিল্পকলাচর্চায় আধুনিকতার প্রবক্তা হিসেবে যাঁদের নাম উচ্চারিত হয়, তাঁদের মধ্যে রামকিঙ্কর বেজ অন্যতম!
তরুণ চিত্রকর নন্দলাল বসুর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ দেখতে পেয়েছিলেন অমিত সম্ভাবনা। পরবর্তী সময়ে বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় ও রামকিঙ্কর বেজের যোগদানের মাধ্যমে কলাভবন আরও পূর্ণতা পায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ একই সঙ্গে বিশ্বজনীনতায়ও বিশ্বাসী ছিলেন। তাই ১৯২১ সালে আমন্ত্রণ জানান ভিয়েনার শিল্প-ইতিহাস বিশেষজ্ঞ স্টেলা ক্রামরিশকে, আসেন ফরাসি চিত্রশিল্পী অঁদ্রে কার্পেলেস ইউরোপীয় ভিত্তিচিত্র ও তেলরং শেখাতে, হাঙ্গেরীয় শিল্পী লিজা ফন পট ও মার্গারেট মিলওর্ড শিক্ষা দেন পশ্চিমা পদ্ধতিতে মূর্তি রচনা, তিব্বতীয় তনখাচিত্র শেখানোর জন্য তিব্বত থেকে আসেন শিল্পী, চীনা শিল্পরীতি শেখাতে আসেন ইয়াউ উয়ান শান, বীরভূম থেকে ঢালাই কাজের কারিগর, ওডিশার পাথর কাটার কারিগর এবং জয়পুরের ভিত্তিচিত্র কারিগরেরাও সমাদর পান এখানে।
ওই সময় প্রাচ্যের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব ছিল অভাবিত ঘটনা। বিশ্বভারতীকে পূর্ব-পশ্চিমের সত্যিকার মিলনস্থল ও জ্ঞানের কেন্দ্ররূপে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ!
রবীন্দ্রনাথের বিশ্বায়নের ভাবনা ছিল: ‘ত্যাগ না করিয়া, বিনাশ না করিয়া একটি ব্যবস্থার মধ্যে সকলকেই স্থান দেওয়া’—এ ভাবনা এখনো যে প্রাসঙ্গিক!
অভিজিৎ রায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কলাভবনের সামনেই দেখলাম রামকিঙ্করের বিখ্যাত দুটি ভাস্কর্য ‘দুই সাঁওতাল রমণী সন্তানসহ কারখানায় কাজে যাওয়ার পথে’ আর ‘এক সাঁওতাল শ্রমিক পরিবারের দেশান্তর যাত্রা’।
বড় অদ্ভুত এই ভাস্কর্য!
বড় অদ্ভুত আমাদের এই সময় পরিভ্রমণ!
সূর্য ডুবেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। মা আর আমি নিঃশব্দে হেঁটে আসছি ক্যাম্পাস থেকে ট্যুরিস্ট লজে। আমাদের পেছনে লাল কাঁকর বিছানো উদাস পথ, বকুলবীথি আর ছাতিমতলা। মহুয়ার গন্ধে মাতাল গেরুয়া বাতাস। আর ওই গেরুয়া বাতাসে আকাশ ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে রইল রামকিঙ্করের পাথরের মূর্তি ‘মা ও শিশু’!

পাঁচ
প্রার্থনাসংগীত।
আগামীকাল বুধবার। শান্তিনিকেতনে সাপ্তাহিক ছুটির দিন। কোনো ক্লাস নেই। আছে প্রার্থনাসংগীত। খুব ভোরে।
মাকে বললাম, ‘যাবে নাকি প্রার্থনাসংগীত শুনতে?’
মা বললেন, ‘অবশ্যই যাব!’
ঘুম থেকে উঠে আমরা যথারীতি রওনা দিলাম ক্যাম্পাসের দিকে। আমরা ক্যাম্পাসে পৌঁছলাম সকাল সাড়ে ছটায়। অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, এত ভোরেও ঘুম ভেঙে ছাত্রছাত্রীরা লাইন ধরে উপাসনাগৃহে আসছে। সবাইকে আসার জন্য আহ্বান করে ঘণ্টাতলায় কিছুক্ষণ পরপর ঘণ্টা বাজানো হচ্ছে।
সাতটা নাগাদ প্রার্থনাঘর ও তার আঙিনা ভরে গেল। সবাই বসেছে প্রার্থনাঘরের মেঝেতে। সকালের হালকা রোদ, হালকা বাতাস, আর চারদিকে পাখির কলতান। বাতাসে সদ্য ফোটা ফুলের সুবাস। কী যে সুন্দর এই সকাল!
এরই মধ্যে শুরু হলো আজকের আয়োজন।
শুরুতেই রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘বিজয়া-সম্মিলন’ থেকে পাঠ করে শোনানো হলো। যিনি পাঠ করলেন, বড় গম্ভীর আর সুরেলা তাঁর গলা! গম্ভীর আর সুরেলা কণ্ঠে তিনি বলে গেলেন:
‘মনে রাখিতে হইবে, আজ স্বদেশের স্বদেশীয়তা আমাদের কাছে যে প্রত্যক্ষ হইয়া উঠিয়াছে ইহা রাজার কোনো প্রসাদ বা অপ্রসাদে নির্ভর করে না। কোনো আইন পাস হউক বা না হউক, বিলাতের লোক আমাদের করুণোক্তিতে কর্ণপাত করুক বা না করুক, আমার স্বদেশ আমার চিরন্তন স্বদেশ। আমার পিতৃ পিতামহের স্বদেশ, আমার সন্তানসন্ততির স্বদেশ, আমার প্রাণদাতা শক্তিদাতা সম্পদদাতার স্বদেশ। কোনো মিথ্যা আশ্বাসে ভুলিব না, কাহারো মুখের কথায় ইহাকে বিকাইতে পারিব না। একবার যে হস্তে ইহার স্পর্শ উপলব্ধি করিয়াছি সে হস্তকে ভিক্ষাপাত্র বহনে আর নিযুক্ত করিব না। সে হস্ত মাতৃসেবার জন্য সম্পূর্ণভাবে উৎসর্গ করিলাম।’
আজ থেকে প্রায় ১১২ বছর আগে কথাগুলো লিখেছিলেন রবি ঠাকুর, সেই ১৯০৫ সালে! অথচ মনে হলো এই তো সেদিনের লেখা। এখনকার জন্যই লেখা! বড় ভালো লাগল।
‘বিজয়া-সম্মিলন’ শুনে আমি প্রার্থনাঘরের বাইরে এলাম। ওখানে দেখা হলো অভিজিৎ রায়ের সঙ্গে।
আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আর কদিন আছেন?’
আমি বললাম, ‘আজ রাতে চলে যাব।’
‘ঢাকায় যাবেন?’ পাল্টা প্রশ্ন অভিজিতের।
আমি বললাম, ‘না, আমরা যাব দার্জিলিংয়ে!’
অভিজিৎ বলল, ‘ভালো, খুব ভালো।’
ভেতরে প্রার্থনাসংগীত শুরু হয়েছে। সমবেত স্বরে প্রার্থনাসংগীত গাইছেন বিশ্বভারতীর শিক্ষার্থীরা।
দূর থেকে কানে ভেসে আসছে—
‘আজি শুভক্ষণে পিতার ভবনে
অমৃত সদনে চলো যাই
চলো চলো—চলো যাই।’
মা সবার সঙ্গে বসে আছেন প্রার্থনাঘরের মেঝেতে। আমিও নিঃশব্দে গিয়ে বসলাম মার পাশে। শিল্পীরা নতুন গান ধরেছেন।
‘সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলি,
শোন শোন পিতা কহ কানে কানে,
শোনাও প্রাণে প্রাণে, মঙ্গল বারতা।’
এবার ওরা ধরল—
‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি
নিয়ে যাবি কে আমার
ও বন্ধু আমার!
না পেয়ে তোমার দেখা,
একা একা দিন যে আমার কাটে না রে॥
বুঝি গো রাত পোহালো,
বুঝি ওই রবির আলো
আভাসে দেখা দিল গগন-পারে—
সমুখে ওই হেরি পথ,
তোমার কি রথ
পৌঁছুবে না মোর দুয়ারে॥
আকাশের যত তারা
চেয়ে রয় নিমেষহারা,
বসে রয় রাত-প্রভাতের পথের ধারে।
তোমারি দেখা পেলে সকল ফেলে ডুববে আলোক-পারাবারে।
প্রভাতের পথিক সবে
এল কি কলরবে—
গেল কি গান গেয়ে ওই সারে সারে!
বুঝি-বা ফুল ফুটেছে, সুর উঠেছে অরুণবীণার তারে তারে॥
বাগানে সদ্য প্রস্ফুটিত জেসমিনের গন্ধ আর রবি ঠাকুরের সুরে ঘোর লেগেছে শান্তিনিকেতনের বাতাসে। এই গানগুলো আমি আগেও শুনেছি বহুবার! কিন্তু আজকের এই পরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন। মনে হচ্ছে এক অলৌকিক আয়নার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমরা। ওই আয়নাটা হচ্ছে আমাদের মন!
মা আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘তোর কি মন খারাপ?’
আমি বললাম,‘না মা, মন খুব ভালো হয়েছে।’
‘তাহলে কাঁদছিস কেন?’
আমি বললাম, ‘মা, সব সময় কি শুধু মন খারাপেই কাঁদতে হয়? মাঝেমধ্যে মন ভালোতেও কাঁদতে হয়!’
সংগীত শেষে আমরা সবাই প্রার্থনাঘর থেকে লাইন ধরে বাইরে বেরিয়ে এলাম। ছাত্রছাত্রীরা চলে যাচ্ছে হোস্টেলে। আমরা পা বাড়ালাম ট্যুরিস্ট লজের দিকে। আজ রাতের ট্রেনে আমরা চলে যাব জলপাইগুড়ি, সেখান থেকে দার্জিলিং!
আবার কবে কখন শান্তিনিকেতনে আসব জানি না। কিন্তু শান্তিনিকেতনের এই দিনগুলো রয়ে যাবে স্মৃতিতে অম্লান!