ভিনদেশে আমাদের ঈদ আনন্দ

ঈদ আনন্দে সমবেতদের একাংশ
ঈদ আনন্দে সমবেতদের একাংশ

মুসলমানদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় উৎসব ঈদুল-ফিতর এবার বেশ ঘটা করে উদ্‌যাপিত হয়েছে সুইজারল্যান্ডের বাসেল শহরে। ফ্রান্স ও জার্মান সীমান্ত ঘেঁষা ছোট একটি শহর বাসেল। এই শহরে প্রায় ৩০টি বাংলাদেশি পরিবারের বাস। বেশির ভাগই মুসলমান। প্রায় প্রতিটি পরিবারেই আছে ছোট ছোট শিশু। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই ছোট সোনামণিদের বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি ও বাংলাদেশের শেকড়ের সঙ্গে পরিচয় করে দেওয়ার জন্য বাসেলবাসী বাঙালিরা নিজেদের উদ্যোগে গড়ে তুলছেন বাসেল বাংলা স্কুল। সেই স্কুলের তত্ত্বাবধানে এবারও বেশ উৎসাহ ও উদ্দীপনার ভেতর দিয়ে উদ্‌যাপিত হয়েছে ঈদুল ফিতর।

বাসেলবাসী বাঙালিরা চেয়েছিলেন ছোট ছোট শিশুরা অন্যান্য ধর্মের পাশাপাশি তাদের নিজ ধর্মের বিভিন্ন উৎসবের সঙ্গে সঠিকভাবে পরিচিত হোক। কেননা ভিনদেশে বেড়ে ওঠা এই ছোট্ট সোনামণিরা ভিনদেশি উৎসবে (ক্রিসমাস, ইস্টার সানডে ইত্যাদি) সঠিক দিনে শামিল হলে পারলেও বাংলা উৎসবসহ অন্যান্য ধর্মীয় উৎসবগুলো সঠিক দিনে উদ্‌যাপন করতে পারে না।
সুইজারল্যান্ডে বাস করা এই কোমলমতি শিশুরা ২৫ ডিসেম্বরে ক্রিসমাস উদ্‌যাপনের সুযোগ পেলেও ঈদের দিন কোনো ছুটি না থাকায় সঠিক দিনে ঈদ উদ্‌যাপনের সুযোগ তাদের কমই মেলে। তাই এবার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা ছিল সঠিক দিনে ঈদ উদ্‌যাপন করা। সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে সে সুযোগও মিলে যায়। সাপ্তাহিক ছুটির দিন রোববার ঈদ হওয়ায় সঠিক সময়ে ঈদ উদ্‌যাপনে আলাদা কোনো বেগ পেতে হয়নি। বাসেল শহরটা ছোট হলেও এই শহরে কয়েকটি মসজিদ আছে। বাসেলবাসী বাঙালিরা একসঙ্গে ঈদের নামাজ আদায়ের জন্য পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সবাই একই মসজিদে জমায়েত হন। নামাজ শেষে পরস্পরের সঙ্গে কোলাকুলি আর কুশল বিনিময় সেই সঙ্গে বহু দুরে ফেলে আসা প্রাণের মাতৃভূমিতে বাস করা আত্মীয় স্বজনের খোঁজ খবর নেওয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হয় নামাজ পর্ব।
দুপুর হতেই ঈদের আনন্দ সবাই একসঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্য বাংলা স্কুলের প্রায় সকল সদস্য জড়ো হন একজন নিবেদিত প্রাণ বাংলাদেশির বাসায়। তারপরই শুরু হয় ঈদের অনুষ্ঠান। মূলত দুই পর্বে ভাগ করা হয়েছিল অনুষ্ঠান। ভোজনরসিক বাঙালিদের প্রথম পর্ব ছিল উদর পূর্ণ করা। দ্বিতীয় পর্বে ছিল অ্যাপার্টমেন্টের সামনে বাগানের ভেতর বিভিন্ন ধরনের খেলার আয়োজন।

ঈদ আনন্দে সমবেতদের একাংশ
ঈদ আনন্দে সমবেতদের একাংশ

বাঙালির রসনা বিলাসের সঠিক পরিচয় পাওয়া যায় খাবারের প্রকারভেদ দেখে। পুরোদমে বাঙালি হওয়ার আপ্রাণ প্রচেষ্টায় ইলিশও বাদ পড়েনি ঈদের খাবারের মেন্যু থেকে। সেই আয়োজনে গরু ভুনা থেকে শুরু করে মুরগির রোস্ট কিছু বাদ যায়নি। সেই সঙ্গে ছিল মুখে লালা ঝরানো গলদা চিংড়ি আর মলা ঢেলা মাছ। । অনেকেই বলেন মূল খাবারের পরে ডেজার্ট পরিবেশন পশ্চিমা সংস্কৃতির অংশ। আসলে কি তাই? অনেক সময় পশ্চিমা কায়দা-কানুনকেও নিজের মতো করে আপন আঙ্গিকে ফুটিয়ে তোলা যায়। যার এক ঐশ্বর্যময় প্রদর্শনী ছিল মূল খাবারের শেষে। বিভিন্ন প্রকারের সেমাই, ফিরনি, পায়েস, দই, রসমালাই, কেক, রসগোল্লা আর শরবতের রাজকীয় সমাহার আলাদা মাত্রা যোগ করেছিল অতিভোজী বাঙালিদের রসনা বিলাসে। আর এগুলো সবই ছিল বাঙালি রমণীদের স্নেহময় হাতে ঘরে বানানো।

ঈদ আনন্দে সমবেতদের একাংশ
ঈদ আনন্দে সমবেতদের একাংশ

বাঙালির উদ্‌যাপন শুধু খাবারেই সীমাবদ্ধ না রেখে বাগানে আয়োজন করা হয় পুরুষদের জন্য এক ভিন্নধর্মী খেলা। এক মিনিটে একজন পুরুষ কতটা রুটি বেলতে পারেন সেই প্রতিযোগিতা ছিল সত্যি মনোমুগ্ধকর। মিনিটে সর্বোচ্চ চারটা রুটি বানিয়ে পুরুষেরা প্রমাণ করে দেন রুটি বানাতে তারাও অনেক পারদর্শী। তবে রুটির আকার গোল না হয়ে বেশির ভাগ রুটি-ই ছিল ত্রিভুজাকার অথবা চতুষ্কোণ আকৃতির। বাঙালি বধূদের জন্য আয়জন করা হয় ব্যতিক্রমধর্মী রোমাঞ্চকর এক খেলা। যে খেলায় এক নারী আরেক নারীর দুই নয়নে অপলকে চেয়ে থাকতে হবে। এই অপলক চেয়ে থাকায় পলক পড়লেই বাদ পড়ে যাবেন একজন। বিজয়ী হবেন নিষ্পলক নেত্রে চেয়ে থাকা নারী।
এত আয়োজন, এসবের পেছনে একটাই উদ্দেশ্য বাংলাদেশের আত্মীয়-পরিজন ছেড়ে ঈদ করার কষ্টটা একটু লাঘব করা। তবু মস্তিষ্কের নিউরনের স্মৃতি ধরে রাখার যে অসাধারণ ক্ষমতা তা বারবার প্রিয় মানুষের ছবিগুলোকে চোখের সামনে এনে ধরে। সেই ছবিগুলো দুই চোখের কোণে গড়িয়ে পড়া জলে হাবুডুবু খায়।

*লেখক পিএইচডি গবেষক। ইউনিভার্সিটি অব বাসেল, সুইজারল্যান্ড।