ভাষার ঝকমারি
মানুষ যখনই এক দেশ থেকে আরেক দেশে পৌঁছায় নতুন অনেক কিছুর সঙ্গে সঙ্গে নতুন ভাষার সঙ্গেও হয় পরিচয়। ভাষা ভাব প্রকাশের মাধ্যম এবং মানুষের মাঝে ভাবের আদান-প্রদানের বাহন ভাষা। পরস্পরের ভাষা না জানলে সাধারণ (অসাধারণ নয়) ভাবে আদান-প্রদান বড় কষ্টকর। আকারে ইঙ্গিতে বা ছবি এঁকে প্রেম-ভালোবাসা প্রকাশ করা হয়তো যায়, তবে প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় কাজ চালানো বোধ হয় সহজ হয় না।
অপ্রাসঙ্গিক হবে না সেই ঘটনা উল্লেখ করা যে, খ্যাতিমান লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী ছবি এঁকে রেস্তোরাঁয় প্রয়োজনীয় খাবারের ফরমাশ করেছিলেন, যা হয়তো অনেকের জানা। আলী সাহেবের এই কৌশল জেনে রাখার মতো, খুবই প্রয়োজনীয় কৌশল। ভিন দেশে পৌঁছে ওই যে খাবারের ফরমাস দিতে গিয়ে শূকর ও মুরগির ছবি এঁকে শূকরের ছবিতে ক্রস (x) আর মুরগীতে টিক (P) চিহ্ন দিয়ে ওয়েটারকে সহজ ইঙ্গিতেই বোঝানো গিয়েছিল কী চাই, মুখের ভাষার আর দরকার হয়নি।
ভাষাও মানুষের সঙ্গে সঙ্গে দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। উপনিবেশ কব্জা করেছিল বলে পৃথিবীর অনেক দেশে ইংরেজি চালু হয়েছে। আফ্রিকার অংশবিশেষে ফরাসিরা শাসন করেছিল, তাতে ফ্রেঞ্চ কলোনির আওতাধীন আফ্রিকান লোকজন ফরাসি জানে আর স্পেনের উপনিবেশ হওয়ার সুবাদে লাতিন আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার লোকেরা জানে স্প্যানিশ ভাষা। লাতিন আমেরিকাতে মানুষের আরবি নাম (যেমন মাজিদা, সাইদা, সালমা) শুনে কিছুটা অবাক হয়েছি। পরে চিন্তাভাবনা করে বের করলাম মুসলমানরা স্পেন দখল করেছিল, তারপর স্প্যানিশরা দখল করে আমেরিকার ওই অঞ্চল। এতেই মনে হয় আরবি নাম ওই দেশে পৌঁছে যায়। তবে গবেষকেরাই সঠিক তথ্য বলতে পারেন।
যা হোক, প্রায় পৃথিবীর প্রতি মহাদেশেই ইংরেজি ভাষা বলার মতো লোক আছে। যদিও তাতে উচ্চারণে যে আঞ্চলিকতার ছাপ মিশে থাকে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নাক উঁচু ইংরেজ হয়তো বলবে ইংরেজি ভাষাই বলছে, তবে তা ভারতীয় বা বাংলাদেশি বা আফ্রিকান। চট করে খুঁজে পাওয়া যাবে যারা কলকল করে আঞ্চলিকতায় আচ্ছন্ন ইংরেজি বলার ক্ষমতা রাখে। আসুক দেখি একসঙ্গে দশজন ইংরেজ, যারা ইংরেজি উচ্চারণে হলেও বাংলা, হিন্দি, গুজরাটি বা সহেলি বলায় পারদর্শী। ইংরেজ বাবু তখন একেবারেই কাবু!
যার বোধবুদ্ধি ও সামান্য প্রজ্ঞা আছে সে বলে, ‘আরে এরা তো সাংঘাতিক বুদ্ধিমান লোক, কী সহজে ভিনদেশি ভাষা রপ্ত করে নিয়েছে দেখ।’ আর যার ‘ওই’ (?) জিনিসের খামতি আছে সে বলে, ‘ইংরেজি বললেই হলো নাকি উচ্চারণ ঠিকমতো হচ্ছে না।’
ভাষাবিজ্ঞানী বা ভাষাতাত্ত্বিকেরা বলেন, ছোটবেলা থেকে না বললে উচ্চারণ ঠিকমতো হয় না, কারণ বড় হয়ে গেলে মুখের ভিতরের পেশি বা মাসলসঞ্চালন ইচ্ছেমতো করা যায় না।
উচ্চারণ সঠিকভাবে তাই হয়তো হয়ে ওঠে না, তবে বিদেশিদের শুদ্ধভাবে ইংরেজি লেখার দক্ষতা কিন্তু অনেক সাধারণ (পণ্ডিত নন) ইংরেজকে বিস্মিত করে।
এক ইরানি নারীকে তার প্রতিবেশী ইংরেজ বন্ধু প্রায়ই উচ্চারণ শুধরে দিতেন। ওই নারীও বন্ধুর কাজকে সহজভাবে নিয়েছেন। তবে ইংরেজ বন্ধু উচ্চারণে ত্রুটি ধরে এমনভাবে তাকাত যার মানে দাঁড়াত ‘হওনা ডাক্তার বা প্রফেসর, ইংরেজি তো সঠিকভাবে বলতে পার না।’ তো সেই ইংরেজ নারী একদিন একটি দরখাস্ত লিখে ইরানি নারীর কাছে নিয়ে এল। সে বুঝতে পারছে না ওই দরখাস্তে কোন শব্দটি লিখলে ঠিক হবে, ইনডিপেন্ডেন্টলি নাকি অটোনমাসলি। ইরানী নারী তো ইংরেজ নারীর ইংরেজিজ্ঞান দেখে হতভম্ভ। পুরো দরখাস্ত নতুন করে সাজিয়ে লিখে দিয়ে নম্রভাবে বলল-
‘এখানে ইনডিপেন্ডেন্টলি শব্দটিই জুতসই, তবে তোমার বানান অনেক ভুল, এরপর কিছু লিখলে ডিকশনারি দেখে নিও।’
উচ্চারণ নিয়ে গর্বিত ইংরেজ নারী নিরীহভাবে স্বীকার করল, ‘ওই জিনিসই জীবনে দেখে শিখিনি কখনো।’
ভদ্রতার আভিজাত্যে ইরানি নারীর যে কথা বলা হয়নি তা হলো, এক উচ্চারণ ছাড়া ইংরেজ নারীর সবই তো দেখছি শূন্য।
তবে সবাই কিন্তু উচ্চারণ-বিষয়ক অভিযোগ সহজে মেনে নেয় না। যেমন এক অবাঙালি ভারতীয় ভদ্রলোক অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের মাঝে জনপ্রিয়ও তিনি। এক ছাত্র ওই শিক্ষকের উচ্চারণ বোঝে না বলে অনুযোগ তুলল। প্রথম বর্ষের ছাত্র। ভদ্রলোক তাকে ডেকে বললেন, ‘দেখো বাপু, ভারতীয় উচ্চারণে ইংরেজি বলেই এখানে সাত বছর আছি, আগামী মাসে চলে যাচ্ছি বিলাতে শিক্ষকের চাকরিতে যোগ দিতে; মনে হচ্ছে তোমার কানে সমস্যা আছে go get your ear fix,’ ভদ্রলোক পরে খোঁজ নিয়ে জানলেন ওই ছাত্রটি প্রত্যন্ত এক এলাকা থেকে স্কলারশিপ পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছে। বেচারা আগে কখনোই কোনো বিদেশি দেখেনি, বিদেশির মুখে ইংরেজিও শোনেনি, তাতে বোঝা গেল সমস্যা ওর শোনারই হবে হয়তো।
বইপত্র ঘেঁটে ব্যাকরণসম্মত ভাষা শিখলেই যে ভাষার সব রকম প্রকাশভঙ্গি আয়ত্ত হয়ে যায়, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। দৈনন্দিন জীবনে মানুষ কতভাবে যে নানা কথা ব্যক্ত করে তা সে সব কথার কোনো কোনোটা এক হলেও প্রেক্ষিত বিশেষে নানা অর্থ ধারণ করে।
যেমন এক ভদ্রলোক কর্মস্থলে ব্যস্ত হয়ে ছুটছেন, ঢোকার মুখে দুই সহকর্মীর সঙ্গে দেখা। একজন সহাস্যে বলে উঠল।
‘Speaking of the devil, devil is here!’
ওই দুজনেরই খুব দরকার ছিল ভদ্রলোকে কাছে। তারা সে প্রসঙ্গে কথা শুরু করল। তবে ভদ্রলোকের কিছুটা মন খারাপ হলো। ভাবলেন, এত দরকার যাকে, তাকে দেখে কি না বলে ‘শয়তানের কথাই বলছি, আর শয়তান এখানেই।’
ভদ্রলোক যখন রাতে খাবার টেবিলে ওই দুজনের প্রতি বিরক্তি নিয়ে ঘটনাটা বলছিলেন, শুনে তো মেয়ে হেসে খুন।
‘শোন বাবা, এতে খ্যাপার কিছু নেই। আমরা একদিন প্রিন্সিপ্যালকে খুঁজছি কি এক দরকারে যেন, করিডোরে দেখা হতেই আমাদের একজন এই কথাটাই তাঁকে বলল আর উঁনিও হেসে বললেন, ‘শয়তানের কাছে কি দরকার বল?’ এখন বুঝলে তো।
এই বাক্যের অর্থ প্রেক্ষিত অনুযায়ী অন্য রকম হতে পারে। তবে ওপরে বর্ণিত প্রেক্ষিতে এই কথার বাংলা বলা যেতে পারে ‘মেঘের জন্য হাঁ-পিত্যেশ আর বৃষ্টিই নামলো দেখি।’
এবার এক ইংরেজ ভদ্রলোকের কাহিনি। ভদ্রলোক বাংলাদেশে ব্রিটিশ ওভারসিজ ডেভেলপমেন্ট এজেন্সিতে চাকরি করেন। বাংলা শিখেছেন ব্যাকরণ মেনে। এক গ্রুপ ডিসকাশনে গ্রামের মেয়েদের সঙ্গে খুব মেপে মেপে সাবধানে বাংলা বললেন। একপর্যায়ে মেয়েরা জানতে চাইল। ‘ভাইয়ের কয় বাচ্চা?’
ভদ্রলোক বুঝতে পারলেন না। এবার মেয়েরা বলল, ‘কয় সন্তান আপনার?’
তিনি তখন দু আঙুল তুলে ধরে বললেন, ‘আমার দুই মেয়েরা আছে।’
পরে যখন তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হলো সে কেন ‘মেয়েরা’ বলতে গেছে। ব্যাকরণসম্মত বাংলা জ্ঞান নিয়ে ভদ্রলোক বললেন যে, তার একটা হলে মেয়ে বলতেন, তার তো দুই মেয়েরা ( two girls) আছে।
ভদ্রলোককে তখন বোঝানো হলো যে, বাংলা ভাষা এভাবে বলে না। কারোর ১০ মেয়ে থাকলেও সে বলবে তার ১০ মেয়ে আছে, ১০ মেয়েরা আছে বলা অশুদ্ধ। ইংরেজ ভদ্রলোক বিস্মিত হলেন খুব, আর বাংলাভাষার ঝকমারিতে কিছুটা বিপন্নও বোধ করলেন মনে হলো।
ভাষা হিসেবে ইংরেজি ভাষাটা মোটামুটি সহজই মনে হয়। ইংরেজি বর্ণমালাও কম, মাত্র ২৬টা। আর বাংলায় রয়েছে ৪৯টি অক্ষর। ইংরেজিতে স্বরবর্ণ বা Vowel মাত্র পাঁচটি, বাংলায় ১১টি স্বরবর্ণ তো রয়েছেই, তারও ওপর রয়েছে স্বরচিহ্ন। ‘ই’ লিখলে সব জায়গায় চলবে না, স্বরচিহ্ন ‘ি’ জানতে হবে অবশ্যই। ‘ই’ দিয়ে বই লেখা যায় তবে বিয়ে লিখতে ‘ই’ দিয়ে শুরু করলেই মুশকিল, তা হয়ে যাবে। ‘ইব’। বিদেশিদের পক্ষে তি খুটিনাটি মনে রাখা কষ্টকর প্রচেষ্টা অবশ্যই। জটিল ভীষণ। এই কারণেই বোধ হয় বাংলাভাষীরা সহজে বিদেশি ভাষা আয়ত্তের ক্ষমতা রাখে।
দিলরুবা শাহানা
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া